• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
মাদকাসক্তি : সামাজিক অবক্ষয় এবং আমাদের করণীয়

ছবি : সংগৃহীত

ধর্ম

মাদকাসক্তি : সামাজিক অবক্ষয় এবং আমাদের করণীয়

  • মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ
  • প্রকাশিত ১৮ জানুয়ারি ২০১৯

ইসলাম শান্তির ধর্ম। আহ্বান করে সম্প্রীতির দিকে, ঐক্যের বন্ধনে। মানবজীবনের পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা রয়েছে ইসলামেই। পরামর্শ দেয় অশান্ত, বিশৃঙ্খল ও অশালীন জীবনযাত্রা থেকে দূরে থাকার। বিভিন্ন অপকর্ম ও অশ্লীলতা থেকে বারণ করে। বর্তমান সমাজ বহু সমস্যায় জর্জরিত। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষবাষ্পের মতো প্রবেশ করছে জীবনবিনাশী মাদকাসক্তি। নেশাকে সর্বনাশা জেনেও মানুষ এই নীল দংশনে দংশিত হচ্ছে প্রতিক্ষণ। সুচিন্তিত পরিকল্পনা, সমবেত প্রয়াস এবং সদিচ্ছার মাধ্যমে সামাজিক ও অনৈতিক সমস্যাগুলোর সমাধান হতে পারে; কিন্তু কালকেউটের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন ব্যাপার। বিনাশের নীল নেশায় সমাজজীবন আজ বিপর্যস্ত। দুর্নীতি আশ্রিত কালনাগিনীর বিষ বাংলার শিরা-উপশিরায় যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, তা যদি রোধ না করা যায়, তাহলে অচিরেই এ হতভাগ্য জাতিকে পুনরুজ্জীবিত করার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।

মাদকাসক্তি

সাধারণত যেসব দ্রব্যসামগ্রী পান, গ্রহণ ও ব্যবহার করলে নেশা সৃষ্টি হয়, সেসব জিনিস নিয়মিত সেবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়াকে মাদকাসক্তি বলে। অন্য কথায় নেশাজাতীয় দ্রব্যসামগ্রী যা চিত্ত বিভ্রমকারী, তা গ্রহণ করার আগ্রহই মাদকাসক্তি। মাদকদ্রব্য ব্যবহারে মানুষ শুধু নেশাগ্রস্ত হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে তা নয়; বরং মানুষকে একজন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য পশুতে রূপান্তরিত করে দেয়।

মাদকাসক্তির কুফল

মানুষ যখন বিভিন্ন প্রতিকূলের কারণে নেশায় জড়িয়ে পড়ে, তখন কি সে চিন্তা করে এর শেষ পরিণাম কী? সামনে তার কত অশান্তি ভোগ করতে হবে। মাদকাসক্তি সামান্য তৃপ্তি আর শান্তি দেয়; কিন্তু এ শান্তি কি প্রকৃত শান্তি? এ তৃপ্তি কি প্রকৃত তৃপ্তি? কখনো নয়। কিন্তু কেন আমরা এ কৃত্রিম শান্তি আর তৃপ্তির পেছনে ছুটছি সবাই? আসুন, দেখে নিই বিভিন্ন ক্ষেত্রে মাদকাসক্তির কুফল।

১. ধর্মীয় কুফল : আল্লাহতায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন কেবল তার ইবাদত ও তাঁকে স্মরণের জন্য। কিন্তু তাঁর এ মহান উদ্দেশ্য অর্জনে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মাদকাসক্তি। মাদকাসক্তি মানুষকে নামাজ, রোজা ও অন্যান্য ইবাদত নেক কাজ তথা সর্বক্ষণ আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে রাখে। লিপ্ত করে পাপাচার, অশ্লীলতা, হাইজ্যাক, পতিতাবৃত্তি, স্মাগলিং ও মাদকদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয়ের মতো সমাজের জঘন্যতম বিকৃত কাজে।

২. দৈহিক কুফল : মাদকাসক্তি মানবদেহে অত্যন্ত মারাত্মক প্রভাব ফেলে। মাদকদ্রব্য সেবনের ফলে হজমশক্তি লোপ পায়, ক্ষুধামন্দা, পাকস্থলীতে ঘা, স্নায়ু দুর্বলতা, হূৎপিণ্ডের দুর্বলতা, লিভার ও কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। শিরা-ধমনির শক্তি ক্ষয় হয় এবং অকালে বার্ধক্য আসে। এ ছাড়া আরো অনেক দৈহিক কুফল দেখা দেয় এ কারণে।

৩. মানসিক কুফল : মানুষের বিবেক বুদ্ধি ও মস্তিষ্কের ওপর মাদকাসক্তির প্রতিক্রিয়া মারাত্মক ও ক্ষতিকর। এতে নিস্তেজ হয়ে পড়ে মস্তিষ্কের উচ্চতর বুদ্ধিবৃত্তির স্তর। ব্যক্তি হয়ে পড়ে মাতাল ও লজ্জাহীন। একপর্যায়ে চেতনাশক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে।

৪. সামাজিক কুফল : মাদকাসক্তি শুধু মানবতা ও নৈতিকতাবিরোধী কার্যকলাপের দিকেই উদ্বুদ্ধ করে না; বরং মানুষকে যাবতীয় মন্দ ও ঘৃণ্যতর কাজের দিকেও ধাবিত করে। আমাদের প্রিয় রসুল (সা.)-এর ভাষায় ‘মাদকাসক্তি সব অপকর্ম ও অশ্লীলতার উৎস। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই সর্বনাশা অভিশাপের শিকার সমাজের সর্বস্তরের মানুষ।’

৫. অর্থনৈতিক কুফল : অর্থনৈতিক দিক দিয়েও মাদকাসক্তি বিপুল ক্ষতি করে থাকে। নেশার তাড়নায় সুরাসক্ত ব্যক্তি নিজের সর্বস্ব বিক্রি করেও ক্ষান্ত হয় না। পরিবার-পরিজন থেকে শুরু করে সমাজের আরো দশজনের টাকা পয়সা লুটপাট করে জাতীয় জীবনে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে টেনে আনে মারাত্মক ধস। এমনিভাবে মাদকাসক্তি প্রাচুর্যের অধিকারীকেও নিঃস্ব ও পথের ভিখারি করে তোলে। বিড়ম্বনা, হতাশা ও দুর্ভোগ তখন তার নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়।

প্রতিরোধ

পৃথিবীতে কোনো ধর্মই মাদকদ্রব্য ব্যবহার অনুমোদন করেনি আর ইসলামের দৃষ্টিতে সব ধরনের মাদকদ্রব্যের ব্যবহার একটি জঘন্য ধর্মীয় ও সামাজিক অপরাধ। গোটা বিশ্ব আজ মাদকবিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার। কত স্লোগান, বক্তৃতা, মিছিল, সভা-সেমিনার, কত আইনপ্রয়োগের ব্যবস্থা। নিজে মাদকাসক্ত হয়েও মাদকবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া ইদানীং ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে সংবিধানে মাদকদ্রব্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা, অপরদিকে লাইসেন্স প্রধান করে আবগারি শুল্ক ধার্য করা, সংবিধানের সঙ্গে এ যেন এক উপহাস, ছেলেখেলা বৈকি? কথায় বলে- ‘চোরকে কয় চুরি কর, গৃহস্থকে কয় সজাগ থাক।’ তাই এই ছেলেখেলা থেকে বাঁচার জন্য ইসলাম আজ থেকে সাড়ে ১৫০০ বছর আগে পর্যায়ক্রমিক পদ্ধতিতে মাদকদ্রব্য গ্রহণ, ব্যবহার ও কেনাবেচা সম্পূর্ণ হারাম বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘মানুষ তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, বলো দুটোই বড় পাপের কাজ এবং মানুষের জন্য তাতে তুচ্ছ উপকার থাকলেও অপকারই বেশি। (সুরা বাকারা : ২৯৯) অপর এক আয়াতে আল্লাহতায়ালা নির্দেশ দিলেন, ‘হে মমিনগণ! নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তোমরা নামাজের নিকটবর্তী হয়ো না। যতক্ষণ না তোমরা যা বলো তা বুঝতে পার।’ (সুরা নিসা : ৪৩) এ ব্যাপারে প্রিয়নবী (সা.) বলেন, ‘নেশাজাতীয় যে কোনো দ্রব্য মদের অন্তর্ভুক্ত। আর যাবতীয় মদই হারাম।’ (বুখারি শরিফ) প্রিয়নবী (সা.) আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি মদপান করে, যে মদপান করায়, মদের কেনাবেচায়, প্রস্তুতকারী আর যে প্রস্তুত করায়, যে ব্যক্তি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বহন করে, যার জন্য বহন করা হয় এবং যারা মদের লভ্যাংশ ভোগ করে- এদের সবার প্রতি মহান আল্লাহতায়ালার অভিশাপ রয়েছে। (মুসলিম শরিফ)

বর্তমানে আমাদের দেশে মাদক গ্রহণের প্রবণতা যে হারে বেড়ে চলেছে, তা দমনের জন্য কঠোর কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না হলে পুরো জাতি ধ্বংসলীলার শিকারে পরিণত হতে বাধ্য। কোরআনি তথা ইসলামী নীতি অবলম্বন করে মাদকাসক্তির করাল গ্রাস থেকে সমাজকে মুক্ত করতে হলে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির পক্ষ থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। দ্বিতীয়ত পরিবার প্রধানদের উচিত, তারা যেন নিজেদের সন্তান-সন্ততিকে মাদকদ্রব্যের ক্ষতি সম্পর্কে উত্তম প্রশিক্ষণ দান করেন এবং সতর্ক থাকেন যাতে তারা এ কুঅভ্যাসে কোনোমতেই লিপ্ত হতে না পারে। সর্বোপরি সন্তানদের যথাযথ ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে মাদকাসক্তির ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।

 

লেখক : শিক্ষা সচিব, বাইতুন নূর মাদরাসা, ঢাকা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads