• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
ইসলাম ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞানে জন্মনিয়ন্ত্রণের কুফল

এ আন্দোলনের আসল উদ্দেশ্য হলো বংশবৃদ্ধি প্রতিরোধ

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

ইসলাম ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞানে জন্মনিয়ন্ত্রণের কুফল

  • প্রকাশিত ৩১ আগস্ট ২০১৮

এসএম আরিফুল কাদের

জন্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলন আঠারো শতকের শেষাংশে ইউরোপে সূচনা হয়। সম্ভবত ইংল্যান্ডের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ম্যালথাসই এর ভিত্তি রচনা করেন। এ আন্দোলনের আসল উদ্দেশ্য হলো বংশবৃদ্ধি প্রতিরোধ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার দেখে মি. ম্যালথাস হিসাব করেন, পৃথিবীতে আবাদযোগ্য জমি ও অর্থনৈতিক উপায়-উপাদান সীমিত। কিন্তু বংশবৃদ্ধির সম্ভাবনা সীমাহীন। তাই ১৭৯৮ সালে মি. ম্যালথাস রচিত An essay on population and as it effects, the future improvment of the society নামক গ্রন্থে সর্বপ্রথম তার মতবাদ প্রচার করেন। এরপর ফ্র্যান্সিস প্ল্যাস ফরাসি দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিরোধ করার প্রতি জোর প্রচারণা চালান। কিন্তু তিনি নৈতিক উপায় বাদ দিয়ে ওষুধ ও যন্ত্রাদির সাহায্যে গর্ভনিরোধ করার প্রস্তাব দেন। আমেরিকার বিখ্যাত ডাক্তার চার্লস নোল্টন ১৮৩৩ সালে এ প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন সূচক উক্তি করেন। তিনি তার রচিত The Fruits of philosophy নামক গ্রন্থে সর্বপ্রথম গর্ভনিরোধের চিকিৎসা শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা এবং এর উপকারের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।

কিন্তু মাঝখানে ১৮৪০ থেকে ১৮৭৫ সাল পর্যন্ত এ আন্দোলন বন্ধ থাকে। ইংল্যান্ডের অধিবাসীরা এর প্রতি কোনোরূপ গুরুত্বারোপ ও সহযোগিতা করতে অস্বীকার জানিয়েছিলেন। আবার ১৮৭৬ সালে নতুন করে ম্যালথাসীয় আন্দোলন নামক নতুন আন্দোলন শুরু হয়। মিসেস অ্যানি বাসন্ত ও চার্লস ব্রাডার ডা. নোল্টনের Fruits of philosophy গ্রন্থটি ১৮৭৬ সালে ইংল্যান্ডে প্রকাশ করেন। ১৯৭৭ সালে ডা. ড্রাইসডেলের সভাপতিত্বে একটি সমিতি গঠিত হয় ও জন্ম নিয়ন্ত্রণের প্রচার কার্য শুরু হয়ে যায়। (ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ, পৃ. ১৩-১৫)।

আর এই জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি দুই ধরনের হয়ে থাকে। (১) সাময়িক ব্যবস্থা ও (২) স্থায়ী ব্যবস্থা।

(১) সাময়িক ব্যবস্থা হলো- (ক) আজল তথা ভেতরে বীর্যপাত না করা, (খ) নিরাপদ সময় মেনে চলা, (গ) কনডম ব্যবহার, (ঘ) ইনজেকশন পুশ, (ঙ) পেশিতে ট্যাবলেট ব্যবহার, (চ) মুখে পিল সেবন ইত্যাদি।

(২) স্থায়ী ব্যবস্থা হলো- (ক) পুরুষের অপারেশন, (খ) নারীর অপারেশন।

(ক) পুরুষের অপারেশন : পুরুষের অণ্ডকোষে উৎপাদিত শুক্রকীটবাহী নালি দুটি কেটে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ফলে পুরুষের বীর্যপাত ঘটে। কিন্তু বীর্যে শুক্রকীট না থাকায় সন্তান হয় না।

(খ) নারীর অপারেশন : নারীর ডিম্বাশয়ে উৎপাদিত Fallopian Tube কেটে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ফলে পূর্ণ ক্রমোজম ডিম্ব আর জরায়ুতে প্রবেশ করতে পারে না। (ডা. এসএন পান্ডে, গাইনোকোলজি শিক্ষা, কলিকাতা : আদিত্য প্রকাশনী, ১৯৭৭, পৃ. ১২৪-১২৫)

নারী অথবা পুরুষের যেকোনো একজন স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করলে, অপর জনকে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় না। কারণ নারীর ডিম্ব পুরুষের শুক্রকীট দ্বারা নিষিক্ত না হলে সন্তানের জন্ম হয় না। (ডা. এসএন পান্ডে, গাইনোকোলজি শিক্ষা, কলিকাতা : আদিত্য প্রকাশনী, ১৯৭৭, পৃ. ১৪)।

অস্থায়ী জন্ম নিয়ন্ত্রণের ক্ষতির পাশাপাশি স্থায়ী জন্ম নিয়ন্ত্রণেরও ক্ষতি লক্ষ করা যায়। সেদিক গবেষণা করে দেখা যায় যে, জন্ম নিয়ন্ত্রণের বহুবিদ কুফল রয়েছে। যা ইসলামের দৃষ্টিতেও রয়েছে এবং স্বাস্থ্য বিজ্ঞানেও কিছু কুফল লক্ষ করা যায়। ইসলামের দৃষ্টিতে ক্ষতি হচ্ছে- ১. ব্যভিচারের প্রসার ঘটে। অথচ ব্যভিচার সম্পর্কে মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘তোমরা অবৈধ যৌন সম্ভোগের নিকটবর্তী হইও না। এটা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৩২)।

কিন্তু শয়তান মানুষকে দরিদ্রতার ভয় দেখিয়ে অসামাজিক, অনৈতিক কাজের প্রতি প্রলুব্ধ করে। নারী জাতি আল্লাহভীতির পাশাপাশি আরো একটি নৈতিকতা রক্ষা করতে বাধ্য হয়। তা হলো অবৈধ সন্তান জন্মের ফলে সামাজিক মর্যাদা বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা। কিন্তু জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে, এ আশঙ্কা থেকে একদম মুক্ত থাকে। যারা নৈশক্লাবে বেহায়াপনাভাবে নাচ-গান করে, পতিতাবৃত্তি করে, প্রেমের নামে রঙ্গলীলায় মেতে ওঠে, তারা অবৈধ সন্তান জন্মানোর আশঙ্কা করে না। তা ছাড়া কখনো হিসাবনিকাশে গরমিল হয়ে অবৈধ সন্তান যদিও গর্ভে এসে যায়, তবে ব্লুস্টার কেন্দ্রে গিয়ে প্রকাশ্যে গর্ভপাত করে।

২. জন্মের হার কমে যাওয়া। আগত ও অনাগত সন্তান হত্যার ব্যাপারে মহান আল্লাহ নিষেধ করে ইরশাদ করেন, ‘তোমরা অভাব ও দরিদ্রতার আশঙ্কায় তোমাদের সন্তানদের হত্যা কর না।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৩১)।

কিন্তু শয়তান আল্লাহর প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘আমি অবশ্যই তাদের নির্দেশ দেব। আর তারা তদনুযায়ী সৃষ্টির কাঠামোতে রদবদল করবে।’ (নিসা : ১১৯)।

এই রদবদল শব্দের অর্থ খুঁজতে গেলে বর্তমান যুগের জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অন্যতম। আর জন্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের নামে যারা সন্তান হত্যা বা অনাগত ভবিষ্যৎ বংশধরদের হত্যা করে চলেছে, তারা সন্তানের জন্মকেই দারিদ্র্যের কারণ বলে চিহ্নিত করেছে। আর সে জন্যই ক্রমশ জন্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলন নির্লজ্জভাবে চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে।

অর্থনৈতিক ক্ষতি : জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে বিভিন্ন ক্ষতির পাশাপাশি ওই সব উপকরণ ব্যবহারের জন্য জাতীয় রাজস্বে বিরাট ক্ষতিসাধিত হয়। এটাকে এক ধরনের অপচয় বললেও ভুল হবে না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা অপব্যয় কর না। নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৭)। অন্যত্র আছে, ‘খাও ও পান কর, অপব্যয় কর না। নিশ্চয়ই তিনি (আল্লাহ) অপব্যয়কারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা আরাফ : ৩১)।

স্বাস্থ্যবিজ্ঞানে জন্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষতির দিক হলো : ১. জন্মনিরোধক পিল একাধারে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে সেবন করা ঠিক নয়। বয়স ৩৫ হওয়ার আগেই বন্ধ করে দেওয়া ভালো। নইলে এই বহুল প্রচলিত জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা হূদযন্ত্রের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তসঞ্চালনে অসুবিধাসহ জরায়ুমুখে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এমনকি পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার কারণও হতে পারে। এই বড়ি যদিও ততটা ওজন বৃদ্ধি করে না, তদুপরি হরমোন গ্রহণে কিছুটা ওজন বৃদ্ধি অনেক সময়েই লক্ষ্য করা যায়। (দৈনিক প্রথম আলো, ১ আগস্ট ২০১৭)

২. জন্ম নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে জীবাণুনাশক ওষুধ, পিল, কনডম ইত্যাদি উপকরণ ব্যবহারের ফলে তৎক্ষণা কোনো ক্ষতি হয় না। কিন্তু বেশ কিছু কাল যাবৎ এসব ব্যবহার করার ফলে মধ্যবর্তী বয়সে উপনীত হতে না হতেই নারীর দেহে স্নায়ুতন্ত্রীতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। যেমন- নিস্তেজ অবস্থা, নিরানন্দ, উদাসীনতা, রুক্ষ মেজাজ, বিষণ্নতা, নিদ্রাহীনতা, মস্তিষ্কের দুর্বলতা, হাত-পা অবশ, শরীরে ব্যথা, স্তনে সাইক্লিক্যাল ব্যথা, ক্যানসার, অনিয়মিত ঋতুস্রাব, সৌন্দর্য নষ্ট ইত্যাদি। (মাসিক আত তাহরিক জানুয়ারি ২০১২)।

৩. সম্প্রতি স্লিমিং পিলের ক্ষতিকর নানা দিক নিয়ে উদ্বেগজনক এক তথ্য দিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা সংস্থা। দ্য মেডিসিন অ্যান্ড হেলথকেয়ার প্রোডাক্ট রেগুলেটরি এজেন্সির (এমএইচআরএ) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, স্লিমিং পিলে নানা ধরনের ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। হূদরোগের সমস্যা থেকে শুরু করে চোখে কম দেখা, ডায়রিয়াসহ নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে। তাদের দাবি, এই ধরনের স্লিমিং পিলে নিষিদ্ধ এবং ক্ষতিকর নানা উপাদান থাকে। (দৈনিক ইত্তেফাক, ২ ডিসেম্বর ২০১৭)।

লেখক : আলেম ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads