• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
প্রবাসী শ্রমিকদের এমন প্রত্যাবর্তন অমানবিক

ফাইল ছবি

মতামত

প্রবাসী শ্রমিকদের এমন প্রত্যাবর্তন অমানবিক

  • প্রকাশিত ০৬ নভেম্বর ২০১৯

শ্রমবাজারে ধস নেমেছে। প্রতিদিনই বিদেশ থেকে ফেরত আসছে প্রবাসী শ্রমিকরা। সরকারসহ সংশ্লিষ্টরা এখনো করণীয় নির্ধারণ করতে পারেননি। সৌদি আরবে বাংলাদেশি গৃহপরিচারিকা নিয়োগে ব্যাপক ধস দেখা দিয়েছে। উভয় দেশে দালালদের অধিক লাভ করার প্রবণতা, শ্রমিকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও পেশাদারিত্বের অভাবসহ বিভিন্ন কারণে দেশটিতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের গৃহপরিচারিকা হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার হার কমেছে ৩০ শতাংশ।

দেশটির বেশ কয়েকটি নিয়োগ অফিসের মালিকরা মনে করেন, সৌদি আরবে পাঠানোর আগে বাংলাদেশি গৃহপরিচারিকাদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। বাংলাদেশের নিয়োগ অফিসগুলোও এদিকে নজর দেয় না। সৌদি আরবে বাংলাদেশ থেকে গৃহপরিচারিকা নেওয়ার প্রক্রিয়া খুবই অগোছালো। পাশাপাশি বাংলাদেশের নিয়োগ অফিসগুলো সৌদি আরবের সঙ্গে বোঝাপড়া নিজেরা না করে দালাল নিয়োগ করতে বেশি আগ্রহী।

শুধু সৌদি আরব নয় মালয়েশিয়া থেকে প্রায় ৫০ হাজার অবৈধ বাংলাদেশি কর্মীকে আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ট্রাভেল পাস নিয়ে দেশে ফিরতে হবে। মালয়েশিয়া সরকারের ঘোষিত সাধারণ ক্ষমা ‘ব্যাক ফর গুড’ (বিফোরজি) কর্মসূচির আওতায় এসব অবৈধ অভিবাসীদের দেশে ফিরতে হচ্ছে। কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

বর্তমানে প্রায় ৭ লাখ বাংলাদেশি কর্মী মালয়েশিয়ার বিভিন্ন খাতে কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর রেমিট্যান্স আয় করছে। যারা সাগরপথে দালাল চক্রের মাধ্যমে দেশটিতে প্রবেশ করেছিল, ২০১৬ সালের রি-হায়ারিং কর্মসূচিতে বৈধতা লাভের সুযোগ না পাওয়ায় এবং ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যারা অবৈধ হয়েছে এমন কর্মীরাই এ সুযোগ পাবে। উল্লিখিত কর্মসূচির আওতায় গত ১ আগস্ট থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ফিরেছেন ১১ হাজার ৫৪৮ বাংলাদেশি। এর মধ্যে ১০ হাজার ১৩৯ জন পুরুষ এবং ১ হাজার ৪০৯ জন নারী।

বাংলাদেশি কর্মীরা সৌদি আরব ও বাংলাদেশের আদম ব্যবসায়ীদের ‘টাকা বানানোর মেশিনে’ পরিণত হয়েছে—গত কয়েক দিনের জাতীয় পত্রিকাগুলোর প্রতিবেদন এমন কথাই জানাচ্ছে। আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে দেখছি, বাংলাদেশি জনশক্তির এই বৃহত্তম বাজার থেকে বলতে গেলে দলে দলে প্রবাসী শ্রমিক ফেরত আসছে। চলতি বছরেই যখন ফেরত আসা শ্রমিকের সংখ্যা ১৮ হাজার পেরিয়ে গেছে, তখন বোঝা যায় পরিস্থিতি কতটা গুরুতর। তাদের অনেকের কাছে ‘আকামা’ বা কাজের অনুমতিপত্র থাকলেও মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ফেরত পাঠানো হচ্ছে বিষয়টি খতিয়ে দেখেছেন কি সংশ্লিষ্টরা। মনে রাখতে হবে, এভাবে দলে দলে শ্রমিক মেয়াদপূর্তির আগেই ফিরে আসতে থাকলে নেতিবাচক প্রভাব শুধু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে পড়বে না; সামাজিক ক্ষেত্রেও দেখা দেবে অস্থিরতা।

জনশক্তি রপ্তানিতে দুর্নীতি, অনিয়ম ও হয়রানি দূর করতে হলে এজেন্সিগুলোতে নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকারের উপায় নেই। সুতরাং বাংলাদেশি জনশক্তির নিরাপত্তা, অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। ভুলে যাওয়া চলবে না, আমাদের প্রবাসী শ্রমিক ভাইয়েরা নিছক টাকা কামানোর মেশিন নয়, বরং মানুষ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানে গিয়ে, বিশেষ করে সৌদি আরবে বাংলাদেশি শ্রমিকরা নির্যাতিত, প্রতারিত হওয়াসহ নানান সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিভিন্ন সময় ফেরত আসা শ্রমিকরা তাদের ওপর ঘটে যাওয়া নির্যাতন-বর্বরতার কাহিনীও তুলে ধরেছে। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০১৮ সালেই সৌদি আরব থেকে নির্যাতন, নিগ্রহ, বঞ্চনার শিকার হয়ে ১ হাজার ৩৬৫ জন ফেরত এসেছে। সম্প্রতি জানা যায়, আকামার মেয়াদ (বৈধ অনুমোদন) থাকা সত্ত্বেও সৌদি পুলিশ বাংলাদেশি শ্রমিকদের আটক করে দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে। চলতি বছর ১৬ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি সৌদি আরব থেকে ফেরত এলো। বিদেশ থেকে শ্রমিক ফেরত আসার ঘটনাকে উদ্বেগজনক হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকরা।

অস্বীকার করা যাবে না, দেশের জাতীয় রাজস্বের সিংহভাগেরই জোগান দেয় প্রবাসে কর্মরত শ্রমিক। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির আকার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এসব শ্রমিক প্রবাসে কীভাবে দিনযাপন করে তার খোঁজ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নেয় না, এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। প্রবাসে বাংলাদেশি দূতাবাসের কর্মকর্তারাও আমাদের শ্রমিকের ব্যাপারে সবসময় উদাসীন। আমরা জানি, প্রবাসে কর্মক্ষেত্রে বাংলাদেশি শ্রমিকদের অধিকার ও নিরাপত্তা রক্ষার লক্ষ্যে সরকার নতুন একটি নীতিমালা তৈরি করেছে। নীতিমালায় বাংলাদেশিদের নিরাপদ অভিবাসন এবং অভিবাসী কর্মীদের সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তার দিকগুলো সম্পর্কে অধিকতর সমন্বয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, এরপরও কেন প্রবাস থেকে শ্রমিকরা নির্যাতনের স্বীকার হয়ে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হবে?

একসময় জনশক্তি রপ্তানি বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি বড় উপাদান ছিল। দেশের অর্থনীতির চাকা সক্রিয় ও সচল রাখতে এখনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। একসময় মালয়েশিয়ায় ‘জি-টু-জি’ অর্থাৎ সরকারের সঙ্গে সরকারের বোঝাপড়ার ভিত্তিতে জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে। কিন্তু এর বাইরেও অনেকে অবৈধ পথে বিভিন্ন দেশে গিয়েছে। অনেকে বৈধপথে বিদেশে গিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের পর অবৈধ হয়ে পড়েছে। আবার প্রবাসে শ্রম বিক্রি করতে যাওয়া জনশক্তির একটি বড় অংশ অদক্ষ। আমরা দক্ষ জনশক্তি সেভাবে বিদেশে পাঠাতে পারিনি। আবার বিদেশের বাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করতে পারিনি। ফলে আমাদের পাঠানো জনশক্তির একটি বড় অংশ যে অর্থ খরচ করে বিদেশে যায়, তাদের বিনিয়োগ তুলতেই চুক্তির সময় চলে যায়। বাধ্য হয়েই অনেকে বেছে নেয় অবৈধ পথ। আবার অসৎ ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে অনেকেই অবৈধ পথে পা বাড়িয়ে সেখানে গিয়ে ধরা পড়ে। সুতরাং এ বিষয়গুলোর সুরাহা এখনোই হওয়া উচিত বলে মনে করি।

তদুপরি সৌদি কর্তৃপক্ষ কেন বৈধ শ্রমিকদের গ্রেপ্তার করে দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে তা যথাযথ অনুসন্ধান করে পরবর্তী পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে। তথ্যানুযায়ী, সৌদি আরবে কর্মরত নির্মাণশ্রমিকদের বেশিরভাগই বাংলাদেশি। ফলে কেন তাদের ওপর সংশ্লিষ্টরা এমন নির্যাতন চালাচ্ছেন, তা খতিয়ে দেখে কার্যকর উদ্যোগ নিতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বিদেশে চাকরি নিয়ে যাওয়া আমাদের নারী কর্মীদের যথার্থ মর্যাদা ও সম্মান নিশ্চিত করে নিরাপদে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

১০ সিন্ডিকেটের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের দরুন ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতার পর দেশটির শ্রমবাজার চালুর লক্ষ্যে আজ ৬ নভেম্বর পুত্রাজায়ায় উভয় দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, শিগগিরই মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত হবে। অবৈধ বাংলাদেশি কর্মীদের দেশটিতে বৈধতা দেওয়ার বিষয়টিও আসন্ন দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে উঠতে পারে।

আলোচনার শুরুতেই বলেছি, আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে মালয়েশিয়া থেকে সব অবৈধ অভিবাসীকে বিফোরজি পদ্ধতি অনুসরণ করে নিজ নিজ দেশে ফেরত যেতে হবে। যারা ওই তারিখের মধ্যে দেশে ফিরবে না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে থাকা বিদেশি কর্মীদের বৈধ করতে ২০১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে রি-হায়ারিং প্রকল্প হাতে নেয় দেশটি। এ প্রকল্পের মাধ্যমে নিবন্ধন করে অবৈধ কর্মীদের বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়। দফায় দফায় এ প্রকল্পের মেয়াদও বাড়ানো হয়। তবে অনেক অবৈধ বাংলাদেশি দালাল চক্রের হাতে প্রতারিত হয়ে এ প্রকল্পের সুযোগ নিতে পারেননি। যাদের কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই এমন অবৈধ কর্মীদের বৈধতা দিতেই রি-হায়ারিং প্রকল্প গ্রহণ করেছিল দেশটির সরকার।

একটি সূত্র থেকে জানা যায়, দূতাবাস থেকে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৩০০ ট্রাভেল পাসের জন্য আবেদন জমা পড়ছে। ট্রাভেল পাস ইস্যুর ক্ষেত্রে আবেদনকারীর তথ্যাদি যাচাই-বাছাইপূর্বক ট্রাভেল পাস ইস্যু করা হচ্ছে। বিফোরজি কর্মসূচির আওতায় মালয়েশিয়াজুড়ে ২০০ কর্মকর্তার সমন্বয়ে ৮০টি কাউন্টার খোলা হয়েছে। এসব কাউন্টার থেকে অবৈধদের ফেরত যাওয়ার জন্য সহায়তা করছে মালয়েশিয়া সরকার। এই সুযোগ যারা নেবে না, নতুন বছরের শুরুতে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে নিজ দেশে ফেরার আগে অবৈধ অভিবাসীদের সঙ্গে কোনো কোম্পানির দেনা-পাওনা থাকলে, তা মীমাংসার দায়িত্ব নেবে না মালয়েশিয়া সরকার। কর্মীদের তাদের নিজ উদ্যোগেই কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করে দেনা- পাওনা মেটাতে হবে।

সর্বোপরি বলতে চাই, দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ গতিশীল রাখতে হলে নতুন নতুন শ্রমবাজার খুঁজতে হবে। প্রবাসী বাংলাদেশি পুরুষ-নারী কর্মীদের দুর্বিষহ জীবনযাপন এবং তাদের দলে দলে দেশে ফিরে আসার বিষয়টি কিছুতেই স্বস্তিদায়ক হতে পারে না। আমরা প্রত্যাশা করি, সরকার তথা সংশ্লিষ্টরা সার্বিক বিষয়ে যথাযথ অনুসন্ধান করে, প্রবাসে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে অবিলম্বে কার্যকর উদ্যোগ নেবে।

জহিরুল ইসলাম

লেখক : শিক্ষক

gpislam99@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads