• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
নফসে মুতমাইন্নার পরিচয় ও অর্জনের বিধি

প্রতীকী ছবি

ধর্ম

নফসে মুতমাইন্নার পরিচয় ও অর্জনের বিধি

  • প্রকাশিত ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮

নফস বা আত্মা মহান আল্লাহর এক বিস্ময়কর ও রহস্যময় সৃষ্টি। আল্লাহতায়ালা মানুষকে তিনটি বিশেষ উপাদান দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। সেগুলো হলো জ্ঞান, দেহ ও আত্মা। জ্ঞানকে দিকনির্দেশনা দেয় ঈমান, দেহের কল্যাণ সাধন করে ইসলাম এবং আত্মার পরিশুদ্ধি নিশ্চিত করে ইহসান। একজন মানুষের পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠা এ উপাদানগুলোর সুষম সমন্বয়ের ওপর নির্ভরশীল। এগুলোর মধ্যে সর্বাধিক কঠিন বিষয় হলো ইহসান। আত্মার পবিত্রতা অর্জনের সঙ্গেই ইহসান সম্পৃক্ত। আত্মার স্বরূপ নিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এতটুকুই বলেছেন যে, এটি মহান আল্লাহর একটি হুকুম। স্রষ্টার পক্ষ থেকে নাজিলকৃত এ তাৎপর্যময় হুকুমের পবিত্রতা রক্ষা করাই মানুষের প্রধান কর্তব্য। এ কর্তব্য পালনই মানুষকে পূর্ণতার পথে নিয়ে যেতে পারে। এ জন্য ব্যক্তির মাঝে ‘তাজকিয়াতুন নফস’ বা আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি সাধন করা ইসলামের মৌলিক লক্ষ্য। আত্মার মূলত দুটি প্রবৃত্তি রয়েছে— সুপ্রবৃত্তি এবং কুপ্রবৃত্তি অথবা বলা চলে বুদ্ধিবৃত্তি ও জীববৃত্তি। সুপ্রবৃত্তি মানুষকে ন্যায়, সৎ ও সঠিক পথ নির্দেশ করে; অন্যদিকে কুপ্রবৃত্তি মানুষকে অন্যায়, অসৎ ও বিপথে পরিচালিত করে। মহাগ্রন্থ আল কোরআন হলো আল্লাহর বাণী। সৃষ্টি জগতে এমন কোনো বিষয় নেই, যা পবিত্র কোরআনে পরিব্যক্ত হয়নি। মন-আত্মা, রুহ বা নফসসংক্রান্ত বিষয়েও এখানে আলোচিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনে মানুষের নফস বা অন্তরের তিন ধরনের প্রকৃতি উল্লেখিত হয়েছে-

ক. নফসে আম্মারা : কুপ্রবৃত্তিমূলক আত্মা তথা আত্মার প্রথম স্তর বা মোকাম। একে শয়তানি বা অবাধ্যকারী বা আল্লাহ কর্তৃক অভিশপ্ত আত্মাও বলা হয়ে থাকে; কিন্তু মনে রাখতে হবে এ জীবাত্মাই সব আত্মার মা বা জননী। কারণ এ জীবাত্মার গর্ভেই বাকি আত্মা অবচেতন এবং অচৈতন্য অবস্থায় বিরাজ করে। সাধকের কঠোর সাধনা ও এবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে উন্নতি হয়ে ঊর্ধ্বস্তর প্রাপ্ত হয়। পবিত্র কোরআনে সুরা ইউসুফে ২৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে— ‘নিশ্চয়ই মানুষের মন মন্দকর্মপ্রবণ।’

খ. নফসে লাওয়ামাহ : বিবেকতাড়িত বা তিরস্কারকারী আত্মা (যা নফসে আম্মারাকে তিরস্কার করে), যাকে ইনসানিয়াত বা Humanity বলা হয়। একে ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্যকারী আত্মাও বলা হয়, এটা নফসে আম্মারার বা 'Improve' বা উন্নত অবস্থা বা স্তম্ভকে বোঝায়। এ মানুষ আত্মার কারণেই আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীবে পরিণত হয়েছে। সূরা কিয়ামাহর ২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘ওয়ালা উকসিমু বিন্নাফসিল লাওয়ামাহ’ অর্থাৎ আরও শপথ করি সেই আত্মার যে ধিক্কার দেয়।’

গ. নফসে মুতমাইন্না : প্রশান্ত আত্মা বা প্রফুল্ল চিত্ত, যাকে জান্নাতি আত্মাও বলা হয়। ইহা নফসে লাওয়ামার ঊর্ধ্বস্তর। যে আত্মা সম্পর্কে সুরা ফজরের ২৭ থেকে ৩০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি তোমার পালনকর্তার কাছে ফিরে যাও সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। অতঃপর আমার প্রিয় বান্দাদের দলে শামিল হয়ে যাও। আর আমার অনন্ত জান্নাতে প্রবেশ করো।’ এসব আয়াতে স্বভাবত যেসব প্রশ্ন উদয় হয় : ক. প্রশান্ত আত্মা বলতে কী বোঝায়? খ. এ আত্মার অবসান আসলে কোথায়? গ. এ আত্মা কার সংস্পর্শে থাকে?

ঘ. জান্নাত কী :  আমরা বলব, প্রশান্ত আত্মা হচ্ছে উল্লেখিত তিন আত্মার সর্বোচ্চ ধাপ। এ স্তরে আত্মা থাকে সব ধরনের কলুষতা থেকে মুক্ত, বিশুদ্ধ ও পবিত্র। পশুবৃত্তি ও জীববৃত্তি এবং সব ধরনের কুপ্রবৃত্তি এখানে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল হয়ে যায়। বুদ্ধি ও বিবেকের প্রাধান্য এখানে অত্যন্ত প্রবল। শুধু তা-ই নয়, ঐশী বা পরমাত্মার জ্যোতিতে বুদ্ধিও এ পর্যায়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এ হচ্ছে নির্মোহ আত্মা। ঈমান, বিশুদ্ধ আকিদা ও আমলে সালেহার সমন্বয়ে সাধক এ পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেন। আল্লাহর গভীর ধ্যান ও প্রেমই হচ্ছে এ আত্মার বৈশিষ্ট্য— আল্লাহর জিকর ও স্মরণ ছাড়া এ আত্মায় আর কিছুই থাকে না। সাধক যখন তার ইবাদতের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন এবং তার ইবাদতে আল্লাহও পরিতুষ্ট হন তখন তা প্রশান্ত মন বা প্রশান্ত চিত্ত হয়ে যায়।

আল্লাহ এ ধরনের আত্মাকেই নির্দেশ দেন তার মূলে ফিরে যেতে অর্থাৎ যেখান থেকে তার আগমন (মহান আল্লাহর পানে— পরমাত্মায়)। তিনি আরো নির্দেশ দেন, আল্লাহর পছন্দিত আত্মার সঙ্গে এরা যেন বসবাস করে, সংসর্গ করে- সে-ই প্রকৃত আবাসস্থল জান্নাতে। আল্লাহ রূহকে নিজের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করেছেন। কোনো উপকরণ ছাড়া মানবাত্মা আল্লাহর আদেশে সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে আল্লাহর জ্যোতি বা নূর গ্রহণ করার যোগ্যতা রয়েছে, যা মানুষ ছাড়া অন্য কোনো জীবাত্মার নেই। মানব সৃষ্টির উপকরণ ১০টি— পাঁচটি সৃষ্ট জগতের আর পাঁচটি আদেশ জগতের। সৃষ্ট জগতের উপাদান হচ্ছে— আগুন, পানি, মৃত্তিকা, বায়ু এবং পঞ্চমটি হচ্ছে এদের থেকে সৃষ্ট সূক্ষ্ম বাষ্প যাকে মর্ত্যজগতে রুহ বা নফস বলা হয়। আদেশ জগতের পাঁচ উপকরণ হচ্ছে— কলব, রুহ, শির, খফি ও আখফ। এসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পরও আত্মার স্বরূপ উদঘাটন সহজসাধ্য নয়। এ প্রকৃতই এক রহস্যময় বিষয়। পবিত্র কোরআনে এ  রহস্যকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ রসুল (সা.)-কে উদ্দেশ করে বলেন— ‘তারা আপনাকে রুহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলে দিন— রুহ আমার পালনকর্তার আদেশে গঠিত। এ বিষয়ে তোমাদের সামান্য জ্ঞানদান করা হয়েছে (সুরা ইসরা : ৮৫)। আসলে মানুষকে আত্মা সম্পর্কে অতি অল্প জ্ঞানদান করা হয়েছে।

এ স্তরে পৌঁছার পদ্ধতি : ১. হালাল-হারাম সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান অর্জন করে জীবনের সবক্ষেত্রে হালাল-হারাম বাছাই করে চলার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করা, ২. আত্মাকে বিভিন্ন উত্তম চরিত্র দ্বারা পরিমার্জন ও পরিশোধন করা, ৩. ফরজ ইবাদতগুলো নিয়মিত আদায় করা, ৪. অধিকমাত্রায় নফল ইবাদত করা, ৫. পবিত্র কোরআন পাঠ করা ও তাতে চিন্তা-গবেষণা নিয়োজিত করা, ৬. সৎসঙ্গ নিশ্চিত করা, ৭. তওবা ৮. আল্লাহর স্মরণ করা ও ক্ষমাপ্রার্থনা করা, ৯. দোয়া করা, ১০. আমলকে রিয়া (লোকপ্রদর্শনী) থেকে বিরত রাখা, ১১. আত্মসমালোচনা, ১২. কম ঘুমানো, কম খাওয়া ও কম কথা বলা, ১৩. ধৈর্য ও দৃঢ়বিশ্বাসের গুণ দ্বারা সুশোভিত হওয়া, ১৪. প্রবৃত্তির কঠোর বিরুদ্ধাচরণ করা ও অসৎ চিন্তাকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় না দেওয়া।

 

মুফতি ওসমান গনি সালেহী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads