• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

ছবি: ইন্টারনেট

শারীরিক বিজ্ঞান

জিন থেরাপি : ভবিষ্যতের চিকিৎসা

  • আসিফ খান
  • প্রকাশিত ০৭ মে ২০১৮

পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিনতম সত্যটি হলো, মানুষ মরে যায়- কেউ আগে, কেউ পরে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। তবে প্রকৃতির অবস্থার বদলের কারণে সৃষ্ট বিভিন্নপ্রকার রোগ-বালাই প্রকৃতির এই কাজটা আরো সহজ করে দিচ্ছে দিন দিন। যত দিন যাচ্ছে ততই বিভিন্নপ্রকার রোগের উদ্ভব হচ্ছে এবং রোগগুলো কঠিনতর হচ্ছে।

আজ যে অসুখটার প্রতিষেধক বের হয়েছে, কাল আবার এই রোগটি অন্যভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। তাই আমাদেরও তাদের মতো করে ওষুধের ডোজ বাড়িয়ে বা পরিবর্তন করে পাল্লা দিতে হচ্ছে। কিন্তু অবস্থা এমন দিকে যাচ্ছে যে ডোজ বাড়িয়েও কাজ হচ্ছে না। রোগের জীবাণুরা ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে।

তাই গবেষকরা এখন রোগ প্রতিরোধের নতুন প্রযুক্তির দিকে নজর দিয়েছেন। তারা চেষ্টা করছেন, জিন থেরাপির মাধ্যমেই রোগ সারানোর। কিন্তু সেটা কীভাবে? আর এই জিন থেরাপিই কি মানবজাতির ভবিষ্যৎ চিকিৎসার উপায়? আজকের আয়োজনে সেইসব উত্তর খুঁজব আমরা।

জিন থেরাপি কী?

জিন থেরাপি আসলে এক ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি যার মাধ্যমে বিভিন্নপ্রকার বংশগত বা জিনগত রোগ নিরাময় করা হয়। অন্যভাবে বললে জিন প্রকৌশলের (Genetic Engineering) মাধ্যমে মানুষের ত্রুটিপূর্ণ কোনো জিনকে স্বাভাবিক জিন দ্বারা প্রতিস্থাপন করাকে জিন থেরাপি (Gene Therapy) বলে। এ প্রক্রিয়ায় রোগের জন্য দায়ী জিনটা বাদ দেওয়া হয় অথবা সেটাকে একটা ভালো জিন দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয়। আর ঠিক এ কারণেই জিন থেরাপি খুবই নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা।

জিন থেরাপি সাধারণ রোগ নিরাময় পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কারণ, বিভিন্নপ্রকার ওষুধ প্রয়োগে শুধু রোগের লক্ষণ ও বাহ্যিক সমস্যাগুলো কমে যায় কিন্তু অসুখটি পুরোপুরি নিরাময় হয় না, যে কারণে পরে আবার রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। কিন্তু জিন থেরাপির মাধ্যমে নির্দিষ্ট রোগের জন্য দায়ী ত্রুটিপূর্ণ জিনগুলোকে ভালো জিন দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয়। যাতে করে ক্ষতিকর প্রোটিনের স্থলে শরীর সঠিক এনজাইম (Enzyme) বা প্রোটিন (Protein) উৎপাদনে সক্ষম হয়। প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে এই চিকিৎসা পদ্ধতির পার্থক্য হলো, জিন থেরাপির মাধ্যমে শুধু রোগের উপশমই করা হয় না, জিনের বৈশিষ্ট্যগত ত্রুটি দূর করে একে সমূলে নিবারণ করা হয়।

ইতিহাস

১৯৯০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে চার বছরের এক বালিকার উপরে সর্বপ্রথম জিন থেরাপি প্রয়োগ করা হয়। ওই বালিকার শরীর জন্মগতভাবে এডেনোসিন ডিএমাইনেজ তৈরিতে অক্ষম ছিল। অথচ এই উপাদানটি দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য অতীব জরুরি। ওই বালিকার দেহে এডেনোসিন ডিএমাইনেজ তৈরিতে জিন থেরাপির সফল প্রয়োগ হয়েছিল।

জিন থেরাপির প্রকারভেদ

কার্যকারিতার ওপর ভিত্তি করে জিন থেরাপি প্রধানত দুইভাগে ভাগ করা যায়।

দেহকোষ জিন থেরাপি : নাম থেকেই অনুমান করা কঠিন নয় যে, এই জিন থেরাপি দেওয়া হয় দেহকোষে (Somatic Cell)। অর্থাৎ জিন থেরাপি যখন দেহকোষের ক্রোমোজোমে দেওয়া হয় তখন সেটাকে দেহকোষ জিন থেরাপি বলা হয়। দেহকোষ জিন থেরাপিতে রক্তকোষ বা ত্বকের কোষ জাতীয় শরীরের কোষে পরিবর্তন আনা হয়। এই পদ্ধতিতে শরীর থেকে কোষ সংগ্রহ করে তাতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনে তাকে আবার শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয় অথবা শরীরে অবস্থিত কোষেই সরাসরি পরিবর্তন আনা হয়। হ্যামোফিলিয়া (Hemophilia) বা থ্যালাসেমিয়া (Thalassemia) রোগের চিকিৎসায় এই পদ্ধতি বেশ কার্যকর। এই পদ্ধতিতে কয়েক বিলিয়ন হাড়ের কোষ সংগ্রহ করা হয়। তারপর তাতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনে তাকে আবার শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। এতে নতুন করে যেসব রক্তকোষ তৈরি হয় তাতে পরিবর্তিত জিনের বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশ পায়। দেহকোষ জিন থেরাপির মাধ্যমে কৃত পরিবর্তনগুলো শুধুমাত্র রোগীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, বংশগতির ধারাকে প্রভাবিত করে না। পরবর্তী বংশধরে রোগটি আবার ফিরে আসতে পারে।

জননকোষ জিন থেরাপি : জিন থেরাপিতে যখন জননকোষ ব্যবহার করা হয় তখন সেটাকে জননকোষ জিন থেরাপি বলা হয়। জননকোষ জিন থেরাপিতে জননকোষ দুটিকে স্বাভাবিকভাবেই নিষিক্ত হতে দেওয়া হয়, তারপর নিষিক্ত ডিম্বাণুতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনে তাকে আবার মাতৃগর্ভে প্রতিস্থাপন করা হয়। এই নিষিক্ত ডিম্বাণুটি যে ভ্রূণ গঠন করবে তার সমস্ত কোষে ওইভাবে পরিবর্তিত জিনটি ছড়িয়ে যাবে ফলে সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সফল হলে নবজাতকের সমস্ত কোষে পরিবর্তিত জিনটি উপস্থিত থাকে এবং প্রয়োজনীয় কার্য সম্পাদনে সক্ষম হয়। কারণ আমরা জানি, নিষেকের ফলে উৎপন্ন ডিপ্লয়েড (2n) এককোষী কোষ থেকেই কোষ বিভাজনের মাধ্যমে পূর্ণ প্রাণীটি বিকশিত হয়। ধারণা করা হয়, জননকোষ জিন থেরাপির মাধ্যমে সকল বংশগত রোগ (Genetic Disease) পুরোপুরিভাবে বিতাড়িত করা সম্ভব এবং এই প্রক্রিয়ায় করা পরিবর্তন পরবর্তী বংশধরে স্থানান্তরিত হয়, তাই রোগের পুনরায় ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। আর তাই এই ধরনের পরিবর্তন চিরস্থায়ী এবং বংশগতির ধারাকে সরাসরি প্রভাবিত ও পরিবর্তন করে।

আবার কাজের ধরনের ওপর ভিত্তি করে জিন থেরাপিকে প্রধানত দুইভাগে ভাগ করা যায়।

এক্সভিভো জিন থেরাপি : এই প্রক্রিয়ায় প্রথমে দায়ী জিন ধারণকারী কোষ বা টিস্যুটিকে কেটে বাইরে আনা হয় এবং গবেষণাগারে উপযুক্ত পরিবেশে এই কোষের ওপর জিন থেরাপি দেওয়া হয়। ফলাফল ভালো হলে কোষ বা টিস্যুটিকে পুনরায় দেহে স্থাপন করা হয়। এ ক্ষেত্রে সাধারণত নন-ভাইরাল বাহক ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিটি সর্বাপেক্ষা উত্তম কিন্তু যথেষ্ট জটিলতা এবং সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

ইনভিভো জিন থেরাপি : এই প্রক্রিয়ায় কোষ দেহে থাকা অবস্থাতেই থেরাপি দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে জিনটি সরাসরি রোগীর দেহে প্রবেশ করাতে হয় এবং তা প্রকাশের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা রাখতে হয়। বাহক হিসেবে ইনভিভো জিন থেরাপিতে বিভিন্নপ্রকার ভাইরাল পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।

জিন থেরাপির মূল প্রক্রিয়া

ক্ষতিকর জিনটি ভালো জিন দিয়ে প্রতিস্থাপন করাই জিন থেরাপির মূল কাজ। রিসেসিভ (Recessive) জিনের ক্ষেত্রে শুধু জিনটি নির্দিষ্ট জায়গায় বসালেই হয় কিন্তু ডমিন্যান্ট (Dominant) জিনের ক্ষেত্রে শুধু খারাপ জিনটির প্রতিস্থাপনই শেষ নয়, বরং পাশাপাশি জিনটি জিনোম থেকে পুরোপুরি অপসারণ করতে হয় বা অকার্যকর করতে হয়। এখন কাজ হলো, ত্রুটিপূর্ণ জিনটির স্থলে কাঙ্ক্ষিত ভালো জিনটি প্রতিস্থাপনের লক্ষ্যে সেটি নিউক্লিয়াসে অনুপ্রবেশ করানো এবং ক্রোমোজোমের (Chromosome) সঙ্গে সংযুক্তকরণ। এটা করার জন্য প্রধানত বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস (Virus) ব্যবহার করা হয়, যাদেরকে বাহক (Vector or Carrier) বলা হয়। ভাইরাস রোগ সৃষ্টি করে তাই বাহক হিসেবে ব্যবহূত ভাইরাসটির যে জিনটি ক্ষতিকর সেটা রি-ইঞ্জিনিয়ারিং (Recombinant DNA Technology) করে বাদ দেওয়া হয় তবে স্বাভাবিক আক্রমণের ক্ষমতা অটুট রাখা হয় এবং কাঙ্ক্ষিত ভালো জিনটি বাহকের জিনোমের সঙ্গে যোগ করা হয়। এরপর ভাইরাসটিকে রোগীর দেহে অনুপ্রবেশ করানো হয়। ভাইরাসটি তার নিজস্ব ক্ষমতায় বা প্রক্রিয়ায় টার্গেট কোষকে আক্রমণ করে এবং তার জিনোমটি কোষের নিউক্লিয়ার ক্রোমোজোমের সঙ্গে সংযোজন করে অথবা কোষে স্বাধীনভাবে অবস্থান করে জিনের প্রকাশ ঘটায়। এ ক্ষেত্রে ভাইরাস দিয়ে শুধুমাত্র সেই সকল কোষগুলোকে আক্রান্ত করা হয় যা রোগের জন্য দায়ী।

সাধারণত তিন ধরনের ভাইরাসকে জিন থেরাপিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যথা : রেট্রোভাইরাস (Retrovirus), অ্যাডিনোভাইরাস (Adenovirus), এবং অ্যাডিনো-অ্যাসোসিয়েটেড ভাইরাস (Adeno-Associated Virus)।

ভাইরাস ছাড়াও কোষে জিন ট্রান্সফারের অন্য উপায়গুলো হলো : নগ্ন বা প্লাজমিড ডিএনএ ইনজেকশন (Naked DNA Injection), জিন গান (Gene Gun), ইলেক্ট্রোপোরেশন (Electroporation), ম্যাগ্নেটোফেকশন (Magnetofection), সনোপোরেশন (Sonoporation) ইত্যাদি।

জিন থেরাপি কি সম্পূর্ণ নিরাপদ?

আমাদের শরীরের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (Immune System) আছে, শরীরে অপরিচিত কিছু প্রবেশ করলেই এটা তাদের বিরুদ্ধে কাজ শুরু করে দেয়, তাই জিন থেরাপির ক্ষেত্রে যখন বাহক শরীরে প্রবেশ করা হয় তখন হিতে বিপরীত হতে পারে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে সরাসরি ভূমিকা রাখতে হলে জিন থেরাপিকে এসব জটিলতা দূর করতে হবে। বিজ্ঞানীদের আরো কার্যকর বাহক খুঁজে বের করতে হবে যা আরো বেশি সংখ্যক কোষের উপরে কাজ করতে পারে, নতুন পন্থা উদ্ভাবন করতে হবে যেন আরো বেশি সংখ্যক বাহক উৎপাদন করা যায়।

জিন থেরাপি যেহেতু নতুন একটা পদ্ধতি তাই এর সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবে অনেক সাধারণ বিষয় হয়তো অনেক জটিল মনে হচ্ছে, কিন্তু ভবিষ্যতে আজকের অনেক সমস্যাই আর সমস্যা থাকবে না।

জিন থেরাপির ভবিষ্যৎ

জিন থেরাপি এমন একটা পদ্ধতি যেটা দিয়ে অসম্ভবকে জয় করা সম্ভব। এর ফলে পৃথিবীতে জন্মান্ধ, বধির, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, স্মৃতিভ্রষ্টটা শব্দগুলোর অস্তিত্ব আর থাকবে না। হাঁপানি, ডায়াবেটিস, হিমোফিলিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে জিন থেরাপি আশার আলো জ্বেলেছে।

মানব জিনোমে অনেক অপ্রয়োজনীয় জিন (Junk DNA) আছে যা অনেক ক্ষতিকর অভিব্যক্তি (Mutation) ঘটাতে পারে। জিন থেরাপির মাধ্যমে এসব ত্রুটি দূর করা যেতে পারে।

গবেষকরা মনে করেন কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও চিকিৎসাক্ষেত্রে এর ব্যবহার অবশ্যম্ভাবী। তারা মনে করেন, জিনবাহিত রোগ নির্মূলে ও জিনের সাধারণ ত্রুটি দূরীকরণে জিন থেরাপিই হবে চিকিৎসাবিজ্ঞানের শেষ দুর্গ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads