• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

সোমপুর বিহার

ছবি : সংগৃহীত

পূরাকীর্তি

সোমপুর বিহারের কথকথা

  • ইশতিয়াক আবীর
  • প্রকাশিত ১২ এপ্রিল ২০১৮

বাংলাদেশের উত্তরে নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নে সোমপুর বিহারের অবস্থান। তবে অনেকের কাছে এটি পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার নামেও পরিচিত। প্রাচীন বঙ্গ জনপদে সুদীর্ঘ চারশ’ বছর রাজত্ব করেছিল পাল বংশ। বাংলা ও বিহারকেন্দ্রিক পাল রাজ্য একসময় উত্তর-পশ্চিমে পাকিস্তানের খায়বার-পাখতুনখওয়া পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছিল। পাল বংশের রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। ধারণা করা হয়, পাল বংশের দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল নির্মাণ করেছিলেন সোমপুর বৌদ্ধবিহার। তবে অনেকে মনে করেন, ধর্মপালের পুত্র রাজা দেবপাল এই বিহার নির্মাণ করেন।

তিব্বতীয় ইতিহাসগ্রন্থ ‘পাগ সাম জোন ঝাং’-এ সোমপুর বিহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। সে অনুযায়ী, ৮১০-৮৫০ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময়ে সোমপুর বিহার নির্মাণকালের উল্লেখ পাওয়া যায়।

সোমপুর বিহার স্থাপত্যশিল্পে অনন্য এবং আকারে সুবৃহৎ। মাটির ঢিবির নিচে দীর্ঘকাল চাপা পড়ে থাকা এই স্থাপনা দূর থেকে দেখলে পাহাড়ের মতোই মনে হতো। সেই থেকেই পাহাড়পুর ইউনিয়নের নামকরণ।

দশম শতকে বিহারের আচার্য্য ছিলেন অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। পণ্ডিত অতীশের জ্ঞানের সুখ্যাতি পৌঁছে গিয়েছিল সুদূর তিব্বতেও। কথিত আছে, তিব্বতে গিয়ে তিনি সেখানকার পানির সমস্যা সমাধান করেছিলেন। অতীশ দীপঙ্করের বাড়ি ছিল বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে।

এক সময়ে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম সাধকদের জ্ঞানতীর্থ এই বিহার আনুমানিক ছয়শ’ বছর মাটিচাপা থাকার পর ১৮০৭ থেকে ১৮১২ সালের মধ্যে হদিস মেলে। এরপর স্যার আলেকজান্ডার ক্যানিংহাম ১৮৭৯ সালের দিকে এবং ব্রিটিশ ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর ১৯২০-এর দশকে আংশিক খননকাজ চালায়। বিভিন্ন সমস্যার কারণে দীর্ঘকাল বন্ধ থাকে খননকাজ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গত শতাব্দীর ’৮০-এর দশকে শুরু হয় এর খননকাজ। ১৯৮৫ সালে ইউনেসকো সোমপুর বিহারকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করে।

২৭ একর জমির উপর বিহারটি অবস্থিত। নিকটবর্তী জৈন ও হিন্দু মন্দিরের বিভিন্ন উপকরণ এই বিহার নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে বলেও জানা যায়। সোমপুরের এই বিহারটি এশিয়ার মধ্যে বৃহত্তম। এর আয়তন উত্তর-দক্ষিণে ৯২২ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৯১৯ ফুট। মূল দালানে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য ১৭৭টি কক্ষ ছিল। আটশ’ জন ভিক্ষুর বাসোপযোগী ছিল এ বিহার। দূর থেকে মন্দিরটিকেই পাহাড়ের মতো দেখায়। ক্রুশাকার পাটাতন এই মন্দিরের। প্রতিটি ক্রুশবাহুর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে ১০৮.৩ মিটার ও ৯৫.৪৫ মিটার।

সোমপুর বিহার ব্রহ্মদেশ ও জাভার স্থাপত্যগুলোকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। এর খননকালে ১২৫ নম্বর কক্ষে একটি মাটির পাত্রে খলিফা হারুন-অর-রশিদের শাসনামলের রৌপ্যমুদ্রা পাওয়া যায়। মুদ্রাগুলো ৭৮৮ খ্রিস্টাব্দের। ধারণা করা হয়, কোনো সাধক বা ধর্ম প্রচারক এই মুদ্রাগুলোকে এখানে এনেছিলেন। বিহারের মূল ইমারতের নির্মাণকৌশল শোভামণ্ডিত উন্নত স্থাপত্য কলাকৌশলের ইঙ্গিত বহন করে। এ দালান নির্মাণে তৎকালীন স্থপতিদের নৈপুণ্যের পরিচয়ও পাওয়া যায়।

বিহারের পূর্ব-দক্ষিণ কোনার দিকে প্রাচীরের বাইরে একটি বাঁধানো ঘাট ছিল। যা ‘সন্ধ্যাবতীর ঘাট’ নামে পরিচিত। ঘাটের অস্তিত্ব থেকে ধারণা করা হয়, বিহারের পাশ দিয়ে একটি নদী প্রবাহিত ছিল।

পাল রাজাদের প্রতিষ্ঠিত এইসব বিহার জ্ঞান সাধনা, আরাধনা ও জ্ঞান বিস্তারের উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। প্রথমে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের আবাসস্থল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও পরে বিহারগুলো গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়েছিল। সোমপুরের বিহারও এইভাবে একটি আবাসস্থল থেকে উচ্চতর বিদ্যাপীঠে রূপান্তরিত হয়েছিল।

আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এই বিহারে বহু জ্ঞানীজনের আগমন হতো। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান ছাড়াও সুদূর চীন, তিব্বত, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের বৌদ্ধরা ধর্মচর্চা ও ধর্মজ্ঞান অর্জন করতে এই বিহারে আসতেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads