• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ইসলাম

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ইসলাম

সংরক্ষিত ছবি

ধর্ম

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ইসলাম

  • এস. এ. মালিহা
  • প্রকাশিত ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

ইসলাম শান্তি-সম্প্রীতি ও মানবতার ধর্ম। কোনোরূপ সহিংসতা, বিবাদ-বিসংবাদের স্থান ইসলামে নেই। ন্যূনতম শান্তি-শৃঙ্খলা ও সম্প্রীতি বিনষ্ট হয় এমন আচরণকেও ইসলাম প্রশ্রয় দেয় না। পবিত্র কোরআন মজিদে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘ফিৎনা-ফাসাদ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও কঠিন অপরাধ।’ (সুরা বাকারা, আয়াত-১৯১) ‘পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের পর তাতে ফাসাদ সৃষ্টি করো না।’ (সুরা আ’রাফ, আয়াত-৫৬) অমুসলিমদের প্রতিও কোনো অন্যায় আচরণ ইসলাম অনুমোদন করে না। শান্তি-সৌহার্দ্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুরক্ষায় ইসলামের রয়েছে শাশ্বত আদর্শ ও সুমহান ঐতিহ্য। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর প্রতিটি আচরণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরল ও প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

মুসলিম জাহানের মহামান্য খলিফা হজরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) নিজে বাদী হয়ে এলেন কাজির দরবারে। বিবাদী একজন ইহুদি। আলী (রা.) দাবি করলেন, ইহুদির কাছে থাকা বর্মটা তার, ইহুদির নয়। কাজি সাক্ষী চাইলেন খলিফার কাছে। খলিফা সাক্ষী হিসেবে আপন ছেলে আর গোলামকে পেশ করলেন। কিন্তু স্বজনপ্রীতির সন্দেহে উভয়ের সাক্ষ্যকে অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করে ইহুদির পক্ষে রায় দিলেন কাজি। ঠিক তখনই ওই ইহুদি কালিমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেলেন। এর কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, আসলে ওই বর্ম আমার ছিল না। খলিফাতুল মুসলিমীন আলীর বর্মই কুড়িয়ে পেয়েছিলাম আমি। এতদ্সত্ত্বেও বাহ্যিক সাক্ষ্যের অভাবে প্রধান শাসনকর্তার বিরুদ্ধে ফয়সালা দেওয়া হয় যে আদর্শে, রাজায় প্রজায় ন্যায়ভিত্তিক সাম্য প্রতিষ্ঠা যে ধর্মের অনুশাসন- সে ধর্ম স্বাভাবিকভাবেই আমার হূদয়-গভীরে জায়গা করে নিয়েছে।

ইসলাম এভাবে জায়গা করে নিয়েছে বিপন্ন পৃথিবীর হূদয়ের গভীরে। সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত ছোবলে জর্জরিত বিপর্যস্ত পৃথিবীকে ইসলাম দিয়েছে অনাবিল শান্তি-সম্প্রীতির পথ্য। বংশানুক্রমিক কলহ আর বিদ্বেষ নিয়ে যুগের পর যুগ পার করা এই পৃথিবীতে ইসলাম জমিয়েছে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি এবং সাম্য ও প্রেমের মাহফিল। ইসলামের ইতিহাস কানায় কানায় ভরা সম্প্রীতি ও প্রেমের বাঁধনে গড়া অনন্য সব ঘটনা দিয়ে। যার নজির দাঁড় করাতে বরাবরই অপারগ হয়েছে এই পৃথিবী। অপারগ হয়েছে পৃথিবীর সব ইজম আর মতবাদ। মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর যে ‘মদিনা সনদ’ প্রণয়ন করেন, তা বিশ্ব ইতিহাসের সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান ও শান্তি-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার প্রথম উদ্যোগ। এই সনদে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাসহ সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা প্রদান সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য ধারাসমূহ সন্নিবেশিত হয়েছে।

এর একটি ধারায় বলা হয়েছে, ‘সনদে স্বাক্ষরকারী সব গোত্র-সম্প্রদায় মদিনা রাষ্ট্রে সমান অধিকার ভোগ করবে। সব ধর্মসম্প্রদায়ের স্ব-স্ব ধর্মকর্ম পালনে পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে। কেউ কারো ওপর কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করবে না। সন্ধিভুক্ত কোনো সম্প্রদায় বহিঃশত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে সম্মিলিতভাবে সবাই মিলে তার প্রতিরোধ করবে।’

এভাবে ঐতিহাসিক মদিনা সনদের মাধ্যমে ধর্মবর্ণ, জাতিগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবার মধ্যে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও সাম্য-মৈত্রীর সুদৃঢ় বন্ধন রচনা করে আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্রের অদ্বিতীয় নজির কায়েম করেছে ইসলাম। মুসলিম ও কোরাইশদের মধ্যে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক হুদায়বিয়ার সন্ধির বেশ কয়েকটি ধারা ছিল মুসলিম স্বার্থবিরোধী। এতদসত্ত্বেও সুদূরপ্রসারী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নবীজি এই চুক্তিতে সম্মত হলেন। শুধু তা-ই নয়, কোরাইশদের কথানুযায়ী নামের একটা অংশ ‘রসুলুল্লাহ’ কেটে দিলেন নিজ হাতে। আর প্রতিষ্ঠা করলেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও উদারতার অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত। এভাবে সম্প্রীতি ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠার অসংখ্য ঘটনায় ইসলাম ইতিহাসের পাতায় বিশাল জায়গা করে নিয়েছে।

ইসলামের নবী মোহাম্মদ (সা.), তদীয় সাহাবা ও খোলাফায়ে রাশেদিনের হাত ধরে ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীতে সম্প্রীতি ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠার যে সুমহান প্রণোদনা শুরু হয়েছিল, ইসলামের পুরো খেলাফতজুড়েই ছিল তার উপস্থিতি। ইতিহাস সাক্ষী— সাম্প্রদায়িক এই সম্প্রীতি না থাকলে ইউরোপের অর্থোডক্স চার্চের খ্রিস্টানদের দ্বারা নিপীড়িত অপরাপর খ্রিস্টান উপদলগুলো তৎকালীন উসমানি খেলাফতের অধীনে শান্তির আবাস খুঁজত না। উসমানি খলিফা সুলতান দ্বিতীয় মুরাদের নাম বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় স্বতন্ত্র মর্যাদায় লেখা আছে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব প্রজাকুলের জন্য তিনি ছিলেন কোমল হূদয়-দয়ালু।

আজকের পৃথিবীতে যখন অবৈধ দখলদার ইসরাইল পবিত্র আল-আকসা গ্রাস করে দখলদারিত্ব আর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে, তখন আল-আকসার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গির্জা আর প্যাগোডাগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির। মুসলিম শাসকরা ফিলিস্তিনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকা সত্ত্বেও সবাইকে আপন ধর্মকর্মে স্বাধীনতা দিয়েছেন। দিয়েছেন আল-আকসায় ধর্মীয় উপাসনার অবারিত সুযোগ। কিন্তু আজকের পৃথিবীতে আমরা কী দেখছি?

আমরা দেখছি, মানবাধিকারকে লাশে পরিণত করে তার কবর খোড়া হচ্ছে মহাউৎসবে। শহীদি রক্তে ভিজে উঠছে বার বার পৃথিবীর মাটি। জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ ও শত্রুতা অগ্নিশিখার মতো জ্বলছে। দেশে দেশে সীমান্তে সীমান্তে শত্রুতার আগুন, লেলিহান ধূম্রপুঞ্জ। ভাষিক, ভৌগোলিক ও নৃতাত্ত্বিক বিচ্ছিন্নতার বোধ থেকে তৈরি হচ্ছে দেয়ালের পর দেয়াল। মানুষ হয়ে চলেছে মানুষের প্রতিপক্ষ। ধ্বংস, উচ্ছেদ, জাতিগত নিধন, সন্ত্রাস ও অব্যাহত অবিচার চলছে ধর্মকে কেন্দ্র রেখে। নারী ও শিশুসহ নিরীহ মানুষকে উৎসব করে করে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হচ্ছে। কেটে করা হচ্ছে টুকরো টুকরো। জাতিবাদী ঘৃণা ও বর্ণবাদ নির্দেশিত এই অবিচার বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠা নিয়েই আজ বিদ্যমান। এক কথায় অশান্ত উদ্ভ্রান্ত এই পৃথিবীর জন্য বেঁচে থাকার কোনো অবলম্বন বাকি নেই। মানবতার জন্য নেই নিরাপদ কোনো ঠিকানা। পৃথিবী তাই হতাশ। ইথারে ইথারে নিরাশার বিবৃতি।

কিন্তু নিরাশার এই চাদর দীর্ণ করে একটি আওয়াজ বার বার বেজে উঠছে। মৃত্যু উপত্যকায় বারবার ছুটে আসছে একটি আহ্বান জীবনের আশ্বাস নিয়ে। একটি আহ্বান গোলাবারুদ আর ধ্বংসের রাজত্বে ভ্রাতৃত্বের সৌরভ বিতরণ করছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর বিদ্বেষের বিপরীতে সেই আহ্বানে কলকল করে ধ্বনিত হচ্ছে প্রেম, সৌহার্দ্য, সাম্য-সম্প্রীতির আহ্বান। এ আহ্বান যুগে যুগে পৃথিবীকে বাঁচিয়েছে বার বার। সেই আহ্বান ক্রমাগত ধ্বনিত হচ্ছে নির্জন নিভৃত হেরা গুহা থেকে। যে আহ্বান ভাষা পেয়েছে এই বলে- ‘ওয়াকুনু ইবাদাল্লাহি ইখাওয়ানা’ অর্থাৎ হে লোকসকল! এক আল্লাহর বান্দা হিসেবে তোমরা সবাই ভাই ভাই হয়ে যাও। তৃতীয় বিশ্বের মানুষ সত্যিকারার্থে যদি শান্তি চায়, মুক্তি চায়, তবে সাম্য ও সম্প্রীতির পবিত্র সেই আহ্বানে সাড়া দিতেই হবে।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads