• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
আহ্ আসক্তি

প্রতীকী ছবি

মতামত

আহ্ আসক্তি

  • রায়হান উল্লাহ
  • প্রকাশিত ১৮ নভেম্বর ২০১৯

আসক্তি। শব্দটি নেতিবাচক। ইতিবাচক হিসেবেও চাইলে এর ব্যবহার করা যায়। কোনোকিছুর প্রতি প্রবল টান একপ্রকার আসক্তি। প্রবল হওয়াতে এটি খারাপ দিকেই ধাবিত করে। তবে জ্ঞানের প্রবল টানও কিন্তু আসক্তি; যা খারাপ হওয়ার কথা নয়। আর ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি ও পরবর্তী সবকিছু জানার ইচ্ছা মন্দ কিছু নয়। তবু বলব আসক্তি থেকেই যত সব সৃষ্টি, বিনির্মাণ এবং ধ্বংস।

আসক্তির সংজ্ঞায়ন : উইকিপিডিয়া বলছে, আসক্তির সাধারণ সংজ্ঞামতে সেসব বস্তুর ব্যবহার বোঝায় যা গ্রহণ করার পরে রক্ত ও মস্তিষ্কের প্রতিবন্ধক অতিক্রম করে সাময়িকভাবে মস্তিষ্কের রাসায়নিক দ্রব্যের পারিপার্শ্বিক অবস্থা পরিবর্তন করে। উইকিপিডিয়া আরো বলছে, অনেকে এই তালিকায় মানসিক প্রবৃত্তি সৃষ্টিকারী আরো অনেক ধ্রুবকেই অন্তর্ভুক্ত করে থাকেন। এসবেরই মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে আসক্তির এবং সঙ্গে সঙ্গে লজ্জা, অপরাধবোধ, ভয়, নিরাশা, ব্যর্থতা, দুশ্চিন্তা, প্রত্যাখ্যান, উদ্বেগ, ব্যাকুলতা ও হীনম্মন্যতার সৃষ্টি করে।

অন্যদিকে বিকাশপিডিয়া বলছে, আসক্তি একবার ধরলে তার থেকে ছাড়া পাওয়া কঠিন। আসক্তির অর্থের খোঁজে কিছু কথা পাওয়া যায়। যেমন— আসক্তি মানে অনুরাগ, লিপ্সা, সহবাস, ভোগবিলাস ও অভিনিবেশ।

আসক্তির প্রকারভেদ : আসক্তি নানা রকম হতে পারে। স্বাভাবিক জ্ঞান বলছে, সৃষ্টির সূত্র মেনেই প্রতিটি প্রাণের ভেতর নানা রকমের আসক্তি আছে। সৃষ্টির কোনো জ্ঞানী মানুষের ক্ষেত্রে যদি বলা হয়, তবে প্রতিটি মানুষ তার জিনেই অনেক আসক্তি নিয়ে আসে। কেউবা মাদক গ্রহণ করে। কেউ জুয়ায় আসক্ত। কেউ খাদ্য গ্রহণে আসক্ত। কেউ যৌনতায় আসক্ত। কেউবা কম্পিউটারে আসক্ত। অনেকে আবার খেলায় আসক্ত। এভাবেই নানা আসক্তি নিয়ে মানুষ সৃষ্টি এবং ধ্বংস— সব করছে।

মাদকাসক্তি : উইকিপিডিয়া মতে, মাদক বা ড্রাগস হলো বিষধর সাপের ছোবলের মতো যা প্রতিনিয়ত একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে ধীরে ধীরে তার দংশনে নিঃশেষ করে দেয়। যার প্রভাব আমরা আমাদের যুবসমাজে বেশি দেখতে পাই।

জুয়ার আসক্তি : খেলা একটি আনন্দদায়ক বিষয় হলেও সব খেলা আনন্দদায়ক না-ও হতে পারে। যেমন জুয়া খেলা। জুয়া খেলা, খেলা হলেও এটি মূলত খেলার চাইতেও ভিন্ন কিছু। এখানে যেমন রয়েছে ভিন্ন কিছু আচরণ ঠিক তেমনি রয়েছে তার ভিন্ন মাত্রা। জুয়া খেলা এমন একটি খেলা যার সঙ্গে নেশা ও আসক্তির বিষয়গুলো প্রবলভাবে চলে আসে। জুয়া খেলা মানুষের আচার-আচরণ দৈনন্দিক কাজকর্ম সবক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে এবং ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন করতে শুরু করে। হতে থাকে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং অন্য বিষয়গুলো থেকে বিচ্যুতি।

জুয়া এমন একটি খেলা যা আনন্দ বা প্রতিযোগিতার চাইতে আসক্তির দিকে বেশি ঝুঁকে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। এর ফলে দেখা যায় একজন জুয়ায় আসক্ত ব্যক্তি ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে জুয়া খেলাকে বেশি প্রাধান্য দেয়। তৈরি হয় এই খেলার জন্য একটি অসম্ভব ও অনিয়ন্ত্রিত চাহিদার। এদিকে জুয়া খেলা যেহেতু সামাজিকভাবে নেতিবাচক, তাই জুয়ায় আসক্ত ব্যক্তি চেষ্টা করেন তার পারিপার্শ্বিক লোকজন যাতে তার এই আসক্তির কথা জানতে না পারেন। আবার এই কাজটি করতে গিয়ে এবং বিভিন্ন সামাজিক দায়বদ্ধতা এড়াতে গিয়ে একজন জুয়ায় আসক্ত ব্যক্তি প্রায়ই বিভিন্ন প্রতারণার আশ্রয় নেন।

জুয়া খেলায় সাধারণত অর্থনৈতিক লাভের চাইতে এই খেলার উত্তেজনাটাই এর আসক্তির পেছনে প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। তাই দেখা যায় একজন জুয়ায় আসক্ত ব্যক্তি বেশির ভাগ সময় জুয়া খেলার ভাবনা নিয়েই দিন পার করেন এবং বাজির পরিমাণ বাড়াতেও প্রস্তুত থাকেন। এতে আসক্তির সঙ্গে সঙ্গে আসক্ত ব্যক্তি অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অনেকে আবার ব্যক্তিগত সমস্যা, অসহায়ত্ব এবং বিষণ্নতার কারণেও জুয়ায় আসক্ত হন। যার ফলে তার সমস্যা তো মেটেই না বরং সমস্যাগুলো আরো প্রকট আকার ধারণ করে। এর ফলে ধীরে ধীরে নিজেকে লুকানোর পাশাপাশি টাকা পয়সা লুকানো বা চুরির মতো হীন কাজের আশ্রয় নেওয়ার প্রবণতাও লক্ষ করা যায় এবং আসক্ত ব্যক্তি বারবার মিথ্যার আশ্রয় নেয়।

খাদ্যে আসক্তি : কোনো কোনো খাবার খেতে ভালো লাগে আমাদের। এগুলো আমাদের পছন্দের খাবার। আবার কিছু কিছু খাবার আছে যা আমরা খেতে যেমন পছন্দ করি, তেমনি কখনো কখনো সে সব খাবার খেতে আমাদের যেন প্রাণ আনচান করতে থাকে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন একটা খাবার খেতে পছন্দ করা আর কোনো একটা খাবারের প্রতি বিশেষ আসক্তি, সেটা খেতে তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগা আসলে দুটো ভিন্ন বিষয়।

যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কেন্ট বেরিজ বলেছেন, খাবারের এই পছন্দ এবং আসক্তির মধ্যে পার্থক্য থেকে বোঝা যায়, আমাদের মস্তিষ্ক যতটা ভাবা হতো তার চেয়ে বেশি সংবেদনশীল। কোনো খাবার খাওয়া বা পানীয় পান করার সময় আমাদের মস্তিষ্কে স্নায়ু-রাসায়নিকের অভিঘাতে তা আমাদের মধ্যে ভালো লাগা বা খারাপ লাগা তৈরি করে।

সমপ্রতি কিছু ব্রেইন ইমেজিং এবং অতিভোজনের প্রভাব সম্পর্কিত গবেষণায় মানুষের খাদ্যের প্রতি আসক্তি বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন মাদকদ্রব্যে যেমন ব্রেইনের বিভিন্ন অংশ উদ্দীপিত হয়, ঠিক তেমনি অতি সুস্বাদু খাদ্যের ক্ষেত্রেও এই আলোড়ন সৃষ্টি হতে পারে।

যৌন আসক্তি : যৌন আসক্তি হলো নেতিবাচক ফলশ্রুতি সত্ত্বেও যৌন কর্মকাণ্ডে বাধ্যতামূলকভাবে যুক্ত থাকা। চিকিৎসাশাস্ত্রে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে, আসক্তিকে ভুলবশত যৌন নির্ভরশীলতা বলা হয়ে থাকে এবং উপরন্তু এটি একটি মতবাদনির্ভর বিষয়কে নির্দেশ করে যেটি সেসব লোকদেরকে বোঝাতে ব্যবহূত হয়, যারা তাদের যৌনবাসনা, আচরণ এবং এ-সম্পর্কিত চিন্তাচেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম। যৌন আসক্তি-সম্পর্কিত অন্যান্য রোগ নির্ণায়ক যৌন আচরণসমূহ হলো হাইপারসেক্সুয়ালিটি, সমস্যাপ্রবণ ইন্টারনেট, পর্নোগ্রাফি ব্যবহার, ইরোটোম্যানিয়া, নিম্ফোম্যানিয়া, স্যাটাইরিয়াসিস, ডন জুয়ানিজম বা ডন জুয়ানিটিজম এবং প্যারাফিলিয়া-সম্পর্কিত সমস্যাসমূহ।

ইন্টারনেট আসক্তি : মাদকাসক্তি বিষয়টিকে আমরা অনেক গুরুত্ব নিয়ে দেখি। এই আসক্তির কুপ্রভাব ও চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করি, আসক্তকে নিরাময় কেন্দ্রে পাঠাই বা পাঠানোর কথা বলি। কিন্তু বর্তমান সময়ের আশীর্বাদ আসক্তির ফলে অভিশাপ হয়ে তরুণ প্রজন্মের পিছু নিয়েছে। অভিশাপটির নাম ‘ইন্টারনেট আসক্তি’, যা কেড়ে নিচ্ছে তরুণ প্রজন্মের সামাজিক জীবন।

‘ইন্টারনেট আসক্তি’ একেবারেই নতুন সমস্যা। আমাদের দেশ তো দূর, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতেও একে এখনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ইন্টারনেটে আসক্ত ব্যক্তির মস্তিষ্কে ঠিক কী চলে— চিকিৎসাবিজ্ঞান এখনো তা বুঝে উঠতে পারেনি। এখন পর্যন্ত নির্দিষ্ট সংজ্ঞায়ও বাধা যায়নি ইন্টারনেট আসক্তিকে।

ফেসবুক আসক্তি : ইদানীং ফেসবুক আসক্তি নামে নতুন একটি আসক্তি যোগ হয়েছে। এটিকেও ইন্টারনেট আসক্তির মধ্যে ফেলা যায়। তবে অতি জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম হওয়ায় এটিকে নিয়ে আলাদা করে আলোচনা হচ্ছে। ফেসবুক আসক্তি কোকেন আসক্তির মতো বিপজ্জনক হতে পারে। সম্প্রতি এক গবেষণায় এমন তথ্যই উঠে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকরা এ গবেষণা পরিচালনা করেন। সেখানে তারা দেখেন, কোকেনে আসক্তি যে রকম ভয়াবহ কিছু ক্ষেত্রে ফেসবুক আসক্তিও সে রকম। এই গবেষণা প্রতিবেদনটি সাইকোলজিক্যাল রিপোর্টস: ডিজেবিলিটি অ্যান্ড ট্রমা নামক জার্নালে প্রকাশিত হয়।

এই গবেষণায় মূলত ব্যবহারকারীদের ওপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব কতটুকু বা কীভাবে প্রভাব ফেলে তা দেখার চেষ্টা করা হয়। গবেষকরা বিভিন্ন বয়সী ব্যবহারকারীদের ওপর এসব প্রভাব দেখতে চেষ্টা করেন। আর সেখানেই ফেসবুক আসক্তির এই বিষয়টি উঠে আসে। গবেষণা প্রতিবেদনে গবেষকরা উল্লেখ করেন, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উদ্ভব ব্যবহারকারীদের বিশেষ করে অল্পবয়সী ব্যবহারকারীদের সমাজ থেকে পৃথক করে দিচ্ছে। এছাড়া তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি একা হয়ে যাচ্ছে। আর এই আসক্তি অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চেয়ে ফেসবুকের ক্ষেত্রে বেশি। যারা ফেসবুক আসক্তিতে ভুগছেন তাদের পুনর্বাসনের জন্য কাউন্সেলিং খুবই জরুরি বলে মনে করছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা।

শেষ কথা : আসক্তির খারাপ দিকটির কথা বলা হয়েছে। মূলত আসক্তি কথাটিই খারাপ অর্থে বেশি ব্যবহার হচ্ছে। ভালো আসক্তি হতে পারে পাঠ আসক্তি। তাকে অবশ্য পাঠাভ্যাস বলা যায়। এই অভ্যাস যখন কিছুই মানবে না তখন তা আসক্তি হয়ে যায়। আর ব্যতিক্রম বাদ দিলে আসক্তি ক্ষতিই বয়ে আনে। এছাড়া খেলা, টেলিভিশন দর্শন, ফোনালাপ, কেনাকাটা, ধর্ম পালন ইত্যাদি নানা আসক্তি আছে। এ সবকিছু যখন পালন করা হয়, তখন তাকে অভ্যাস বলা যায়। আর তা যখন মাত্রার বাইরে চলে যায় তখন তা আসক্তিতে রূপ নেয়।

এভাবেই যেকোনো আসক্তি মন্দ দিকে ধাবিত করছে মানুষকে, সময়কে। আমরা তাই অভ্যাসের বদলে আসক্ত যেন না হই। সবশেষে বলা যায় আসক্তি একধরনের রোগ। একে বাড়তে দেওয়া ঠিক হবে না। সময় থাকতেই এর লাগাম ধরা উচিত সবার।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

raihanullah12@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads