• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
রক্তে অনুরণন তোলে যে ভাষণ

ফাইল ছবি

মতামত

রক্তে অনুরণন তোলে যে ভাষণ

  • সোহেল অটল
  • প্রকাশিত ০৭ মার্চ ২০২০

একটি ভাষণ কীভাবে ইতিহাস হয়ে ওঠে, কীভাবে হয়ে ওঠে একটি জাতির মুক্তির মন্ত্র তা আমরা জানি। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ভাষণ এখনো বাঙালিকে উদ্বেলিত করে। এখনো অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রেরণা দেয়।

৭ মার্চ ১৯৭১। এদিন বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন রেসকোর্স ময়দানে। সারা জাতি অধীর অপেক্ষায় আছে নেতার দিকনির্দেশনা শোনার জন্য। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আবালবৃদ্ধবনিতা জড়ো হয়েছে রেসকোর্সের ময়দানে। তারা তাদের নেতাকে এক পলক দেখতে চায়। নেতার কাছ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে চায়। ঢাকার সব রাজপথ গিয়ে মিশেছে রেসকোর্সে। লাখ লাখ নারী-পুরুষের পদভারে এবং স্বাধীনতার গগনবিদারী স্লোগানে ঢাকা নগরী প্রকম্পিত। যারা রেসকোর্সে আসতে পারেনি তারা ব্যস্ত হয়ে রেডিওর নব ঘোরাচ্ছে ঘরে, চায়ের দোকানে, যে যেখানে আছে সেখানেই। ঢাকা বেতার থেকে ভাষণটি সরাসরি সম্প্রচারের কথা থাকলেও সামরিক কর্তৃপক্ষ তা পণ্ড করে দেয়। পরে বেতারকর্মীদের চাপের মুখে বাধ্য হয়ে ৮ মার্চ সকালে ভাষণটির ধারণকৃত অংশ সম্প্রচার করা হয় বেতারে।

সমাবেশ মঞ্চে আসতে নেতার দেরি হচ্ছিল। কারণ রুদ্ধদ্বার বৈঠকে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে আলাপ চলছিল। এই সময়ে ছাত্রলীগ নেতারা মঞ্চ থেকে একের পর স্লোগান দিয়ে পুরো ময়দান উদ্বেলিত করে রাখেন। স্লোগানগুলো ছিল এ রকম- ‘তোমার দেশ আমার দেশ-বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা-শেখ মুজিব শেখ মুজিব’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো-বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ এবং ‘জয় বাংলা’।

অবশেষে বেলা ৩টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু সমাবেশ মঞ্চে হাজির হন এবং তার ঐতিহাসিক ভাষণ শুরু করেন। দীর্ঘ ১৮ মিনিটের এই ভাষণে তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা দেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

ওই ভাষণে তিনি বেশ কয়েকটি কর্মসূচি ও দাবি পেশ করেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রভাবশালী সরকারসমূহ ও বিশ্ব-সম্প্রদায় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিল। আন্তর্জাতিক সব সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি ঢাকায় উপস্থিত থেকে ভাষণের বিবরণ দিয়েছেন। ‘নিউজউইক’ সাময়িকীর বিখ্যাত রিপোর্ট, যেখানে বঙ্গবন্ধুকে উল্লেখ করা হয়েছিল ‘পোয়েট অব পলিটিকস’ হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের কাছেই নয়; বিশ্বনেতৃবৃন্দ ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী গণমাধ্যমেও একটি যুগান্তকারী দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়েছে।

১৯৭৪ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী শন ভ্যাকব্রাইড বলেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন, কেবল ভৌগোলিক স্বাধীনতাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন মানুষের মুক্তি। বেঁচে থাকার স্বাধীনতা। সাম্য ও সম্পদের বৈষম্য দূর করাই স্বাধীনতার সমার্থ। আর এ সত্যের প্রকাশ ঘটে ৭ মার্চের ভাষণে।’

অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘তিনি ছিলেন মানবজাতির পথপ্রদর্শক। তাঁর সাবলীল চিন্তাধারার সঠিক মূল্য শুধু বাংলাদেশ নয় সমস্ত পৃথিবীও স্বীকার করবে।’

পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত সিপিএম নেতা ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছেন, ‘৭ মার্চের ভাষণ একটি অনন্য দলিল। এতে একদিকে আছে মুক্তির প্রেরণা, অন্যদিকে আছে স্বাধীনতার পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা।’

কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছেন, ‘৭ মার্চের শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুধু ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল।’

মার্শাল টিটো বলেছেন, ‘৭ মার্চের ভাষণের তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, এই ভাষণের মাধ্যমে শেখ মুজিব প্রমাণ করেছেন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানিদের কোনো রকম বৈধতা নেই। পূর্ব পাকিস্তান আসলে বাংলাদেশ।’

দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, ‘৭ মার্চের ভাষণ আসলে স্বাধীনতার মূল দলিল।’

ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বলেছেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চিরজাগরূক থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা।’

একই সঙ্গে বিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যমেও বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের অনেক বিশ্লেষণ হয়েছে। নিউজউইক পত্রিকার নিবন্ধ ‘দ্য পয়েট অব পলিটিকস’-এ বলা হয়েছে, ‘৭ মার্চের ভাষণ কেবল একটি ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য কবিতা। এই কবিতার মাধ্যমে তিনি রাজনীতির কবি হিসেবে স্বীকৃতি পান।’

১৯৯৭ সালে টাইম ম্যাগাজিনে বলা হয়েছে, ‘শেখ মুজিব ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমেই আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ওই ভাষণে গেরিলাযুদ্ধের কৌশলও ছিল।’

বিবিসি-১৯৭১ : ‘পৃথিবীর ইতিহাসে জন আব্রাহাম লিঙ্কনের গেটিসবার্গ ভাষণের সঙ্গে তুলনীয় এই ভাষণটি। যেখানে তিনি একাধারে বিপ্লবী ও রাষ্ট্রনায়ক।’

থমসন রয়টার্স-১৯৭১ : ‘বিশ্বের ইতিহাসে এরকম আরেকটি পরিকল্পিত এবং বিন্যস্ত ভাষণ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে একই সঙ্গে বিপ্লবের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে দেশপরিচালনার দিকনির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।’ একই সালে এএফপি বলেছে, ‘৭ মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বাঙালিদের যুদ্ধের নির্দেশনাও দিয়ে যান। ওইদিনই আসলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।’

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে এমন কথা আরো অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় এই ভাষণের প্রভাব ও গুরুত্ব এতটাই ছিল যে ইউনেস্কো এটাকে ‘দ্য পার্ট অব ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে লিপিবদ্ধ করে।

এখনো বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ বাঙালির রক্তে অনুরণন তোলে। এখনো ৭ মার্চের ওই ভাষণ বাঙালির অনুপ্রেরণা। এখনো ওই ভাষণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মন্ত্র।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads