• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
বিরোধী দল গঠন রীতিতে অস্পষ্টতা

জাতীয় সংসদ

সংরক্ষিত ছবি

সংসদ

বিরোধী দল গঠন রীতিতে অস্পষ্টতা

  • সাঈদ আহমেদ
  • প্রকাশিত ০৬ জানুয়ারি ২০১৯

‘বিরোধী দল’ নিয়ে জটিলতায় পড়েছে একাদশ জাতীয় সংসদ। বিরোধী দল হওয়ার মতো আপাতত ‘যোগ্য’ কোনো দল পাওয়া যাচ্ছে না এ সংসদে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত সংসদেও কার্যকর অর্থে কোনো বিরোধী দল ছিল না। এবারো হয়তো থাকবে না। এতে সরকার এবং সংসদের ভেতর সরকারদলীয়দের কর্তৃত্ব ও একাধিপত্য সৃষ্টি হবে। ন্যূনতম কতটি আসন থাকলে একটি রাজনৈতিক দল সংসদে বিরোধী দলের মর্যাদা পাবে এর সুস্পষ্ট বিধান না থাকাই এ জটিলতার কারণ।

বিশ্লেষকদের মতে, এবারের নির্বাচনে আসনপ্রাপ্তির দিক থেকে আওয়ামী লীগের পর দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে জাতীয় পার্টি। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ২৯৮ আসনের মধ্যে ২৫৯টি পেয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। জোটগতভাবে পেয়েছে ২৮৮টি আসন। জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি ও অন্য শরিক দল মিলিয়ে পেয়েছে মাত্র ৭ আসন। তবে  আওয়ামী লীগ জোটের শরিক জাতীয় পার্টি এককভাবে পেয়েছে মাত্র ২২ আসন। এ হিসাবে একাদশ জাতীয় সংসদে আসনের দিক থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল জাতীয় পার্টি। সে হিসাবে জাতীয় পার্টিই এবারের সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসার কথা। কিন্তু আসনসংখ্যা কম থাকায় জাতীয় পার্টিকে সংসদের বিরোধী দল করা যাবে কি না তা নিয়ে দেখা দিয়েছে জটিলতা। যদিও জটিলতা কেটে যাবে বলেও অভিমত বেশির ভাগ বিশ্লেষকের।

বিশ্লেষকরা জানান, আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ের কারণে জাতীয় সংসদ, সরকার এবং বিরোধী দলে কিছু ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। এর একটিই হলো বিরোধী দল গঠন সংক্রান্ত জটিলতা। সরকার গঠনে ন্যূনতম ১৫১ আসনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও বিরোধী দল গঠনে কয়টি আসন থাকতে হবে এটির কোনো স্পষ্ট বিধান নেই। বিরোধী দল গঠিত হচ্ছে ‘রেওয়াজ’ অনুযায়ী।  প্রথম জাতীয় সংসদের বিরোধী দল সম্পর্কিত বিতর্কে অংশ নিয়ে তৎকালীন সংসদ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘সংসদীয় কনভেনশন অনুযায়ী ৫-৭ জন সদস্য নিয়ে গঠিত কোনো  গ্রুপের  নেতা বিরোধী দলের নেতা নন। ২৫ জনের কম সদস্য নিয়ে গঠিত কোনো দলকে বিরোধী দল হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া যায় না।’ সংবিধান ও জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিতে সংসদের বিরোধী দল হতে ঠিক কয়টি আসন প্রয়োজন তা নির্ধারিত নেই। প্রচলিত রেওয়াজ অনুযায়ী ন্যূনতম ১০ শতাংশের কম অর্থাৎ ৩০টির কম আসন পেলে তাকে সংসদে বিরোধী দলের স্বীকৃতি দেওয়ার সুযোগ নেই। এ হিসাবে জাতীয় পার্টি ২২টি আসন নিয়ে বিরোধী দলের মর্যাদা পেতে পারে না। তবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান ‘বাংলাদেশের খবর’কে বলেন, জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের মর্যাদা পেতে হলে জাতীয় পার্টিকে অন্য সব দলের সমর্থন আদায় করে ১০ শতাংশ সদস্যের স্বীকৃতি আদায় করতে হবে। তিনি দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলেন, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে এ ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এটি  নিরসনযোগ্য। দেশের প্রথম জাতীয় সংসদেও বিরোধী দল এবং বিরোধী দলের  নেতা ছিলেন না। তবুও সংসদ চলেছে। চতুর্থ জাতীয় সংসদেও এমন নজির রয়েছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রধান  রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (রব) উদ্যোগে গঠিত কম্বাইন্ড অপোজিশন পার্টিস (কপ) ১৯টি আসন লাভ করে। কপ প্রথমে সংসদীয় গ্রুপের মর্যাদা লাভ করলেও বিরোধী দলের মর্যাদা পায়নি। পরে অন্যান্য দলের আরো ১৪ জন সংসদ সদস্য আ স ম আবদুর রবকে নেতা মেনে নিয়ে স্পিকারের কাছে আবেদন করেন। স্পিকার তাকে বিরোধী দলের নেতার স্বীকৃতি দেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বাইরে অন্য কোনো দল এক-দশমাংশ আসন পায়নি। এবার জাতীয় পার্টি ২২টি আসন পেয়েছে। ঐক্যফ্রন্ট ৭টি এবং অন্য কোনো দল ৩টির বেশি আসন পায়নি। জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের মর্যাদা পেতে হলে জাতীয় পার্টিকে অন্য সব দলের সমর্থন আদায় করে ১০ শতাংশ সদস্যের স্বীকৃতি আদায় করে নিতে হতে পারে।

এদিকে আইনজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক ‘বাংলাদেশের খবর’কে বলেন, এদেশে সংবিধানের দোহাই দিয়ে অনেক কিছুই তো ঘটছে। সেক্ষেত্রে ‘বিরোধী দল’ মর্যাদা দেওয়ার কায়দাও মনে হয় সরকার বাতলে নিতে পারবে। বিদ্যমান সংবিধান ও জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধিতে সংসদের বিরোধী দল হতে ঠিক কত সংখ্যক সদস্য প্রয়োজন সেটি নির্ধারিত নেই। রেওয়াজ অনুযায়ী ১০ শতাংশের কম অর্থাৎ ৩০০ আসনের মধ্যে ৩০টির কম আসন পেলে তাকে সংসদে বিরোধী দলের স্বীকৃতি দেওয়ার দেওয়ার সুযোগ নেই। তিনি  বলেন,  জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালীবিধি অনুযায়ী ২(১)(ট) বিধিতে বলা হয়েছে, ‘বিরোধী দলের নেতা অর্থ স্পিকারের বিবেচনা মতে যে সংসদ সদস্য সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চসংখ্যক সদস্য লইয়া গঠিত ক্ষেত্রমত তিনিই দল বা অধিসংঘের নেতা।’ সে হিসাবে বিরোধী দলের স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি স্পিকারের নিজের এখতিয়ার। জাতীয় পার্টি ২২ সদস্যকে নিয়ে বিরোধী দলে বসলে তাকে বিরোধী দলের স্বীকৃতি দেওয়া হবে কি না সেটিও স্পিকারের এখতিয়ারভুক্ত।

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, ভারতের লোকসভার কার্যপ্রণালী বিধিতে বিরোধী দল সম্পর্কিত বিষয় উল্লেখ নেই। তবে কার্যপ্রণালী বিধির ৩৮৯ বিধিতে  দেওয়া ‘অবশিষ্ট ক্ষমতাবলে’ স্পিকার সময়ে সময়ে কিছু নির্দেশ বা ডিরেকশন জারি করেছেন। ওইসব নির্দেশের ভিত্তিতে বিষয়টি সম্পর্কে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা গড়ে উঠেছে। সংসদীয় দল হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে সংশ্লিষ্ট দলটি কমপক্ষে লোকসভার এক-দশমাংশ সদস্য নিয়ে গঠিত হতে হবে। সংসদীয় গ্রুপ হিসেবে স্বীকৃতির জন্য দলে কমপক্ষে ৩০ সদস্য থাকতে হবে। ভারতীয় লোকসভা ৫৪৫ সদস্যবিশিষ্ট। ১০ শতাংশ সদস্য না থাকায় প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় লোকসভায় কোনো বিরোধী দল এবং বিরোধী দলের নেতা ছিল না। কাউল ও শাকধারের ‘প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রসিডিউর অব পার্লামেন্ট’র ৩১৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘বিরোধী দলের সদস্যসংখ্যা ৩০ সদস্যের নিচে নেমে এলে স্পিকারের নির্দেশ দ্বারা নির্ধারিত হবে।’ অর্থাৎ স্পিকারের নির্দেশনাই এখানে  চূড়ান্ত।

এদিকে জাতীয় পার্টি সরকার নাকি বিরোধী দলে থাকবে এ নিয়ে  আলাপ-আলোচনা চলছে তিন দিন ধরেই। দশম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি একই সঙ্গে  বিরোধী দল এবং সরকারের সঙ্গেও ছিল। এবারো দলটির বেশিরভাগ অংশ মহাজোটের শরিক দাবি করে সরকারে থাকতে চাইছে। তবে দলের কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের গতকাল শনিবারও জোর দিয়ে বলেছেন, জাতীয় পার্টি সংসদে ‘শক্তিশালী বিরোধীদল’ হতে চায়। দলের ভেতরেই এ নিয়ে রয়েছে বাদ-বিসম্বাদ। তবে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক  ‘বাংলাদেশের খবর’কে বলেছেন,  প্রধানমন্ত্রী চান জাতীয় পার্টি বিরোধী দলে থাকুক। এ নিয়ে কথাও হয়েছে। কিন্তু জাতীয় পার্টি তা চায় না। যদি তারা সরকারে থাকে তাহলে তো মহাজোটের সরকারই হবে। শেষ পর্যন্ত কী হয় সেটাই এখন দেখার বিষয়।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads