• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
পাঁচ শতাংশেই সর্বনাশ

ফাইল ছবি

মতামত

পাঁচ শতাংশেই সর্বনাশ

  • মহিউদ্দিন খান মোহন
  • প্রকাশিত ০৭ ডিসেম্বর ২০১৯

পুলিশ বিভাগে কর্মরত সদস্যদের মধ্যে মাত্র পাঁচ শতাংশের দুর্নীতি-দুষ্কর্মের জন্য গোটা বাহিনীর বদনাম হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন মহামান্য হাইকোর্ট। গত ২ ডিসেম্বর একটি রিট আবেদনের শুনানিকালে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।

খবরে বলা হয়েছে, গত ২৭ জুন রাত ১১টার দিকে সোনালী ব্যাংক মতিঝিল শাখার কর্মকর্তা ইব্রাহীম খলিল তার এক নারী সহকর্মীসহ উত্তরার ভূতের আড্ডা রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খেয়ে আসার পথে নেমপ্লেটহীন একজন পুলিশ কনস্টেবল তাদের উত্তরা থানার এএসআই মোস্তাফিজুর রহমানের কাছে নিয়ে যান। উপস্থিত চার-পাঁচজন পুলিশ ইব্রাহীম খলিলকে টেনে-হিঁচড়ে থানায় নিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। পরে তারা ইব্রাহীম খলিলের কাছে ২০ হাজার টাকা দাবি করে এবং ওই নারী কর্মকর্তাকে বলা হয় এএসআই মোস্তাফিজকে ‘একান্তে’ কিছু সময় দিতে। এরপর তাদের কাছ থেকে ছয় হাজার টাকা রেখে নারী কর্মকর্তাকে একান্তে সময় কাটানোর শর্তে তারা ছেড়ে দেয়। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ ইব্রাহীম খলিল ও তার নারী সহকর্মী পুলিশের আইজি বরাবরে উক্ত এএসআই ও পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। কিন্তু দীর্ঘদিনেও ওই পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় প্রতিকার চেয়ে গত ২৫ জুলাই তারা হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। গত ২ ডিসেম্বর সে রিট আবেদনের শুনানিকালে বেঞ্চ ওই মন্তব্য করেন। আমাদের পুলিশ বাহিনীর কতিপয় সদস্যের অনৈতিক কর্মকাণ্ড নতুন কোনো বিষয় নয়। ঘুষ-দুর্নীতি তো আছেই। এমনকি পেশাদার অপরাধীর মতো তারা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, খুন, গুম, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসায়, অর্থ আদায়ের জন্য নিরীহ মানুষকে নানা ধরনের মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া এবং সন্ত্রাসী-অপরাধীদের সহযোগিতাসহ নানা অপকর্মে পুলিশের নাম জড়িয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত এ-সংক্রান্ত খবরগুলোর দিকে চোখ রাখলে পরিস্থিতির ভয়াবহতায় আঁতকে উঠতে হয়।

অতিসম্প্রতি যে পুলিশ কর্মকর্তাটির অপকর্ম সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল তিনি এসপি হারুন-অর রশিদ। মহাপরাক্রমশালী এ পুলিশ কর্মকর্তা মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এক হরতালের দিনে নবম জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ ও বিএনপি নেতা জয়নাল আবদীন ফারুককে প্রহার করে। সেদিন টিভি খবরে সে দৃশ্য দেখে অনেকেই শিউরে উঠেছিলেন। একজন পুলিশ কর্মকর্তা কী করে সাহস পায় একজন আইনপ্রণেতার গায়ে হাত তুলতে-এটা ভেবে সবাই বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়েছিলেন। ওটাও ছিল এসপি হারুনের একটি অপরাধ। কিন্তু সে অপরাধের জন্য তাকে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয়নি, কোনো শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি। বরং ডিএমপির একটি জোনের উপকমিশনার থেকে পোস্টিং পেয়েছিলেন গাজীপুর জেলা পুলিশ সুপার হিসেবে। তারপর বদলি হয়ে যান নারায়ণগঞ্জে। সেখানে গিয়ে তিনি আরো বেপরোয়া হয়ে ঝামেলা বাধিয়ে ফেলেন সরকার দলীয় স্থানীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের সঙ্গে। এসপি হারুন ও এমপি শামীম ওসমানের দ্বন্দ্বের খবর গণমাধ্যমেও উঠে আসে। গত মাসে এসপি হারুন তার লম্বা হাত প্রসারিত করেন দেশের বৃহৎ একটি শিল্প পরিবারের দিকে। ওই শিল্পপতির কাছে আট কোটি টাকা চাঁদা দাবি ও সে টাকা যুক্তরাষ্ট্রের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা করার নির্দেশ দেন তিনি। কিন্তু সে শিল্পপতি তা দিতে অস্বীকার করায় এক রাতে তার স্ত্রী-সন্তানকে ঢাকার বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যান এসপি হারুন তার নিজস্ব বাহিনী দিয়ে। এ ঘটনায় কপাল পোড়ে এসপি হারুনের। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এসপি হারুনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলে তাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রত্যাহার করে হেড কোয়ার্টারে ক্লোজড করা হয়। তার বিরুদ্ধে এখন তদন্ত চলছে। এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধে উঠেছে আরেক অভিযোগ। যে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে কানেকশনকে ব্যবহার করে এসপি হারুন ক্ষমতার দম্ভে ধরাকে সরা জ্ঞান করতেন, সে দল থেকেই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে। গত ২২ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সাইফুদ্দিন আহমেদ দুলাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন যে, এসপি হারুন তার কাছে পাঁচ কোটি টাকা চেয়েছিলেন। সে টাকা না দেওয়ায় সাজানো ও মিথ্যা মাদক মামলায় তাকে ফাঁসিয়েছেন এসপি হারুন।

 পুলিশের পদ-পদবি, পোশাক আর ক্ষমতাকে ব্যবহার-অপব্যবহার করে কতিপয় পুলিশ সদস্য এ ধরনের ন্যক্কারজনক কাজ প্রতিনিয়তই ঘটিয়ে চলেছে। সেসব ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ-প্রচার হওয়ায় পুলিশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখানে সেসব খবরের কয়েকটি তুলে ধরছি। গত ৭ নভেম্বর আমাদের সময়ের একটি সচিত্র খবরে দেখা যায়, নারায়ণগঞ্জ-সিদ্ধিরগঞ্জ সড়কে একটি মাইক্রোবাসে টাকার বান্ডেলের ওপর হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে ক্লান্ত এক পুলিশ কর্মকর্তা। ‘ডিবি পুলিশ’ লেখা ওই মাইক্রোবাসে বিশ্রামরত কর্মকর্তাটি হলেন এসআই আরিফ; যিনি সাবেক এসপি হারুনের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। এসআই আরিফের টিম নিরীহ-নিরপরাধ মানুষদের ধরে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে টাকা হাতিয়ে নিত। সংবাদ প্রকাশের পর এসআই আরিফের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না জানা যায়নি। একই পত্রিকার ২৩ নভেম্বর সংখ্যায় ‘পুলিশ যখন ভাড়াটে অপহরণকারী’ শীর্ষক খবরে বলা হয়েছে, গত ১১ নভেম্বর দুবাই থেকে দেশে ফেরত আসা সামসুদ্দোহা নামে একজন যাত্রীকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে থেকে বের হওয়ার সময় আটক করেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। ওই ব্যক্তি চিৎকার ধস্তাধস্তি শুরু করলে বিমানবন্দরে কর্তব্যরত আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তারা যাত্রী সামসুদ্দোহা ও অপহরণ চেষ্টাকারী হাবিবুর রহমান, মো. আলমগীর শেখ ও সিআইডির এএসআই জহির রায়হানকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসে। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, সামসুদ্দোহা দুবাই থেকে বারো পিস স্বর্ণের বার নিয়ে ফিরছিলেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী স্বর্ণপাচারকারী গ্রুপের সদস্য হাবিবুর রহমান ও আলমগীর শেখ তাকে অপহরণের জন্য সিআইডির চার সদস্য এসআই মো. জুয়েল, এসআই রেজাউল করিম, এএসআই জহির রায়হান ও কনস্টেবল আবু জাফর হাওলাদারকে ভাড়া করেন। ধস্তাধস্তির সময় জহির বাদে সিআইডির অপর সদস্যরা কেটে পড়েন। তবে সিসিটিভি ফুটেজে অপহরণ চেষ্টার ঘটনা ধরা পড়ে। সেই সঙ্গে সিআইডির ওই চার সদস্যের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগেরও সত্যতা মিলেছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মেয়াদে পদাবনতি ও পদোন্নতি রহিতকরণসহ বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার খবর পাওয়া গেছে। গত ৬ আগস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত হয় খুলনার জিআরপি থানার ওসি উছমান গণি পাঠানসহ পাঁচ পুলিশ সদস্য মিলে এক তরুণীকে গণধর্ষণের খবর। ১৯ সেপ্টেম্বরের সমকালের একটি খবরের শিরোনাম ছিল, ‘পাঁচ পুলিশের ইয়াবাকাণ্ড’। খবরে বলা হয়, ১১ সেপ্টেম্বর গুলশান গুদারাঘাট এলাকার চেকপোস্টে ৫০০ পিস ইয়াবাসহ এক ব্যক্তিকে ধরেন দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা। কিন্তু টাকার বিনিময়ে ইয়াবা রেখে তাকে ছেড়ে দেন। ১৫ সেপ্টেম্বর ইয়াবা ভাগবাটোয়ারার সময় পুলিশের অপর একটি টিমের হাতে ধরা পড়ে উল্লিখিত পাঁচজন। গত ১ অক্টোবরের পত্রিকাগুলোতে খবর বেরোয়, এক তরুণীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনকারী রাজধানীর পল্টন থানার ওসি মাহমুদুল হককে সাসপেন্ড করার খবর। ওসি তরুণীর সঙ্গে দীর্ঘ দেড় বছর ধরে অনৈতিক সম্পর্ক চালিয়ে আসছিলেন। এতে ওই তরুণী গর্ভবতী হয়ে পড়েন। তরুণী বিয়ের জন্য চাপ দিলে ওসি যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। পরে ওই তরুণীর অভিযোগের তদন্ত করে সত্যতা পাওয়ায় ওসিকে সাসপেন্ড করা হয়। কোটি টাকার সুবিধা নিয়ে একটি পক্ষকে বাড়ি দখলে সহযোগিতা করার অপরাধে ডিএমপির ডিসি ইব্রাহীম খানকে সাসপেন্ড করার খবর বেরোয় ২৭ আগস্টের পত্রিকাগুলোতে। এ রকম উদাহরণ দিতে গেলে নিবন্ধের কলেবর বেড়ে যাবে। অনৈতিক এবং নেতিবাচক কাজকর্মের কারণে আমাদের পুলিশ বাহিনীর সংবাদ শিরোনাম হওয়া এখন নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনা। কখনো পাওয়া যায় কারা ডিআইজির বাসায় ৮০ লাখ টাকা পাওয়ার খবর, কখনো পাওয়া যায় জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ডিআইজির সাসপেন্ড হওয়ার খবর। এসব নেতিবাচক খবরের কারণে পুলিশের ভালো কাজগুলোর খবর চাপা পড়ে যায়।

পুলিশের কাজ দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন। কিন্তু হতাশার বিষয় হলো, এই বাহিনীটির একটি অংশ উল্টো কাজ করে চলেছে। ফেনীর মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত হত্যার ঘটনায় সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের ন্যক্কারজনক ভূমিকার কথা সবার জানা। নৈতিকতার কতটা অধঃপতন হলে থানার ওসির মতো একটি দায়িত্বশীল পদে থেকে একজন লোক ওই রকম ঘৃণ্য কাজে প্রবৃত্ত হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। অবশ্য স্বস্তির বিষয় হলো, ওসি মোয়াজ্জেম তার কৃতকর্মের যথোপযুক্ত সাজা পেয়েছেন। তবে এ রকম অনেক মোয়াজ্জেমই ছড়িয়ে আছেন সারা দেশে, পুলিশের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায়। তাদের কেউ কেউ ধরা পড়ে, বাকিরা থাকে নিরাপদেই। সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম না হলে ওইসব বিষয় নিয়ে ভেবে কেউ সময় নষ্ট করতে চান না। একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে অনেক আগেই। কোনো পুলিশ সদস্য অপকর্ম করলে তাকে বাঁচাতে অপরাপর সদস্যরা জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করেন।

ওসি মোয়াজ্জেমের বেলায়ও আমরা সে ধরনের অপচেষ্টা হতে দেখেছি। কিন্তু মিডিয়ায় প্রকাশ হয়ে পড়ায় মোয়াজ্জেমের শুভাকাঙ্ক্ষীরা সুবিধা করতে পারেননি। বিষয়টি যে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের গোচরীভূত হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় গত সেপ্টেম্বর মাসে সদর দপ্তর থেকে পাঠানো এক চিঠি থেকে। সারা দেশে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে নীতিবহির্ভূত কাজে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেলে দ্রুত তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে এবং বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। চিঠিতে পুলিশ সদস্যদের ঘুষ-দুর্নীতি ঠেকাতে শূন্য সহনশীলতা বা জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের এ নির্দেশনামা কতটা পালিত হবে জানি না। তবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের এ ব্যাপারে ত্বরিত পদক্ষেপ নেওয়া অতীব জরুরি।   যেমন এক বস্তা আলুর কয়েকটিতে পচন ধরলে তা দ্রুত সরিয়ে না ফেললে তা পুরো বস্তায় ছড়িয়ে পড়ে সর্বনাশ ঘটায়, তেমনি দুর্নীতি-অপরাধে সম্পৃক্ত পুলিশ সদস্যদের দ্রুত অপসারণ করেই কেবল জনসম্পৃক্ত এ বাহিনীটির ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার সম্ভব।

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads