• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
ইসলামে জননিরাপত্তা

প্রতীকী ছবি

ধর্ম

ইসলামে জননিরাপত্তা

  • প্রকাশিত ০৭ ডিসেম্বর ২০১৮

নিরাপত্তা মানুষের মৌলিক অধিকার। নিরাপদ পরিবেশ আল্লাহতায়ালার একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামত। সুরা কোরাইশে আল্লাহপাক কোরাইশদের প্রতি তাঁর দেওয়া দুটি নিয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন : যিনি তাদের ক্ষুধায় আহার দিয়েছেন এবং যুদ্ধভীতি থেকে তাদের নিরাপদ করেছেন। রসুল (সা.)-এর একটি হাদিসে বর্ণিত আছে, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে কি-না তার দিনটি শুরু করে এ অবস্থায় তার গৃহ নিরাপদ, সে স্বাস্থ্যের দিক থেকে সুস্থ এবং সেদিনের প্রয়োজনীয় রিজিক (খাবার) তার কাছে রয়েছে, তবে যেন সব কল্যাণই সে পেয়েছে।’ (তিরমিজি) এ হাদিসে তিন ধরনের নিরাপত্তার কথা এসেছে : সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও সুস্বাস্থ্যের নিরাপত্তা। সুস্বাস্থ্যের নিরাপত্তা বলতে মানুষের শারীরিক ও মানসিক উভয় স্বাস্থ্যই আসে। মূলত এ বিষয়গুলোই একটি সুস্থ, সুখী ও কল্যাণকর সমাজ এবং রাষ্ট্রের মূল উপাদানের সঙ্গে যোগ হতে পারে মানুষের সম্মানের নিরাপত্তা। এ সম্পর্কে রসুল (সা.) বলেন, যে বড়দের সম্মান করে না ও ছোটদের স্নেহ করে না, সে আমার দলভুক্ত নয়। সে সত্যিকারের মুসলিম, যার হাত ও জিহ্বার অনিষ্ট থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ। রসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় পৌঁছে একটি সংঘবদ্ধ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন, যার অন্যতম লক্ষ্য ছিল আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবজীবনকে সুশৃঙ্খল করা এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা। জনগণের জীবনের নিরাপত্তার ব্যাপারে ইসলামের প্রধান দুটি মূলনীতি হলো : এক. ইসলাম মানবজীবনকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান মনে করে। দুই. জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করাকে ইসলাম একটি বড় অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। ইসলামের পরিভাষায় ‘ফাসাদ ফিল আরদ’ অর্থাৎ পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করা কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিদায় হজের বাণীতে রসুল (সা.) বলেছেন, হে লোক সকল! তোমাদের পরস্পরের জানমাল ও সম্মান পরস্পরের জন্য কিয়ামত পর্যন্ত এই নগরী, এই মাস ও এই দিনের মতো হারাম সাব্যস্ত করা হলো। আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, সে প্রাণকে হত্যা করো না, যাকে আল্লাহ হারাম করেছেন; কিন্তু ন্যায়ভাবে। (সুরা বনি ঈসরাইল, ৩৩)

এক ব্যক্তি বিশ্বাসী বা মুমিন হলেই এ নীতির আওতায় পড়বে। যে ব্যক্তিই (কালেমা) উচ্চারণ করবে এবং মুখে এই কথা স্বীকার করে নেবে ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই; হজরত মোহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রসুল’, তার ক্ষেত্রেই কোরআনের এই নীতি প্রযোজ্য হবে। উন্নত মনের মুমিন, মুত্তাকি বা মুহসিন হতে হবে এমন কোনো শর্তারোপ এখানে করা হয়নি। হজরত উসামা ইবনে জায়েদ (রা.) একবার যুদ্ধে এক কাফেরকে পরাস্ত করে মাটিতে ফেলে দিলেন এবং তলোয়ার উঁচু করলেন। এ অবস্থায় ওই ব্যক্তি কলেমা পাঠ করল। কিন্তু উসামা (রা.) ব্যক্তিটিকে হত্যা করলেন। ঘটনাটি জেনে রসুল (সা.) অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন এবং বললেন, ‘উসামা, তুমি লোকটি কলেমা পাঠ করার পরও তাকে হত্যা করলে?’ হজরত উসামা (রা.) বললেন, ‘হে আল্লাহর রসুল! লোকটি তলোয়ারের ভয়ে কলেমা পাঠ করেছে (অর্থাৎ অন্তর থেকে মেনে না নিয়ে বরং মৃত্যু থেকে বাঁচার জন্য কলেমা পাঠ করেছে)। রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তুমি কি তার অন্তর চিরে দেখেছিলে?’ কাজেই একজন ব্যক্তি যতক্ষণ নিজেকে মুসলমান বলে পরিচয় দেয়, ততক্ষণ তাকে মুসলমান বিবেচনা করেই তার সঙ্গে আচরণ করতে হবে। ইসলাম মানবজীবনকে এতটাই পবিত্র মনে করে, অন্যের জীবন তো নয়ই নিজের জীবন নিজে হরণ করাকেও (আত্মহত্যা করা) ইসলাম হারাম করছে। আর তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহপাক তোমাদের প্রতি দয়ালু। আর যে কেউ সীমা লঙ্ঘন বা জুলুমের বশে এরূপ করবে তাকে খুব শিগগিরই আগুনে নিক্ষেপ করা হবে। (সুরা নিসা ২৯-৩০)

ইসলাম একটি মুসলিম দেশে বসবাসকারী অমুসলিম সম্প্রদায়কে বোঝাতে ‘জিম্মি’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। জিম্মি শব্দটির অর্থ সংরক্ষিত জনগোষ্ঠী। আগে মুসলিম দেশে অমুসলিম গোষ্ঠী বসবাস করতে হলে চুক্তিতে আবদ্ধ হতে হতো। এজন্য এদের চুক্তিবদ্ধ জনগোষ্ঠীও বলা হয়। বর্তমানে আধুনিক ব্যবস্থায় কোনো লিখিত চুক্তির প্রয়োজন পড়ে না। জন্মসূত্রে বা অন্য কোনো উপায়ে যখন সে নাগরিকত্ব লাভ করে, তখনই সে জিম্মি অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ‘জিম্মি’র সব অধিকার লাভ করে অর্থাৎ মানবাধিকার সংজ্ঞায় যেসব অধিকার রয়েছে তা মুসলিম ও জিম্মিরা সমভাবে ভোগ করবে, বিশেষত নিরাপত্তার অধিকার। জিম্মিদের প্রতিবেশী হিসেবে আশ্রয় দেওয়া ও নিরাপত্তা দেওয়া মুসলমানদের দায়িত্ব। এ বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করা, তাদের সম্মানহানি করা, আঘাত দেওয়ার অর্থ হলো আল্লাহর দেওয়া শর্ত ভাঙা, রসুল (সা.) ও ইসলামের শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাওয়া।

জিম্মি ছাড়াও আরো একধরনের মানুষ (অমুসলিম) রয়েছেন  যারা মুসলিম দেশের সঙ্গে সাময়িক বা অস্থায়ী চুক্তিবদ্ধ। যেমন- সেসব ব্যক্তি যারা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বা অন্য কোনো কাজে মুসলিম দেশে প্রবেশ করেন। মুসলিম দেশগুলো যখন ভিসা প্রদান করে তখনই ওই ব্যক্তিদের সঙ্গে অলিখিত নিরাপত্তা প্রধানের চুক্তি করে। ফলে মুসলিম উম্মাহর কর্তব্য হয়ে পড়ে ওইসব বিদেশি ব্যক্তি এবং ট্যুরিস্টের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করা। হত্যা তো নয়ই বরং নিরপরাধ মানুষকে ভয় দেখানো বা ভীতসন্ত্রস্ত করাও ইসলামে নিষিদ্ধ। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘একজন সত্যিকারের ঈমানদার সে, যার কাছ থেকে মানুষ তার জানমালের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরাপদ বোধ করে (ইবনে মাজা)। এ হাদিসে ‘মানুষ’ বলা হয়েছে। বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী সব ধরনের মানুষই ঈমানদারদের কাজ থেকে কোনো ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা নেই।

প্রকৃতপক্ষে ‘ইসলাম’ ও ‘শান্তি’ শব্দ দুটির উৎপত্তি একই শব্দ ‘সালাম’ থেকে। একজন মুসলিম অন্য মুসলিমের সঙ্গে সাক্ষাতে সর্বপ্রথম যে দোয়া বিনিময় করে তা হলো, ‘আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।’ মুসলমানদের বহু আকাঙ্ক্ষিত গন্তব্যস্থল বেহেশতকে বলা হয়েছে, ‘দারুসসালাম’ বা শান্তির আবাসস্থল।  ইসলাম সমগ্র সৃষ্টিকুলের নিরাপত্তা বিধানের একমাত্র রক্ষাকবচ।

লেখক : কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads