• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
বিয়েকে প্রেমময় করে মোহরানা

ছবি : সংগৃহীত

ধর্ম

বিয়েকে প্রেমময় করে মোহরানা

  • প্রকাশিত ১১ জানুয়ারি ২০১৯

মোহরানা স্ত্রীর প্রাপ্য অধিকার। শুধু ইসলামেই মোহরানার বিধান রয়েছে। বিয়েবন্ধনে স্ত্রীর ওপর স্বামীত্বের অধিকার লাভের বিনিময়ে স্বামীকে যে অর্থ-সম্পদ আদায় করতে হয়, তা-ই মোহরানা। মোহর প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ঘোষণা হয়, ‘আর তোমরা স্ত্রীদের তাদের মোহর দিয়ে দাও সন্তুষ্ট চিত্তে’ (৪ : নিসা)। মোহরানা নামাজ-রোজার মতো যেমন বুনিয়াদি ফরজ নয়, তেমনি মোহরানা স্বামীর করুণা বা সামাজিক কোনো ট্র্যাডিশনও নয়। বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মেয়েকে মোহরানা দেওয়ার অঙ্গীকারে বিয়ে করেছে কিন্তু সে মোহরানা আদায় করার ইচ্ছে তার নেই, কিয়ামতের দিন ওই ব্যক্তি আল্লাহর সামনে জেনাকার- ব্যভিচারী হিসেবে দাঁড়াতে বাধ্য হবে।’ (মুসনাদে আহমদ)

মোহরানা শুধু স্ত্রীর একান্ত প্রাপ্য। কারো ওপর বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার জন্য মহান প্রভু মোহরানার বিধান করেননি। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ কারো ওপর তার সাধ্যাতীত দায়িত্ব অর্পণ করেন না।’ (২ : ৮৬)। তাই বলা চলে, মোহরানার বিষয়ে কোনো প্রকার চাপ বা জুলুম কোনোক্রমেই বৈধ নয়। সুরা নিসার ২৪ নং আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের জন্য কোনো অপরাধ হবে না, যদি মোহর নির্ধারণের পরও তোমরা পরস্পর (তা কম-বেশি করার ব্যাপারে) সম্মত হও।’ অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সমঝোতা বা সিদ্ধান্তে মোহরানা পুনর্নির্ধারণও বৈধ, যদি তাতে তৃতীয় পক্ষের চাপ বা প্ররোচনা না থাকে।

আমাদের সমাজে কোরআন-সুন্নাহকে পাশ কাটিয়ে কিংবা নিজেদের সুবিধামতো কিছু সংযোজন-বিয়োজন করে মনগড়া বিভ্রান্ত কিছু রীতি প্রচলিত রয়েছে, যা ইসলামী বা মুসলিম আইন হিসেবে সাব্যস্ত হওয়ার নয়। আমাদের জন্য কোরআন, হাদিস, ইজমা ও কেয়াসের আইনই যথেষ্ট। এসবের বাইরে পথ চলা ইসলামসম্মত নয়। আর যারা ইসলামী বিধান মেনে চলে, কেবল তারাই আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত দান, সুবিধা ও নেয়ামত ভোগের যোগ্য। মোহরানাও নারীর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত দান, বিশেষ একটি নেয়ামত। মোহরানাকে পুরুষ শোষণের হাতিয়ার বা সামাজিক মর্যাদার দৃষ্টিকোণ বিবেচনার বিষয় নয়।

কোনো কারণে স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ হলে কাজীকে ঘুষ দিয়ে বা অন্য যে কোনো প্রলোভন দেখানোর মাধ্যমে জালিয়াতি করে মোহর বেশি দেখিয়ে নকল বের করার মাধ্যমে স্বামীপক্ষকে ফাঁদে ফেলে জুলুম বা মামলার মাধ্যমে অতিরিক্ত কিছু টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রবণতাও আমাদের সমাজে নজরে আসে। এমনটি গর্হিত অন্যায়, সুদের চেয়ে জঘন্য পাপের কাজ। এভাবে আদায়কৃত (সত্য মোহরানার অনাদায়ীর অতিরিক্ত) অর্থ হারাম। সমাজবাসীদের অনেকেই সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির কথা বেবে নিজের সাধ্যের বাইরে মোটা অংকের মোহর ধার্য করে, আদায়ের সদিচ্ছা থাকে না। আবার অনেক ক্ষেত্রে কনে পক্ষ ভবিষ্যতে স্বামী যদি স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেয় এই কথা ভেবে সুকৌশলে মোটা অঙ্কের কিছু টাকা মোহর হিসেবে কাবিননামায় লিখিয়ে নেয়, যাতে করে ভবিষ্যতে তালাকের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা ঘটলে প্রয়োজনে আইনের আশ্রয় নিয়ে হলেও স্বামীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের কিছু অর্থ বা সম্পদ হাতিয়ে নেওয়া যায়। উল্লেখিত দুটি পর্যালোচনার একটিও যদি মোহরের ক্ষেত্রে (নির্ধারণকালে) প্রকাশ্য কিংবা গোপনে প্রযোজ্য হয়, তাহলে সেই বিয়ে কোনোমতেই বৈধ হবে না। ইসলামে লোকদেখানো ট্র্যাডিশন বা প্রতারণার স্থান নেই। এমনটি করা কবিরা গুনাহ।

পারস্পরিক সমঝোতা এবং সামর্থ্যের মধ্যে মোহরানা নির্ধারণ করা মহানবীর (সা.) শিক্ষা। মোহরানা নিয়ে টালবাহানা করা গুরুতর অপরাধ। মোহরানা প্রথাগত ব্যাপার বা তালাকের প্রতিবন্ধক হাতিয়ার নয়। আবার অনেকে কৌশলে বাসর রাতে স্ত্রীর কাছ থেকে মোহরানা মাফের স্বীকারোক্তি নিয়ে নেয় (!)। নারীর লজ্জা, স্বভাব এবং দুর্বলতার সুযোগে মোহরানা মাফ করিয়ে নেয়া আর রাতের অন্ধকারে কারো বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে সর্বস্ব ছিনিয়ে নেওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকার কথা নয়। তাছাড়া অলংকার ও সাজানি বাবদ কাবিননামায় হেরফের দেখিয়ে ১৫ হাজারের স্থলে ২৫ হাজার টাকা উসুল দেখানো প্রতারণার ভিন্ন একটি পদ্ধতি বৈ অন্য কিছু নয়।

স্ত্রী তার স্বামীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার আগেই মোহরানা পাওনা হন, অবশ্য স্ত্রী সময় দিলে বাকি চলে। মোহর আদায় না করলে স্ত্রীর কাছে ঋণী থাকতে হবে। স্ত্রী খুশি মনে মাফ না করলে স্বামীর মৃত্যু হলে স্বামীর পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে আদায় করে নিতে পারবে। স্ত্রী যতটুকু মোহর নিজ খুশিতে মাফ করে দেয়, ঠিক ততটুকুই মাফ হয়ে যাবে। কিন্তু স্বামী যদি স্ত্রীকে ধমক বা ভয় দেখিয়ে বা অন্য কোনো কৌশলে মোহর মাফ করিয়ে নেয় তবে তাতে মোহর মাফ হবে না। এমতাবস্থায় মোহর আদায় করা স্বামীর জন্য ওয়াজিব। খাদ্যদ্রব্য বা পচনশীল দ্রব্য ছাড়া নগদ অর্থ, সম্পদ বা অন্য কিছু স্ত্রীকে দিয়ে যদি স্বামীর ঘোষণায় মোহর হিসেবে দিয়েছে বলে প্রকাশ পায় তবে তা গ্রহণযোগ্য। এমনকি মোহরের নিয়তে স্বামী যদি স্ত্রীকে কোনো জিনিস বা টাকা দেয় তবে তা মোহর থেকে কাটা যাবে— যদিও স্ত্রীকে বিষয়টি জানানো হয়নি।

বিয়ে পবিত্র বন্ধন, মোহরানা নির্ধারণ বিয়ের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। বিয়ে বা মোহরানা বিষয়ে প্রতারণার আশ্রয় নিলে বিয়ে বৈধ না হওয়ার সমূহ আশঙ্কা থেকে যায়। বৈধ দাম্পত্য জীবনের পূর্বশর্ত হচ্ছে বৈধ বিয়ে। বিয়ে বৈধ হলেই দাম্পত্য জীবন বৈধ হবে, স্বামী-স্ত্রীর মিলনে জন্ম নেওয়া সংশ্লিষ্ট সন্তানও বৈধ হবে। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের বিভ্রান্তি বা নিয়তে গলদের কবল থেকে হেফাজত করুন। আমিন।

 

সৈয়দা রাকীবা ঐশী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads