• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
মদ্যপান ইসলাম ধর্মে হারাম, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রাণঘাতি

বর্তমানে বিশ্বে এক বছরে অ্যালকোহলের কারণে মৃত্যুর হার ৪০ লাখ

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

মদ্যপান ইসলাম ধর্মে হারাম, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রাণঘাতি

  • আসিফ উল আলম সোহান
  • প্রকাশিত ০৫ অক্টোবর ২০১৮

ইসলাম ধর্মে প্রথমদিকে সাধারই রীতিনীতির মত মদ্যপানও স্বাভাবিক ছিল। এমনকি রসুল (সা.)-এর হিজরতের পরেও মদিনায় মদ্যপান প্রচলিত ছিল। এর অন্তর্নিহিত ক্ষতি সমপর্কে তখন কারো ধারনা ছিলনা। একদিন রসুল (সা.)-এর সাহাবি হজরত ফারুকে আজম ও হজরত ইবনে জাবাল মদ্যপানের ক্ষতিকর প্রভাব দেখে নবী করীমের নির্দেশ জানতে চাইলেন। এই পরেই সুরা বাকারায় নিমোক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। যার অর্থ— ‘তাহারা তোমাকে মদ ও জুয়া সমপর্কে জিজ্ঞেস করে। তাদের বলে দাও, এই দুইয়ের মাঝে রয়েছে মহাপাপ।’ (সুরা বাকারা : ২১৯) এই আয়াতে মদকে সরাসরি হারাম না করেও এর অকল্যাণের দিকগুলোকে তুলে ধরা হয়েছে।

এরপর একদিন হজরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফা (রা.) সাহাবিদের সঙ্গে এক বিকেলে মদ্যপান করছিলেন, এমন সময় মাগরিবের আজান হয়। সবাই নামাজে দাঁড়ালেন, সাহাবিদের একজন  ঈমামতি করতে এগিয়ে গেলেন, নেশাগ্রস্থ অবস্থায় যখন তিনি সুরা আল কাফিরুন ভুল পড়তে লাগলেন। (তিরমিজি, হাদিস ৩০২৬) ঠিক তক্ষণই মদের বিষয়েয় এরশাদ হলো— হে ইমানদারগণ! তোমরা কখনও নেশাগ্রস্থ অবস্থায় নামাজে দাঁড়াবে না।’ (সুরা নিসা : ৪৩) এই আয়াতে কেবল নামাজের সময় মদ হারাম হয়, অন্য সময় মদ্যপানের নিষেধাজ্ঞা এলো না।

এরপর একদিন হজরত আতবান ইবনে মালেক কিছু সাহাবীকে নিমন্ত্রণ করলেন যাদের মধ্যে সাদ ইবনে আবী আক্কাসও ছিলেন। এক পর্যায়ে মদ্যপানের প্রতিযোগিতা আর নিজেদের বংশ ও পূর্ব পুরুষদের আভিজাত্য ও অহঙ্কারমুলক বর্ণনা করতে লাগলেন, এসময় সাদ ইবনে আবী আক্কাস একটি কবিতা বলতে লাগলেন যেখানে নিজের বংশের প্রশংসা এবং আনসারদের হেয় আপমান করার বিষয় ছিল। একজন আনসার যুবক রাগাম্বিত হয়ে উটের গলার একটি হাড় দিয়ে সাদ এর মাঠায় আঘাত করলে সাদ আহত হন। হজরত সাদ রাসুল (সা.)-এর দরবারে যুবকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে রাসুল (সা.) তখন আল্ল­াহর কাছে বলেন, হে আল্ল­াহ শরাব বা মদ নিয়ে একটি পরিষ্কার ধারনা ও বিধান দান করুন। তখনই সূরা মায়েদায় মদ ও মদ্য পান করাকে হারাম বিধান সমপর্কিত বিস্তারিত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। (মুসলিম, হাদিস ১৭৪৮) পবিত্র কোরআনে ইরমাদ হয়েছে, ‘হে ঈমান্দারগণ! তোমরা নিশ্চিত যেনো  মদ, জুয়া, মূর্তি এবং তীর নিক্ষেপ এসবগুলোই নিকৃষ্ট শয়তানী কাজ। অতএব এসব করা থেকে তোমরা সমপূর্ণভাবে সরে থাক। মদ জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে পারসপরিক শত্রুতা-তিক্ততা সৃষ্টি হয় এবং আল্লাহর জিকির নামাজ থেকে তোমাদেরকে বিরত রাখাই শয়তানের ইচ্ছা। তবুও কি তোমরা তা থেকে বিরত থাকবে না।’ (সুরা মায়িদাহ : ৯০-৯১) এরপর থেকেই মদ্যপান ইসলাম ধর্মে সমপূর্ণভাবে হারাম করা হয়েছে।

সমপ্রতি একটি পরিসংখানে দেখা গেছে, বর্তমান বিশ্বে প্রতি তিনজনে একজন মদ পান করে। ২০১৬ সালে শুধু মাত্র মদ পানের কারণে ৩০ লাখ লোক মারা গেছে। বর্তমানে বিশ্বে এক বছরে অ্যালকোহলের কারণে মৃত্যুর হার ৪০ লাখ। অপরিনত বয়সে মৃত্যু ও প্রতিবন্ধিতার জন্য সপ্তম ঝুঁকিপূর্ণ অভ্যাস মদ্যপান বা অ্যালকোহল পানের অভ্যাস। এখানে অল্প মাত্রা আর বেশি বলে কিছু নেই। খুব সমপ্রতি একটি সাইন্স স্ট্যাডির ফলাফলে দেখা গেছে, অ্যালকোহলের কোনো ‘সেফ লেবেল’ নাই। অর্থাৎ যে কোনো পরিমানের মদ বা অ্যালকোহল মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। ৫ শতাংশ অ্যালকোহল সম্বলিত ৩৫০ এমএলের একটি বিয়ার পানের ফলে মানব দেহে যে প্রতিক্রিয়া ঘটে সেটা ৩০ থেকে ৪০ দিন পর্যন্ত দেহের মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীল থাকে। ইসলাম ধর্মের এরকম একটি কথার প্রচলন রয়েছে, মদ খেলে ৪০ দিন মুখ নাপাক থাকে। যদিও এরকম কোনো সহিই হাদিস পাওয়া যায় নাই।

মদ পানের ব্যাপারে ইসলাম ধর্ম আর আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে দেখা দিয়েছে। ইসলাম বলছে মদ্য পান করা হারাম আর আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান  বলছে মদ্য পান প্রাণঘাতি। মদের কুফলের ব্যাপারে বহুকাল আগে যে কথাটি  ইসলাম বলেছে সমপ্রতি মদের স্বাস্থ্যঝুকি নিয়ে এক প্রবন্ধে এসব তথ্য প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকী দ্য ল্যানসেট। ১৯৯০ থেকে ২০১৬ সাল এই ২৫ বছর ১৯৫ টি দেশে মদের ব্যবহার, অসুস্থতা ও মৃত্যুর তথ্য এতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে গবেষকেরা বলেছেন, মদের কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই। প্রবন্ধে বলা  হয়, ডেনমার্কের মানুষ সবচেয়ে বেশি মদ পান করে।

সুখের বিষয় হচ্ছে সবচেয়ে কম মদ পান করা দেশগুলোর তালিকা রয়েছে বাংলাদেশ। গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজ নামের বৈশ্বিক উদ্যোগ থেকে এই গবেষণা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর হেলথম্যাট্রিকস এই উদ্যোগের প্রধান কার্যালয় হিসেবে কাজ করে। গবেষণায় অর্থায়ন করে যুক্তরাষ্ট্রের মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতার ফাউন্ডেশন বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। এর সঙ্গে যুক্ত আছেন আন্তর্জাতিক গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) অসংক্রামক ব্যাধি বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী আলিয়া নাহিদ। তিনি বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘মদ্য পানে সরাসরি স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। উচ্চ রক্তচাপ বাড়ায়, এটা ক্যান্সারের অন্যতম কারণ।’

চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই প্রথমবারের মতো বিশ্বের সকল গবেষকেরা এক সুরে বলছেন, মদের কোনো গ্রহণযোগ্য মাত্রা নেই। গবেষকেরা বলছেন, ১৫-৪৯ বছর বয়সী মানুষের ১০টি মৃত্যুর  মধ্যে একটি মদ পানের কারণে ঘটে। নিয়মিত মদ্যপান শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ও টিস্যুতে বিরূপ প্রভাব ফেলে। মদে অভ্যস্ত মানুষ সহিংস হয় এবং অনেক সময় নিজের ক্ষতি করে। মাত্রা বেশি হলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। বিশ্বব্যাপী মানুষ কী পরিমাণ মদ পান করে, সেই হিসাব বের করতে গবেষকেরা ৬৯৪ টি পূর্বের গবেষণা পর্যালোচনা করেন। এ ছাড়া মদের স্বাস্থ্যঝুঁকি নির্ণয়ের জন্য আরও ৫৯২ টি গবেষণা প্রবন্ধ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এসব পর্যালোচনা শেষে গবেষকেরা বলছেন, ৫০ বছরের বেশি বয়সীদের ক্যান্সারে মৃত্যুর পেছনে প্রধান কারণ মদ্যপান। অতএব যুগ যুগ আগে একমাত্র ইসলাম ধর্মই মানুষের শারীরিক, সামাজিক, আর্থিক বিষয়কে বিবেচনায় রেখে মদ্যপানকে হারাম করেছে বহু বছর আগে। আর সেই একই কথা আবিস্কৃত হচ্ছে বর্তমান আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে।

লেখক : বিশেষ প্রতিনিধি, বাংলাদেশর খবর 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads