• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

ফেসবুকের অপব্যবহার এবং আমাদের করণীয়

  • প্রকাশিত ০২ ডিসেম্বর ২০১৯

নিউটনের দ্বিতীয় সূত্রমতে, ‘প্রত্যেকটি ক্রিয়ার বিপরীত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে।’ নিউটনের এই সূত্র ফেসবুকের ক্ষেত্রে অনেক বেশি কার্যকর। মার্ক জাকারবার্গের হাতে জন্ম নেওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বৃহত্তম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে ফেসবুকের যেমন প্রচুর সুবিধা আছে, তেমনি এর নির্বিচার ব্যবহারের কারণে প্রচুর অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে মানুষকে। নানাভাবে ফেসবুকের অপব্যবহার করা হচ্ছে। ফেসবুকের নৈতিক ব্যবহার খুব কমই চোখে পড়ে বরং এর অনৈতিক ব্যবহারের বাহুল্য দেখে আমরা ভয়ার্ত ও সন্ত্রস্ত। বর্তমান বিশ্বের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তুমুল জনপ্রিয় মাধ্যম হচ্ছে ফেসবুক, যার ভার্চুয়াল নেটওয়ার্ক বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১০০ কোটি মানুষ ব্যবহার করছে। ফেসবুক নামক সর্বাধিক ব্যবহূত ওয়েবসাইটে দিন দিন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ফেসবুক ব্যবহারের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে অবস্থানরত অন্যদের সঙ্গে কম খরচে সহজে যোগাযোগ করা যায়। সারা বিশ্বের সব খবর মুহূর্তে হাতের মুঠোয় চলে আসে। হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের খুঁজে পেতে ফেসবুক একটি দারুণ প্লাটফর্ম। ফেসবুকের কারণে নিজেকে সহজে প্রকাশ করা যায়। যেকোনো খবরাখবর মুহূর্তে একই সঙ্গে অনেকজনের কাছে পৌঁছানো সহজও বটে।

ফেসবুক ব্যবহারে কিছু সুবিধা পেলেও এর অপব্যবহারের কারণে নানা অপ্রীতিকর, অনাকাঙ্ক্ষিত এবং দুঃখজনক ঘটনাও ঘটছে। ফেসবুক আমাদের জীবন থেকে কোয়ালিটি সময় কেড়ে নিচ্ছে। ফেসবুক-আসক্তি বর্তমানে মারাত্মক নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যাকে অনেকেই কোকেন আসক্তির সঙ্গে তুলনা করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তরুণদের মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। ফেসবুকের মাধ্যমে পরিকল্পিত গুজব ছড়িয়ে পড়ছে, যার কারণে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সংঘটিত হয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতেও দেখা যাচ্ছে। ইদানীং ধর্মকে কেন্দ্র করে সংঘটিত প্রায় প্রতিটি সহিংস ঘটনার সবগুলোই ফেসবুক থেকে দেওয়া পোস্টের মাধ্যমেই হয়েছে এবং এই গুজবের সূত্র ধরে ঘটেছে। ফেসবুকের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে ছড়ানো গুজব এতটাই শক্তিশালী যে, সাইবার অপরাধকে বড় হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। ফেসবুক ব্যবহার করে বিভিন্ন ভর্তি পরীক্ষাসহ বোর্ড পরীক্ষাগুলোতে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগও আছে। কথিত যে, ফেসবুক মেসেঞ্জারের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ছড়ানো হয়।

নকল আইডি তৈরি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের  বিভিন্ন গ্রুপে বিকৃত যৌনচর্চা চলছে। নারীর বিরুদ্ধে নানাভাবে ফেসবুকের অপব্যবহার আমাদের সমাজকে বিকৃত, বিতর্কিত এবং কলুষিত করে চলেছে। বিশ্বজুড়ে ফেসবুক ব্যবহারকারী নারীদের হয়রানির মাত্রা ক্রমশ বাড়ছে। হিসাব অনুযায়ী, আমাদের দেশের অনলাইন ব্যবহারকারী ৭০ শতাংশ নারীই কোনো না কোনোভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, টিনএজ নারীদের ক্ষেত্রে হয়রানি হওয়ার অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে সমাজের এমন সব ঘটনা সামনে নিয়ে আসছে যা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। একে অন্যের ব্যক্তিগত তথ্যাবলি সবার সামনে তুলে ধরায় প্রাইভেসি বলতে কিছুই আর থাকছে না। অনেক নারী নিরাপত্তার ভয়ে ফেসবুকের ব্যবহারকে বিসর্জন দিতে বাধ্য হচ্ছে।

ফেসবুক কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিতে প্রস্তুত থাকলেও কিছু খারাপ ব্যবহারকারী নকল ছবি, নকল তথ্য দিয়ে নকল ফেসবুক আইডি তৈরি করে অন্যের গোপন খবর ছড়িয়ে দিয়ে ওই ব্যক্তির ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নষ্ট করছে। এতে করে ভুক্তভোগী ব্যক্তি সামাজিক মর্যাদা হারানোসহ সমাজে বিতর্কিত মানুষ হিসেবে মূল্যায়িত হচ্ছেন। দেশের বাইরে অবস্থান করে অনেক ভুয়া আইডি থেকে অপপ্রচার করা হয়। এতে জনমনে নানা শঙ্কার জন্ম দিচ্ছে। ব্যক্তি নিরাপত্তা বজায় রাখতে হলে ফেসবুকের অপব্যবহার বন্ধের ব্যাপারে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। ফেসবুকের অপব্যবহার রোধ করতে ব্যক্তি সচেতনতা ও আইনের কঠোর প্রয়োগ একান্ত আবশ্যক। আর এ কারণেই বর্তমান সময়ে এসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োজন অত্যাবশ্যক হয়ে উঠেছে। সে জন্যই দেশে দেশে তৈরি হচ্ছে যুগোপযোগী আইসিটি আইন।

ফেসবুক অপরাধ দমন করার জন্য বাংলাদেশেও পুলিশ সদর দপ্তর থেকে দেশব্যাপী পুলিশের ১০০টি সাইবার টিম গঠন করা হয়েছে। প্রত্যেক টিমে ৫ জন করে সদস্য রয়েছেন। সাইবার অপরাধ দমনে কিছু উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। আরো কিছু প্রযুক্তি আমদানি করা হবে। ভুয়া ফেসবুক পেজ ও গ্রুপ চিহ্নিত করা এবং এদের অ্যাডমিনদের আইনের আওতায় আনতে হবে। সাইবার পুলিশদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে প্রতিনিয়ত সাইবার টহল জোরদার রাখতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের ক্ষতিকারক কিছু পেলে এগুলোর বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নিতে হবে। আশার কথা সাইবার পুলিশ কর্তৃক অপরাধী শনাক্তকরণে নানা ধরনের উন্নত মানের সফটওয়্যার ও ডিভাইস ব্যবহার করা হচ্ছে। সাইবার অপরাধীর জন্য নির্ধারিত সাজার সঠিক প্রয়োগে অপরাধ কমে আসবে।

প্রত্যেক ফেসবুক ব্যবহারকারীর জন্য সরকার নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। সরকারিভাবে প্রণীত এই নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোনো সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে বা ধর্মনিরপেক্ষ নীতি পরিপন্থি কোনো কনটেন্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না। জনমনে অসন্তোষ বা অপ্রীতিকর মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে এমন কনটেন্ট প্রকাশ করতে পারবে না। বাংলাদেশে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যমূলক বা হেয় প্রতিপন্নমূলক কনটেন্ট প্রকাশ করা যাবে না। কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রকে হেয়প্রতিপন্ন করে এবং লিঙ্গবৈষম্য বা এ-সংক্রান্ত বিতর্কিত কোনো কনটেন্ট প্রকাশ করা যাবে না।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাকাউন্ট পরিচালনায় ব্যক্তিগত ছবি ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে। বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ৮০ শতাংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার করে। সরকারি বিভিন্ন  নীতিমালা থাকলেও এর কার্যকারিতা নেই। ফেসবুকের অপব্যবহার রোধ করতে হলে সামাজিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণের পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে ফেসবুক ব্যবহারকারীকে সচেতন থাকতে হবে।

শাহীন চৌধুরী ডলি 

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads