• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
রেমিট্যান্সের রেকর্ড এবং প্রবাসী শ্রমিকদের নিরাপত্তা

সংগৃহীত ছবি

মতামত

রেমিট্যান্সের রেকর্ড এবং প্রবাসী শ্রমিকদের নিরাপত্তা

  • শাহ আহমদ রেজা
  • প্রকাশিত ০৬ নভেম্বর ২০১৯

আজকের নিবন্ধে একই সঙ্গে পরস্পরবিরোধী দুটি তথ্য-পরিসংখ্যানের উল্লেখ করা হবে। একটি উৎসাহজনক, দ্বিতীয়টি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী— অত্যন্ত নৈরাশ্যজনক শুধু নয়, যে কোনো মূল্যায়নে ভীতিকরও।

প্রথমে সুখবরটুকু জানানো যাক। গত ৪ নভেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকের খবরে জানানো হয়েছে, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে প্রবাসীরা যে অর্থ পাঠিয়েছেন তার পরিমাণ ছয় হাজার ১৫৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল পাঁচ হাজার ১০৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে রেমিট্যান্সের আয় বেড়েছে এক হাজার ৪৮ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে শুধু সদ্য সমাপ্ত মাস অক্টোবরেই এসেছে এক হাজার ৬৪২ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ১৩ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা। এই টাকার তুলনায় গত বছরের অক্টোবরে এসেছিল ১০ হাজার ২২০ কোটি টাকা। এ বছরের অক্টোবরে চারশ মিলিয়ন ডলার বেশি রেমিট্যান্স আসায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। এই পরিমাণ রিজার্ভের ক্ষেত্রে দেশের সর্বোচ্চ রেকর্ড।

তথ্যটি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত উৎসাহজনক। কিন্তু এরই পাশাপাশি রয়েছে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী কিছু ভীতিকর তথ্য-পরিসংখ্যানও। সেগুলো প্রবাসীদের লাশ সম্পর্কিত। বর্তমান বাংলাদেশে গুম-হত্যা ও অপমৃত্যুর পাশাপাশি লাশের খবর অত্যন্ত স্বাভাবিক ও প্রায় নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হলেও সম্প্রতি প্রকাশিত কিছু খবরে মানুষ মাত্রই চমকে উঠতে হয়েছে। তারা ভীত-সন্ত্রস্ত না হয়েও পারেননি। যেমন গত ৩০ অক্টোবর এরকম এক খবরে একটি জাতীয় দৈনিক জানিয়েছে, ১০ বছরে দেশে ফিরেছে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিকের লাশ। এর পর পর, গত ৩ নভেম্বর দেশের অন্য একটি প্রধান দৈনিকও প্রবাসী শ্রমিকদের লাশ সম্পর্কিত একই খবর প্রকাশ করেছে। দুটি রিপোর্টে সামান্য পার্থক্য রয়েছে শুধু সংখ্যার। ২০০৯ থেকে চলতি বছর ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত পরিসংখ্যানের উল্লেখ করতে গিয়ে প্রথম দৈনিকটি যেখানে ২৯ হাজার ৩৩৮ জনের লাশ আসার কথা জানিয়েছে, দ্বিতীয় দৈনিকটি সেখানে জানিয়েছে, লাশ এসেছে ২৬ হাজার ৭৫২ জনের। অন্য কয়েকটি দৈনিকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় চলছে। মোট সংখ্যার পরিসংখ্যানে সামান্য কমবেশি হলেও সব রিপোর্টেই জানানো হয়েছে, গত নয় মাসে দেশে প্রায় তিন হাজার বাংলাদেশি শ্রমিকের  লাশ এসেছে।

হজরত শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্ক এবং প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া পরিসংখ্যানের উদ্ধৃতি দিয়ে দৈনিকগুলোতে কয়েকটি দেশের নামও জানানো হয়েছে, যেসব দেশে কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মৃত্যু ঘটেছে। রিপোর্টে জানানো হয়েছে, গত ১০ বছরে সবচেয়ে বেশি শ্রমিকের লাশ এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, কুয়েত, ওমান, জর্ডান, কাতার ও লেবানন। তবে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি সৌদি আরবে। শুধু গত বছর, ২০১৮ সালেই সৌদি আরবে এক হাজারের বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক মারা গেছে। মালয়েশিয়া থেকেও লাশ আসছে নিয়মিত।  

উদ্বেগের কারণ সৃষ্টি হয়েছে কিছু বিশেষ কারণে। বিভিন্ন রিপোর্টের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সংখ্যায় কম হলেও তুলনামূলকভাবে নারীশ্রমিকদের মৃত্যু বেশি ঘটেছে। কথা শুধু এটুকুই নয়। নারীদের মধ্যেও প্রায় সকলে আবার ‘আত্মহত্যা’ করেছে বলে সংশ্লিষ্ট দেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। মানিকগঞ্জের এরকম এক নারীশ্রমিকের বিষয়ে জানা গেছে, সে নাকি বেশ কিছুদিন ধরেই তার ওপর প্রচণ্ড নির্যাতন চালানো হচ্ছে বলে জানিয়ে আসছিল। দেশে ফিরে আসার জন্যও সে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু পাসপোর্ট তার নিজের কাছে ছিল না। ছিল সৌদি আরবের ‘কফিল’ কোম্পানির কাছে, যার ঠিকানা তাকে জানানো হয়নি। ফলে সেও কফিলের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারেনি। ক’দিন আগে, গত ৩১ অক্টোবর সে পারভিন আক্তারের লাশই দেশে এসেছে। তার ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা রয়েছে, সে নাকি ‘আত্মহত্যা’ করেছে! পারভিন আক্তারের স্বজনরা অবশ্য আত্মহত্যার কথা মেনে নিতে সম্মত হয়নি। তারা লাশের ময়নাতদন্ত করে মৃত্যুর সঠিক কারণ উদ্ঘাটন এবং হত্যা করা হয়ে থাকলে যথোচিত পরিমাণে আর্থিক ক্ষতিপূরণ আদায়ের জন্য দাবি জানিয়েছে।

প্রকশিত এক রিপোর্টে প্রসঙ্গক্রমে জানানো হয়েছে, প্রবাসে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ কখনো যাচাই করা হয় না। যে দেশে মৃত্যু ঘটে সে দেশের সরকার বা আমদানিকারক কোম্পানির পক্ষ থেকে মৃত্যুর যে কারণ উল্লেখ করা হয় তাকেই সত্য বলে ধরে নেয় বাংলাদেশ সরকার। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ও মৃত শ্রমিকদের পরিবারের দাবি অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থা নেয় না। সংশ্লিষ্ট দেশের কাছেও সরকার ময়নাতদন্তসহ অনুসন্ধান করার জন্য অনুরোধ জানায় না। এভাবেই প্রবাসে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। অথচ ভারতের তো বটেই, এমনকি শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলোর ক্ষেত্রে কিন্তু এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে না। কারণ কোনো শ্রমিকের স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটলেও এসব দেশের সরকার সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করে। ফলে মৃত শ্রমিকের দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ময়নাতদন্তের পাশাপাশি বিস্তারিত অনুসন্ধান করতে হয় প্রতিটি চাকরিদাতা দেশের সরকার ও কোম্পানিকে। অন্যদিকে বাংলাদেশের শ্রমিকদের বেলায় ঘটছে সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনা। চাকরিদাতা দেশটি কোনোভাবে লাশ পাঠিয়েই তার ‘দায়িত্ব’ শেষ করে। বড়জোর লাশের সঙ্গে একটি ডেথ সার্টিফিকেট পাঠিয়ে দেয়।

এদিকে লাশকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহে অন্য কিছু বিস্ময়কর ও আপত্তিজনক তথ্যও বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। এরকম একটি তথ্য হলো, সৌদি আরবে কোনো পুরুষশ্রমিক পাঠাতে হলে তার সঙ্গে অবশ্যই একজন নারীশ্রমিককে পাঠাতে হবে। বছর কয়েক ধরে সৌদি আরব নাকি এই মর্মে একটি আইন প্রবর্তন করেছে। কিন্তু এ বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি সরকার কোনো লিখিত চুক্তি করেনি। সবই চলছে মৌখিক কথার ভিত্তিতে।

কোনো চুক্তি বা আইন না থাকা সত্ত্বেও চাকরির প্রয়োজন অনেক বেশি বলে বাংলাদেশকে কথিত আইনটি মেনে চলতে হচ্ছে। সে কারণে প্রত্যেক পুরুষশ্রমিকের সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে অন্তত একজন নারীশ্রমিককে পাঠাতে হচ্ছে। কিন্তু যাওয়ার আগে নারীশ্রমিকরা জানতে পারছে না, সৌদি আরবে গিয়ে ঠিক কোন কর্মস্থলে বা প্রতিষ্ঠানে তাদের কোন ধরনের চাকরি করতে হবে। আশঙ্কার বিষয় হলো, বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো পুরুষদের মতো নারী শ্রমিকদেরও সৌদি কোনো কোম্পানির কাছে পৌঁছে দেয়। ‘কফিল’ নামে পরিচিত এসব কোম্পানি প্রথমেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল শ্রমিকের কাছ থেকে তাদের পাসপোর্ট নিয়ে নেয়। পাসপোর্টগুলো শেষ পর্যন্ত কফিল কোম্পানির কাছেই থেকে যায়। কর্মস্থলও কফিল কোম্পানিগুলোই ঠিক করে দেয়। আর প্রায় সব ক্ষেত্রেই বিশেষ করে নারীশ্রমিকদের চাকরির নামে পাঠানো হয় সৌদিদের বাসাবাড়িতে। এর ফলে ধর্ষণসহ কোনো অন্যায় বা নির্যাতনের শিকার হলেও নারীশ্রমিকরা প্রতিবাদ করতে বা আইনসম্মত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। বাংলাদেশের দূতাবাসও এসব শ্রমিকের পক্ষে কখনো কোনো ভূমিকা পালন করে না। দূতাবাসের কর্তাব্যক্তিরা এমনকি এ খবর পর্যন্ত রাখার প্রয়োজন বোধ করেন না যে, নারীশ্রমিকদের কোন শহরের কোন ব্যক্তিদের বাসাবাড়িতে নিযুক্তি দেওয়া হয়েছে এবং তারা কেমন আছে।

ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ডসহ বিভিন্ন সংস্থার পর্যালোচনা ও অনুসন্ধানের ভিত্তিতে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা গেছে, ২০১৬ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত যে ৩১১ জন নারীর লাশ এসেছে সেগুলোর মধ্যে ৫৩ জন ‘আত্মহত্যা’ করেছে এবং ৫৬ জন ‘দুর্ঘটনায় মারা গেছে’ বলে সার্টিফিকেট পাঠানো হলেও বাস্তবে প্রতিটি মৃত্যুর পেছনেই রয়েছে ভিন্ন কোনো কারণ। তা ছাড়া এত কম বয়সী ১২০ জন নারীর ‘স্ট্রোকে’ মৃত্যু হয়েছে বলে লাশের সঙ্গে যে সার্টিফিকেট জুড়ে দেওয়া হয়েছে সেসবের কোনোটিকেও বিশ্বাসযোগ্য বলে মানতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা। তারা বরং ধর্ষণসহ যৌন নির্যাতনকেই প্রধান কারণ বলে মনে করেন। অর্থাৎ এসব নারীশ্রমিককে আসলে হত্যা করা হয়েছে।     

প্রকাশিত বিভিন্ন রিপোর্টে ভীতিকর আরো অনেক তথ্যেরও উল্লেখ রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রাধান্যে এসেছে সরকারের উদাসীনতার দিকটি। উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিশেষ করে নারীশ্রমিকদের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেওয়া দরকার। সরকারের উচিত পররাষ্ট্র, প্রবাসীকল্যাণ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মিলিত উদ্যোগে বিশেষ টিম গঠন করে বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে টিমগুলোকে পাঠানো। কোথাও কোনো কারণে কোনো বাংলাদেশি শ্রমিকের মৃত্যু ঘটলে বিশেষ টিমগুলো সে দেশের সরকারের সহযোগিতা নিয়ে তদন্ত ও অনুসন্ধান চালাবে এবং হত্যার আলামত পাওয়া গেলে আর্থিক ক্ষতিপূরণ আদায়ের পাশাপাশি দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে ভূমিকা পালন করবে। হত্যার কোনো ঘটনাকেই যাতে দুর্ঘটনা বা আত্মহত্যা বলে চালানো সম্ভব না হয় সে ব্যাপারেও নজর রাখতে হবে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে। এ ক্ষেত্রেও নারীশ্রমিকদের বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

সবশেষে বলা দরকার, রেমিট্যান্স তথা প্রবাসীদের আয় বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির একটি অন্যতম ফ্যাক্টর সন্দেহ নেই; কিন্তু মানুষের তথা প্রবাসী শ্রমিকদের জীবনের মূল্য দেওয়ার ব্যাপারে অবশ্যই সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের উচিত সৌদি আরবসহ সব দেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করা, যাতে নারীশ্রমিকদের সঙ্গে তো বটেই, পুরুষশ্রমিকদের সঙ্গেও অমানবিক আচরণ না করা হয় এবং প্রবাসে যাতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের অপমৃত্যু না ঘটে। বলা বাহুল্য, এ ধরনের চুক্তি ও আয়োজনের ব্যাপারে বিলম্ব করা হলে প্রবাসে মৃতদের লাশের মিছিল আরো দীর্ঘই হতে থাকবে। এই কঠিন সত্যও অনুধাবন করা দরকার যে, যত অভাবই থাকুক, কোনো শ্রমিকই নির্যাতিত হওয়ার এবং লাশ হয়ে দেশে ফেরার জন্য এত কষ্ট ও অর্থ ব্যয় করে বিদেশে যায় না এবং জনগণও মাত্র ১০ বছরে ৩০ হাজার প্রবাসী শ্রমিকের লাশ দেখতে চায় না। দেশপ্রেমিক পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রেমিট্যান্স আয়ে সর্বোচ্চ রেকর্ড সম্পর্কিত তথ্য-পরিসংখ্যান নিয়ে গর্বে বুক ফোলানোর সময় নারীসহ প্রবাসী শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

 

লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads