জাতীয় সংসদে বিরোধী দল হিসেবে কোন ধরনের ভূমিকা পালন করতে হবে, তা এখনো ‘স্পষ্ট’ নয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের কাছে। অনানুষ্ঠানিক কোনো বিরোধী দলের দায়িত্ব কী হতে পারে, এ বিষয়ে ‘ধারণা’ পাচ্ছেন না জোট থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা। একই প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পর বিরোধী দল হওয়া যায় কি না, এমন প্রশ্নও তাদের। ভূমিকার বিষয়ে ‘স্পষ্ট’ হতে না পারায় একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশনে জোট যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশনের তারিখ নির্ধারিত হওয়ার পর জোট নেতারা তাই ভূমিকার বিষয়ে ‘স্পষ্ট’ হতে চাচ্ছেন। ১৪ দলের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের সূত্র এসব তথ্য জানায়।
জোট সূত্র জানায়, গত ১ এপ্রিল ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ১৪ দলের বৈঠকে সংসদে জোটের ভূমিকার প্রসঙ্গ আসে। এতে উপস্থিত জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, ‘সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা বলতে কী বোঝায়, সেটা আগে স্পষ্ট হওয়ার দরকার আছে। ১৪ দলে থেকে কীভাবে বিরোধী দল হতে হবে, এটা স্পষ্ট নয়।’ এর আগে বৈঠকে সরকারের কাজে সমর্থন দেওয়ার পাশাপাশি বিরোধী দলের ভূমিকাও পালন করার কথা বলেন সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া।
সংসদ সচিবালয় জানায়, একাদশ সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশন আগামী ২৪ এপ্রিল বিকাল ৫টায় শুরু হবে। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সংবিধানে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এ অধিবেশন আহ্বান করেন। ৬০ দিনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্যই এ অধিবেশন আহ্বান করা হয়। প্রথম অধিবেশন গত ৩০ জানুয়ারি শুরু হয়ে চলে ১১ মার্চ পর্যন্ত। ওই অধিবেশনে প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারেনি বলে মনে করেন ১৪ দলের বেশ কয়েক নেতা। অনানুষ্ঠানিক বিরোধী দলের আসনে বসলেও সংসদ প্রাণবন্ত করতে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনেকটা বাধা বলে অভিমত তাদের। এ অবস্থায় বিরোধী দল হিসেবে কোনো ভূমিকা রাখা যাবে কি না, এমন প্রশ্নও তাদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জোটের শীর্ষ এক নেতা বলেন, ‘৩০ জানুয়ারি থেকে একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন বসলেও তখন ১৪ দলের শরিক দলগুলো প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারেনি। কয়েকটি দল তখনো বিরোধী দলে থাকার সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। যেসব দল সিদ্ধান্ত নেয় বিরোধী দল হওয়ার, সেগুলোর নেতারা ভূমিকার বিষয়ে স্পষ্ট হতে পারেননি। ফলে সংসদের ওই অধিবেশনে জোটের পক্ষে বিরোধী দলের ভূমিকা দেখা যায়নি।’
সূত্রমতে, একাদশ সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে সরকার গঠনের পর শরিক দলগুলোকে সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকতে প্রস্তাব দেয় আওয়ামী লীগ। দলটির নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক কয়েকটি দল বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকতে চাইলেও বাকি দলের নেতারা এ বিষয়ে প্রথম থেকেই ভিন্নমত পোষণ করে আসছেন। ফলে সংসদে বিরোধী দল হতে জোটে শুরু থেকেই মতানৈক্য দেখা দেয়। বিরোধী জোটে নয়, ১৪ দল ও মহাজোটের শরিক হিসেবেই দলগুলো সংসদে থাকতে আগ্রহী। একই প্রতীকে ভোট করার পর তাদের বিরোধী দলে পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়েও প্রশ্ন তুলে আসছেন তারা। সরকারের চাওয়া মতো বিরোধী দলে গেলে আদর্শিক এ জোটের ঐক্য অটুট থাকবে না বলেও তারা যুক্তি দেখাচ্ছেন।
তবে যারা বিরোধী দলে থাকতে আগ্রহী, সেসব নেতার যুক্তি হলো— সরকার ও বিরোধী দলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি রাখতেই এ সিদ্ধান্ত নেয় আওয়ামী লীগ। ১৪ দলের শরিকরা বিরোধী দলে থাকলে তা তাদের জন্যও ভালো আর সরকারের জন্যও ভালো। কারণ, সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলে সরকারের ভুলত্রুটি সংশোধন করতে সুবিধা হয়। দায়িত্বশীল বিরোধিতা দেশের গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য। বিরোধী দলে থাকলে ১৪ দলের শরিক প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো নিজ দলের সাংগঠনিক অবস্থার দিকে আরো বেশি নজর দিতে পারবে বলে তারা মনে করেন।
তথ্যমতে, মহাজোট গঠিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দুইবারের মন্ত্রিসভায় জোটের শরিক দলের নেতাদের রাখা হয়। একাদশ সংসদ নির্বাচনে জোটগতভাবে অংশ নিলেও তাদের কেউ মন্ত্রিসভায় নেই। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট মাত্র আটটি আসন নিয়ে বিরোধী দলে বসতে পারছে না কিনা, এ নিয়ে নানা তর্ক আছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে। আসনসংখ্যা বিবেচনায় না নিলেও সংসদে ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচিতরা নিয়মিত হবেন, এমন লক্ষণও দেখছেন না আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। বিএনপি ‘কমসংখ্যক আসনের বিরোধী দল’ হলেও প্রকৃত গণতান্ত্রিক ভূমিকা পালন করবে সংসদে, এ বিষয়ে আশ্বস্ত হতে পারছে না সরকারি দলের শীর্ষ নেতৃত্ব।
অন্যদিকে মহাজোট ও ১৪ দলের শরিক দলগুলোর মিলিয়ে সংসদ সদস্য আছেন ৩১ জন। ঐক্যফ্রন্টের তুলনায় তাদের সংসদ সদস্যের সংখ্যা চার গুণের বেশি। রাজনৈতিক মিত্র ও সমমনা হওয়ায় মহাজোটের শরিক দলগুলো জাতীয় সংসদে দায়িত্বশীল বিরোধী দল হতে পারে বলে মনে করে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব। ফলে নতুন কৌশল অবলম্বন করে ১৪ দলকেও সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসাতে চায় আওয়ামী লীগ।
এ ছাড়া প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপিকে জাতীয় সংসদের ভেতরেও কোণঠাসা রাখতে চায় আওয়ামী লীগ। মহাজোটের শরিক দলগুলোকে সংসদে সেজন্যই বিরোধী দলের ভূমিকায় দেখতে চায় ক্ষমতাসীন দলটি। সাংগঠনিক ও নেতৃত্বে দুর্বলতাসহ বিভিন্ন কারণে সংসদের বাইরে ও রাজপথের রাজনীতিতে বিএনপি ইতোমধ্যেই ‘দুর্বল’। দশম সংসদের মতো একাদশ সংসদেও বিরোধী দলে বিএনপি থাকতে না পারলে দলটির অবস্থান সংসদীয় রাজনীতিতে আরো ‘নাজুক’ হতে পারে। রাজনৈতিক এ কৌশলের অংশ হিসেবে একই প্রতীকে নির্বাচন করলেও ১৪ দলের শরিকদের সংসদে বিরোধী দল হতে বলা হচ্ছে বলে মনে করেন জোটের শীর্ষ নেতারা।
তবে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের মতে, সুশাসন নিশ্চিত করতেই সংসদে বিরোধী দলের আসনে জোটের শরিকদের বসানো হচ্ছে। নির্বাচনে বড় বিজয়ের পর নতুন সংসদের মাধ্যমে উন্নয়নের পাশাপাশি সুশাসন নিশ্চিত করতে চায় সরকারি দল। সংসদের কার্যক্রমকে জবাবদিহির মধ্যে আনতে প্রথম অধিবেশনেই গঠিত হয় সংসদীয় কমিটিগুলো।