• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমাদৃত ইসলামিক স্কলার শহীদুল ইসলাম ফারুকী

মাওলানা শহীদুল ইসলাম ফারুকী

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

প্রবাসে বাঙালি আলেমদের সাফল্যগাথা

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমাদৃত ইসলামিক স্কলার শহীদুল ইসলাম ফারুকী

  • সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
  • প্রকাশিত ১৬ নভেম্বর ২০১৮

মাওলানা শহীদুল ইসলাম ফারুকী। মালয়েশিয়া প্রবাসী বিশিষ্ট লেখক, গবেষক, অনুবাদক ও বহু গ্রন্থের প্রণেতা হিসেবে সুপরিচিত এক ইসলামী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বময় ইসলামের প্রচার-প্রসার ও গবেষণায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। নিজের যোগ্যতা, মেধার কারণে তিনি আজ মালয়েশিয়ার বিশিষ্টজনসহ বিশ্বপরিমণ্ডলে ‘আন্তর্জাতিক ইসলামিক স্কলার’ হিসেবে বিশেষভাবে সমাদৃত। মাওলানা শহীদুল ইসলাম ফারুকী বর্তমানে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়ায় পিএইচডি করছেন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সেন্টার ফর ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড প্রি-ইউনিভার্সিটি একাডেমিক ডেভেলপমেন্ট’ থেকে তিনি ‘আরবি’ ও ‘ইংরেজি’ ভাষার ওপর পৃথক দুটি কোর্স এবং ‘ওয়ামী’র অধীনে গবেষণা পদ্ধতিবিষয়ক বিশেষ কোর্স সম্পন্ন করেছেন। এ ছাড়া বর্তমানে তিনি কুয়ালালামপুরস্থ একটি গবেষণা ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা ও গবেষণা কাজ করছেন। পাশাপাশি তিনি মালয়েশিয়া প্রবাসী আলেমদের সংগঠন ‘বাংলাদেশি উলামা কাউন্সিল অব মালয়েশিয়া’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং ‘বৃহত্তর কুষ্টিয়া অ্যাসোসিয়েশন অব মালয়েশিয়া’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে প্রবাসীদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তারুণ্যদীপ্ত গবেষক আলেম হিসেবে মাওলানা ফারুকী ইতোমধ্যে বাংলাদেশের প্রখ্যাত উলামায়ে কিরামসহ বিশ্বের প্রথিতযশা ইসলামিক স্কলারদের বিশেষ স্নেহধন্য সোহবত ও তাদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ও উদার প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী প্রতিভাবান প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ আলেমেদীন শহীদুল ইসলাম ফারুকী বাংলাদেশের ভাষা ও সাংস্কৃতিক রাজধানী কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর থানার ছাতিয়ান গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৮০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা একজন ধর্মানুরাগী, মুক্তিযোদ্ধা ও সমাজসেবক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। পারিবারিকভাবে তার লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হয়। স্থানীয় স্বরূপদহ দারুল উলুম ইসলামিয়া মাদরাসায় কোরআনুল কারিমের নাযেরা সমাপ্তির পর ১৯৯০ সালে চলে আসেন রাজধানী ঢাকায়। উপমহাদেশের প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের (রহ.) সান্নিধ্যে থেকে মোহাম্মদপুরস্থ ‘জামিআ রাহমানিয়া আরাবিয়া’ মাদরাসায় অত্যন্ত সুনাম ও কৃতিত্বের সঙ্গে হিফজুল কোরআন সমাপ্ত করেন এবং ‘সানুভিয়া উল্ইয়া’ (উচ্চ মাধ্যমিক) পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি পাড়ি জমান বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী বিদ্যাপীঠ ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দে। সেখানে তিনি অত্যন্ত সুনাম ও কৃতিত্বের সঙ্গে ‘দাওরায়ে হাদিস’ (মাস্টার্স) সমাপ্ত করেন। এরপর ভারতের লখ্নৌস্থ দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামায় আরবি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে লেখাপড়া করেন তিনি এবং ঢাকার দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ (অনার্স) ও এমএ (দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ) সম্পন্ন করে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আবদুর রহমান আনওয়ারীর অধীনে এমফিল করেন।

রাজধানীর মিরপুরস্থ মাদরাসা দারুর রাশাদ-এ যোগদানের মধ্য দিয়ে মাওলানা ফারুকীর কর্মজীবনের শুরু। সেখানে তিনি অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে হাদিস, তাফসির ও আরবি সাহিত্য বিষয়ে শিক্ষকতা করেন। মিরপুরস্থ দারুল উলুম মাদরাসায়ও তিনি হাদিস ও আরবি সাহিত্য বিষয়ে শিক্ষকতা করেন। এরপর দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে প্রভাষক হিসেবে এবং দি পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। কর্মজীবনে প্রবেশের পরই পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন রাজধানীর বড়কাটরা মাদরাসার সাবেক শায়খুল হাদিস আল্লামা তফাজ্জল হুসাইন (রহ.)-এর নাতনির সঙ্গে। বর্তমানে তিনি সপরিবারে মালয়েশিয়ায় বসবাস করছেন।

ছাত্রজীবনেই তিনি জগদ্বিখ্যাত আলেমেদীন আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)-এর রচনাবলি ও চিন্তাধারায় আকর্ষিত হয়ে তাকে ‘আদর্শ’ হিসেবে গ্রহণ করেন। এরপর তিনি আধ্যাত্মিক দীক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)-এর ভাগ্নে ও স্থলাভিষিক্ত খলিফা আল্লামা সাইয়েদ মুহাম্মদ রাবে হাসানী নদভীর আধ্যাত্মিক শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং পরবর্তী সময়ে তার থেকে খেলাফত লাভ করেন। উল্লেখ্য, মজলিসে দাওয়াতুল হক বাংলাদেশের আমির, যাত্রাবাড়ী মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও গুলশান আযাদ মসজিদের খতিব আল্লামা মাহমুদুল হাসান সাহেবও তাকে খেলাফত প্রদান করেছেন। বর্তমানে তিনি শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আধ্যাত্মিক সংগঠন ‘রিসালাতুল ইনসানিয়াহ বাংলাদেশে’র চেয়ারম্যান, উচ্চতর ইসলামী শিক্ষা ও গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান ‘শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, ঢাকা’র প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এবং লন্ডনভিত্তিক বুদ্ধিবৃত্তিক ও গবেষণাধর্মী সংগঠন ‘ওয়ার্ল্ড ইসলামিক ফোরাম বাংলাদেশ ব্যুরো’র সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

ছাত্রজীবন থেকেই তিনি নিয়মিত লেখালেখি করেন। বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক পত্রপত্রিকা ও জার্নালে নিয়মিত লিখছেন। মালয়েশিয়ার আরবি গবেষণা জার্নাল ‘আল-হাদিসে’ তার আরবি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সমকালীন বিশ্বপরিস্থিতি, ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং জীবনবোধ নিয়ে ২০টিরও বেশি গ্রন্থ রচনা ও অনুবাদ করেছেন তিনি। আরবি ভাষায় রচিত ‘মাকাসিদ আশ-শরীআহ’ ও ‘তাদবীনুল উলুমিশ শরঈয়্যাহ’ নামে তার দুটি গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশের পথে। তার একাধিক গ্রন্থ ইতোমধ্যেই কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে পাঠ্যসূচি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

মাওলানা শহীদুল ইসলাম ফারুকী একজন আন্তর্জাতিকমানের গবেষক ও ইসলামিক স্কলার। তরুণ বয়সেই বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অধিকারী এ আলেম বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ এবং প্রবন্ধ উপস্থাপন করে দেশ-বিদেশের মাটিতে নিজ দেশের মুখ সমুজ্জ্বল করে চলেছেন। পাশাপাশি অর্জন করেছেন ভূয়সী প্রশংসা ও সম্মান। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি ২০১২ সালে মালয়েশিয়ার কেলান্তান প্রদেশের রাজ্যসভার স্পিকার ড. আবদুল্লাহ বিন ইয়াকুব নদভীর দাওয়াতে কেলান্তান রাজ্যসভার পার্লামেন্টে বক্তৃতা করেন। ২০১৩ সালে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে ‘থাই-মুসলিম (টিএম) টিভি’র রাতের লাইভ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে আলোচনা পেশ করেন। ২০১৪ সালের ১২, ১৩ ও ১৪ নভেম্বর ইন্দোনেশিয়ার স্টেট ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে ‘ইসলামী অর্থনীতিবিষয়ক দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে’ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। ২০১৫ সালের ১৪ ও ১৫ জানুয়ারি সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির এশিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ‘এশিয়ায় ইসলামী সাম্প্রদায়িকতা’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনারে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত ‘জঙ্গিবাদ দমনে প্রবাসী উলামায়ে কিরামের ভূমিকা এবং কওমি মাদরাসা সনদের সরকারি স্বীকৃতি ও আগামীর ভাবনা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ কমিউনিটি ও মালয়েশিয়া আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাকে ‘আন্তর্জাতিক গবেষক’ হিসেবে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হয়।

অধ্যাপনা, গবেষণা ও লেখালেখির পাশাপাশি উদার, প্রগতিশীল ও উজ্জ্বল চিন্তার অধিকারী এ তরুণ আলেমেদীন শুধু নিজের সাফল্য ও ভবিষ্যৎ নিয়েই ভাবেন না, বরং আরো বেশি ভাবছেন দেশ, জাতি ও সমাজ নিয়ে। কারণ ব্যক্তি উন্নয়নের চেয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে তিনি বেশি আন্তরিক। তাই সামাজিক ময়দানেও তিনি কাজ করে যাচ্ছেন অবিরামভাবে। একজন আলেমের কাছ থেকে যা অন্তত আমাদের সমাজের অনেক বড় পাওয়া। আর এসবের কারণে ইতোমধ্যেই নিজ এলাকায় তিনি সমাজসেবক ও শিক্ষাবিদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। মাদরাসা ও সাধারণ উভয় ধারার ডিগ্রিধারী এ তরুণ আলেমেদীন সমাজের তৃণমূল পর্যায়ে ইসলামী শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর থানায় নিজ এলাকায় ছেলে ও মেয়েদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন পৃথক পৃথক মাদরাসা ও এতিমখানা। এ ছাড়াও কুষ্টিয়ার মিরপুর-ভেড়ামারার বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও এতিমখানার সঙ্গে জড়িত আছেন তিনি। নিজের প্রতিষ্ঠিত ‘সাবীলুল হুদা এডুকেশন ফাউন্ডেশন’-এর মাধ্যমে সমাজের গরিব, দুঃখী ও অসহায় মানুষের পাশে সাধ্যমতো দাঁড়াচ্ছেন মাওলানা ফারুকী। সমাজের প্রতিটি পর্যায়ে শিক্ষা ও ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিতে একজন আলোকিত সমাজসেবক হিসেবে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। ফলে মিরপুর-ভেড়ামারার সাধারণ জনগণ তাকে নিয়ে ইতোমধ্যে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন।

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads