• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
বিজয় আমাদের চেতনা

সংগৃহীত ছবি

মতামত

বিজয় আমাদের চেতনা

  • প্রকাশিত ০৭ ডিসেম্বর ২০১৯

৪৭ বছর পর হানাদারমুক্ত দেশ ও দেশের যে শব্দটির মর্মার্থ অনুধাবন করতে পেরে মানবজীবন, পুত্র-পরিজন, প্রেমময়ী স্ত্রী, ধন-ঐশ্বর্য সবই তুচ্ছ জ্ঞান করেছে, সে শব্দটি হচ্ছে ‘স্বাধীন’ বা ‘মুক্ত’। এই নামের মধ্যে কী মাহাত্ম্য রয়েছে, এটা পেলে কী পাওয়া যায়, আর না পেলেই বা কী হারায়? একটা দেশ, জাতি অথবা জনসমষ্টি তখনই বিদ্রোহ করে যখন তারা পদে পদে লাঞ্ছিত, অপমানিত এবং তাদের ন্যায্য দাবি থেকে বঞ্চিত হয়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে রায় দুর্লভ, উমিচাঁদ, জগৎ শেঠের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ে স্বাধীনতার সূর্য অস্ত যাওয়ার পর থেকে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের লক্ষ্যে। ফলে আজকের বাংলাদেশ।  

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যে সংগ্রামী চেতনা এবং দৃঢ় সংকল্প নিয়ে প্রতিটি সংগ্রাম-আন্দোলন পরিচালনা হয়েছে, যে সংগ্রাম করতে গিয়ে আমাদের লক্ষ লক্ষ জীবন কোরবানি দিতে হয়েছে, রক্তে বয়ে গেছে নদী-রাজপথ; মা-বোনেরা দিয়েছেন ইজ্জত, স্বামী, সন্তান; সেই সংগ্রামী চেতনা আজ যেন স্তিমিত-অস্তমিত। কেন আজ আমাদের পলায়নী মনোবৃত্তি? আজ দেশের মানুষ বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিবিদ-কবি-সাহিত্যিক-শিক্ষকগণ এত বেশি পরশ্রীকাতর আর হিংসায় উন্মত্ত যে, অবস্থাদৃষ্টে তাদের করুণা করা ছাড়া আর কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। দেশ জাতিকে তারা করেছে তাদের ব্যবসার মূলধন। অথচ দেশ জাতিকে যাদের দেওয়ার কথা সর্বাধিক, যাদের কাছ থেকে পাওয়ার আশায় জাতি অধীর প্রত্যাশায় উন্মুখ; তখন দেশপ্রেমের উপয়ন আর রামাবলিও ওড়না গায়ে চাপিয়ে নিজেদের উদর স্ফীত আখের গোছানো এবং পরস্পর পরস্পরের প্রতি পেশিশক্তিকে লেলিয়ে দিয়ে কাদা ছোড়াছুড়িতে লিপ্ত দেশের মানুষ। আজ আগুন, বোমা, বন্দুক, হকিস্টিক, কিরিচ পেশাশক্তিদের মূলধন। যত বেশি কাদা ছুড়তে আর গল্পবাজিতে যে যত বেশি পারঙ্গম; প্রতিপক্ষকে যেভাবে হোক ঘায়েল করতে যে ক্ষিপ্র গতিতে আগে পারবে, তারই হবে কেল্লা ফতে। এইসব করে আমরা চারিত্রিক ও জাতিগতভাবে বিশ্বের কাছে কোথায় নেমে গেছি বা যাচ্ছি সেদিকে কোনো তোয়াক্কাই করছি না। এতে কি আমরা শত্রু হননের নামে আত্মহননের পথ প্রশস্ত করছি না? 

জাতীয় চরিত্রের অবক্ষয় আজ চূড়ান্ত পর্যায়ে নেমে গেছে বললে মোটেই বেশি বলা হবে না। জাতি যে আজ চরম হতাশার সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে এটা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, আইন-শৃঙ্খলা, বিচার ব্যবস্থা, নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থা, শিক্ষা ও পরীক্ষা ব্যবস্থাসহ সব ক্ষেত্রেই এক ধ্বংসোন্মুখী ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বেকার সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে। খুনখারাবি, রাহাজানি, গুম, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, জালিয়াতি, চোরাচালানিসহ সকল প্রকার ঘুষ ও দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে এমন কঠিনভাবে শিকড় গেড়ে বসেছে যে, আপাতত তার বিরুদ্ধে কিছু করা তো দূরের কথা, কিছু বলতে যাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ। তাই যদি না হবে, তবে দেশজুড়ে কেন আজ আত্মবঞ্চনার করুণ মূর্ছনা তা কান পাতলেই শোনা যায়! যে সফল রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সংগ্রামে অর্জিত বিজয়, সে বিজয়ের সঠিক মূল্যায়ন ও বাস্তবায়ন করতে চাইলে আমাদের আত্মশুদ্ধি ও আত্মচেতনার উন্মেষ ঘটাতে হবে। সেদিনের মতোই আমাদের বিপ্লব করতে হবে নৈতিক অবক্ষয় আর চারিত্রিক অধঃপতনের বিরুদ্ধে। যে আত্মচেতনা নিয়ে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জন হয়েছে বিজয়, সেই অমূল্য সম্পদের স্বকীয়তা সমুন্নত রাখতে হলে আমাদের আত্মসমালোচনা, আত্মশুদ্ধি এবং আত্মসংশোধনের সংগ্রামে সমুজ্জ্বল হতে হবে।  

কারণ একথা আমাদের অন্তরের অন্তস্তল থেকে অনুধাবন করতে হবে যে, রক্তস্নাত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জন হয়েছে, সেই শরাবন তহুরা পরিতৃপ্তি সহকারে আস্বাদন করতে হলে আমাদের সার্বিক ক্ষেত্রে অবশ্যই উন্নতি বিধান করতে হবে। আর তাই তো দেরিতে হলেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন, তাকে দেশবাসী সাধুবাদ জানায়। জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ পালন এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে আমাদের স্বাধীনতার মূলমন্ত্রর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়াই হবে প্রধান কাজ। যার প্রথম শর্ত চরিত্র গঠন ও শিক্ষা। আমরা যদি লৌহ কঠিন দৃঢ়তা এবং অসীম মনোবলের অধিকারী চারিত্রিক ও শিক্ষার ক্ষেত্রে না হতে পারি তবে উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশের ও জাতির স্বার্থে, সমাজের স্বার্থে এবং সর্বোপরি নিজের জন্যও আমাদের আত্মবিস্মৃতি আর লক্ষ্যচ্যুতি পরিহার করতে পারলেই ঈপ্সিত শিক্ষা-শান্তি-প্রগতি-কৃষ্টি সাংস্কৃতির সার্বিক উন্নতি সাধিত হবে। তবেই বিশ্বের দরবারে আমরা নিজেদের সভ্য জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব।  

হাদিউল হৃদয়

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads