• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
ত্যাগ ও আনুগত্যের অনুপম উৎসব ঈদুল আজহা

কিশোর ইসমাইল এক বিস্ময়কর ইতিহাসের জন্ম দিলেন এই মাটির পৃথিবীতে

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

ত্যাগ ও আনুগত্যের অনুপম উৎসব ঈদুল আজহা

  • প্রকাশিত ১৭ আগস্ট ২০১৮

ইব্রাহিমি প্রেম আর ইসমাইলি ত্যাগের বার্তা নিয়ে আবারো আমাদের সামনে হাজির মহিমান্বিত ঈদুল আজহা কোরবানির ঈদ। ত্যাগের ঈদ। ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর হয়ে ওঠার ঈদ। রিক্ত জীবন সাহারাকে পুণ্যে পুণ্যে ভরে তোলার ঈদ। প্রেম, ভালোবাসা ও ত্যাগ-বিসর্জনের চিরজীবন্ত উপমা, খোদায়ি পরীক্ষায় শতভাগ উত্তীর্ণ বাবা ইব্রাহিম আর পুত্র ইসমাইলের স্মৃতিমাখা বারতা নিয়ে প্রতিবছরই আসে এই ঈদ। যার উৎস এমন এক প্রাণময় প্রেমময় ইতিহাস, যা প্রত্যেক মুমিন বান্দার হূদয়ে জাগায় প্রেমের তুফান, ভাবের তরঙ্গ। হ্যাঁ, বড়ই আবেগময় সেই ইতিহাস, বড়ই তাৎপর্যময় সেই ইতিহাস।

বয়সের ভারে ন্যুব্জ বাবা ইব্রাহিম। শরীরের সর্বত্র বার্ধক্যের ধবল রোশনির দাপট। কিন্তু এখনো তিনি শুনতে পাননি বাবা ডাকের অকৃত্রিম মধুরিমা। তিনি নিঃসন্তান। তাই বারবার চিরমানবিক ব্যথাময় প্রার্থনা বাঙ্ময় হয়ে ওঠে তদীয় নববি কণ্ঠে। তিনি বলে উঠলেন, ‘রাব্বি হাবলি মিনাস সালেহীন- হে আল্লাহ, আমাকে একটি নেক পুত্র দাও।’ মহান মালিকও নিরাশ করলেন না। বরং বলে দিলেন, ‘আমি তাকে ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম।’ তখনই মা হাজেরার কোলজুড়ে নেমে এলো এক পুত্রসন্তান- এমন সুপুত্র যার সুদর্শনে বাবা ইব্রাহিম তৃপ্ত হলেন। বাবা ডাকের অকৃত্রিম ভালোবাসায় তিনি আপ্লুত হলেন। চাঁদের চেয়ে সুন্দর, প্রাণপ্রিয় আত্মজ শিশু ইসমাইলের সোহাগভরা চপলতা আর আবেদন নিবেদনের মাদকতায় তিনি মুগ্ধ হলেন।

ইতিহাস তরতর করে বয়ে চলল সম্মুখের দিকে। শিশু ইসমাইল কৈশোরে পদার্পণ করলেন। বাবা ডাকের অকৃপণ মাধুর্যে ভরিয়ে দিলেন ইব্রাহিমের শূন্য হূদয়। অতঃপর যখন ইব্রাহিমের মন জনকসুলভ দরদে ভরে উঠল কলিজাছেঁড়া ধন ইসমাইলের প্রতি, তখনই নির্দেশ এলো- প্রাণের দুলালকে কোরবানি কর আমার নামে।

বড়ই তাৎপর্যময় এই আদেশ। অথচ এই সেই ইসমাইল, যাকে পুত্র হিসেবে পেতে কত অনুনয়-বিনয়, কাকতি-মিনতি আর রোনাজারি করতে হয়েছে খলিলুল্লাহ ইব্রাহিমকে, তার ইয়ত্তা নেই। এটা তো কেবল প্রাণের দুলাল ইসমাইলকে কোরবানি করার আদেশই নয়, এত হূদয়-বিশ্বাস ও অনুভূতির পরতে পরতে মিশে যাওয়া শতবর্ষের স্বপ্ন, আহাজারি আর অশ্রুজলে  সিঞ্চিত লালিত পিতৃত্বের বলিদান! তারচেয়ে বরং আত্মদানই তো সহজ।

ইব্রাহিম তো খলিলুল্লাহ। খোদার পরম প্রিয় বন্ধু। তাই আল্লাহর পরীক্ষার কথা তার বুঝতে বাকি রইল না। তিনি বুঝে ফেললেন, মহান আল্লাহ চাইছেন খলিলুল্লাহর হূদয়জুড়ে থাক কেবলই তার প্রেম ভালোবাসা। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আপন পুত্রকে কোরবানি করার, বুকের গহিনে লালিত পিতৃত্বকে বিসর্জন দেওয়ার। কিন্তু পিতা হয়ে সন্তানকে কী করে বলবেন এ কথা?

আর কিশোর ইসমাইল? সেও তো ইব্রাহিমেরই পুত্র। কিশোর ইসমাইল এক বিস্ময়কর ইতিহাসের জন্ম দিলেন এই মাটির পৃথিবীতে। বাবার স্বপ্নকাহিনী শোনামাত্র আবেগমথিত গদগদ কণ্ঠে বলে উঠলেন- ‘ইয়া আবাতিফ আল-পিতাজি, আপনি আপনার প্রতিপালকের আদেশ পালন করুন। অবশ্যই আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।’

তারপর? বাবা ইব্রাহিম প্রাণাধিকপ্রিয় পুত্রকে উপুড় করে শোয়ালেন, যেন পুত্রের কচিমুখের দিকে দরদে ভরে না ওঠে অন্তর, যেন কালবিলম্ব না হয় মহান রবের নির্দেশ পালনে। তার হাতে ধারালো ছুরি। তারপর কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, দুনিয়ার মানুষের ভাষা তা ব্যক্ত করতে অপারগ। এ ঘটনা শুধুই উপলব্ধির। শুধুই অনুভবের। যে অনুভব, যে উপলব্ধি করেছিলেন বাবা ইব্রাহিমের হূদয় আর উপস্থিত ফেরেশতাগণ। সৃষ্টিকুলের চোখেও যেন পানি এসে গিয়েছিল সেদিন। সবার চোখে-মুখে সেই একই বেদনার ছাপ- আহ, কী হতে যাচ্ছে! তাহলে কি আজীবন মিল্লাতে ইব্রাহিমকে এভাবেই ত্যাগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে? সে এক করুণ ভাবাবেগময় মুহূর্ত। মহান প্রভুর রহমতের দরিয়ায় জোশ উথলে উঠল। কবুল করে নিলেন তিনি পিতা-পুত্রের এই অসীম ত্যাগ আর কোরবানিকে। ইরশাদ করলেন, ‘কাদ সাদ্দাকতার রুয়া- তুমি তো সত্যি পালন করলে স্বপ্নাদেশ।’ তারপর বেহেশত থেকে দুম্বা পাঠিয়ে ইসমাইলের স্থলে কোরবানি করলেন। আর পিতা-পুত্রের অসীম অসামান্য এই ত্যাগের আদর্শকে সমুন্নত ও শাশ্বত রাখার জন্য শ্রেষ্ঠ উম্মত- উম্মতে মোহাম্মদির ধর্মীয় চিরন্তন কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করে দিলেন। তারপর মহান আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করলেন- সালাম ইব্রাহিমের প্রতি। সালাম ইসমাইলের প্রতি। এ ইতিহাস খোদাপ্রেমের ইতিহাস। এ ইতিহাস ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর হয়ে ওঠার ইতিহাস। অপূর্ব প্রেম আর বিসর্জনের এ ইতিহাস না কাঁদিয়েছে- এমন মুমিন দুনিয়ায় জন্মেছে কি?

বছর বছর ঘুরে আসা এই কোরবানি ডাক দিয়ে যায় বাবা ইব্রাহিমদের, মা হাজেরাদের আর পুত্র ইসমাইলদের। ডাক দিয়ে যায় আল্লাহর পথে আত্মদানের, ইব্রাহিমি আনুগত্য আর ইসমাইলি বিসর্জনের। নির্যাতিত মুসলিম উম্মাহকে তার অতীত ঐতিহ্য ফিরে পেতে হলে সাড়া দিতেই হবে ডাকে, সন্দেহ নেই। সবিশেষ এবারের কোরবানি আমাদের মাঝে বয়ে আনুক আনুগত্য ও বিসর্জনের প্রেরণা। জাগরূক হোক আমাদের বোধ-বুদ্ধি ও বিচার-বিবেচনা। ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর হোক আমাদের জীবন। মহান পরীক্ষক রাব্বুল আলামিনের দরবারে এটাই আমাদের একান্ত কামনা।

সাজ্জাদ আকবর

আলেম ও সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads