• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯
শাবান মাসের ফজিলত ও ইবাদত

শাবান মাসের ফজিলত ও ইবাদত

ছবি : প্রতীকী

ধর্ম

শাবান মাসের ফজিলত ও ইবাদত

  • আবু রোকাইয়া
  • প্রকাশিত ০৫ এপ্রিল ২০১৯

ইসলাম ধর্মে চান্দ্রমাসের মধ্যে শাবান মাস হলো বিশেষ ফজিলতপূর্ণ। এ মাসে রয়েছে লাইলাতুল বরাতের মতো অত্যন্ত বরকতময় রজনী, যাকে বলা হয় মাহে রমজানের আগমনী বার্তা। শাবান মাস মূলত পবিত্র মাহে রমজানের প্রস্তুতির মাস। মানবজীবনের সব কালিমা দূর করার বিশেষত্ব নিয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের মাস রমজানুল মোবারক আসে শাবান মাসের সমাপ্তির পরই। তাই এ গুরুত্ববহ মাস সারা বিশ্বের মুসলমানদের সুদীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে যায়। তাই আসন্ন মাহে রমজানের মূল সিয়াম শুরু করার আগে শাবান মাসে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কিছু নফল রোজা রাখা দরকার, যাতে করে মাহে রমজানের রোজা পালন সহজ হয় এবং লক্ষ্যও ঠিকমতো অর্জিত হয়।

প্রতিবারের মতো শাবান মাস মুসলমানদের কাছে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মহিমান্বিত রমজান মাসের সওগাত নিয়ে আসে। রসুলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসে অন্যান্য মাসের তুলনায় বেশি বেশি নফল রোজা, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত ও নামাজ আদায় করে মাহে রমজানের পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, ‘নবী করিম (সা.) কখনো নফল রোজা রাখতে শুরু করলে আমরা বলাবলি করতাম, তিনি বিরতি দেবেন না। আর রোজার বিরতি দিলে আমরা বলতাম যে তিনি মনে হয় এখন আর নফল রোজা রাখবেন না। আমি রসুলুল্লাহ (সা.)-কে রমজান ছাড়া অন্য কোনো মাসে পূর্ণ এক মাস রোজা পালন করতে দেখিনি। কিন্তু শাবান মাসে তিনি বেশি নফল রোজা রেখেছেন’ (মুসলিম)। অন্য একটি হাদিসে বর্ণিত আছে, ‘শাবান মাস ছাড়া অন্য কোনো মাসে রসুলুল্লাহ (সা.) এত অধিক হারে নফল রোজা আদায় করতেন না’ (বুখারি)।

নবী করিম (সা.) হিজরি সনের শাবান মাসের গুরুত্ব, মাহাত্ম্য ও তাৎপর্যের বিবেচনায় এ মাসে অধিক হারে নফল ইবাদত-বন্দেগি করতেন। মাহে রমজানের মর্যাদা রক্ষা এবং হক আদায়ের অনুশীলনের জন্য রসুলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসে বেশি বেশি রোজা রাখতেন। এ সম্পর্কে হজরত আনাস (রা.) বলেছেন, নবী করিম (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘আপনার কাছে মাহে রমজানের পর কোন মাসের রোজা উত্তম?’ তিনি বললেন, ‘রমজান মাসের সম্মান প্রদর্শনকল্পে শাবানের রোজা উত্তম’ (তিরমিজি)। মাহে রমজানে দীর্ঘ ৩০টি রোজা পালনের কঠিন কর্মসাধনা সহজ ও নির্বিঘ্নে আদায় করার প্রস্তুতির ক্ষেত্রে শাবান মাসের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে ‘রসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয় মাসের একটি হলো শাবান। এ মাসে নফল রোজা আদায় করেই তিনি মাহে রমজানের রোজা পালন করতেন’ (আবু দাউদ)।

দেখা যায়, বেশ কয়েকটি হাদিসে শাবান মাসের মাহাত্ম্য সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ বিধৃত হয়েছে। হজরত উসামা বিন যায়েদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি নবী করিম (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রসুল! আপনাকে শাবান মাসে অন্যান্য মাস অপেক্ষা বেশি নফল রোজা রাখতে দেখি।’ এ কথা শুনে রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘রজব ও রমজানের মধ্যবর্তী এ মাস অনেকেই খেয়াল করে না। এটি এমন একটি মাস, যে মাসে মানুষের সব কর্মকাণ্ড আল্লাহর সামনে উপস্থাপন করা হয়। তাই আমি চাই এমন সময়ে আমার কর্মকাণ্ডের খতিয়ান আল্লাহর কাছে উপস্থাপন করা হোক, যখন আমি রোজা অবস্থায় রয়েছি’ (নাসাঈ ও আবু দাউদ)।

যারা শাবান মাসে নফল রোজা রাখতে চান, তাদের মধ্যভাগেই শেষ করে ফেলা উচিত। শাবান মাসের অর্ধেকের পর বেশি রোজা আর না রাখাই ভালো। মাহে রমজানের প্রস্তুতিকল্পে ইসলামে শাবান মাসকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়। হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ আছে যে ‘রসুলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসের চাঁদের কথা অধিক যত্নের সঙ্গে স্মরণ রাখতেন, যা অন্য মাসের বেলায় হতো না’ (মুসনাদে আহমাদ)।

একটি হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যখন মধ্য শাবানের রাত আগমন করে, আল্লাহতায়ালা স্বীয় বান্দাদের দিকে মনোযোগ দেন এবং মুমিন বান্দাদের ক্ষমা করেন, আর হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থায় ছেড়ে দেন (যতক্ষণ না তারা তওবা করে সুপথে ফিরে আসে)’ (বায়হাকি)। হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) বর্ণিত একটি হাদিসে রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা মধ্য শাবানের রজনীতে তার সৃষ্টির (বান্দাদের) প্রতি দৃষ্টি দেন এবং সবাইকে ক্ষমা করে দেন, তবে তারা ছাড়া যারা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করে এবং অপরকে ক্ষতিসাধনের বাসনা পোষণ করে’ (ইবনে হিব্বান)।

রসুলুল্লাহ (সা.) প্রায় গোটা শাবানে নফল রোজা পালন করতেন এবং অন্যদেরও বিশেষভাবে আমল করার উৎসাহ দিতেন। তাই বলা হয়, ‘রজব মাসে শস্য বপন করা হয়, শাবান মাসে ফসল কাটা হয় এবং রমজান মাসে ফসল কর্তন করা হয়।’ শাবান মাসের ফজিলত সম্পর্কে নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘রজব আল্লাহর মাস, শাবান আমার মাস এবং রমজান আমার উম্মতের মাস।’ শাবান মাসকে রমজান মাসের প্রস্তুতি ও সোপান মনে করে রসুলুল্লাহ (সা.) বিশেষ দোয়া করতেন এবং অন্যদের তা শিক্ষা দিতেন। রসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে শাবান মাসের মর্যাদা এতই বেশি যে, যখন তিনি এ মাসে উপনীত হতেন, তখন মাহে রমজানকে স্বাগত জানানোর উদ্দেশ্যে আল্লাহর কাছে অধিক হারে এই বলে প্রার্থনা করতেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাদের রজব ও শাবান মাসের বিশেষ বরকত দান করুন এবং আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন’ (মুসনাদে আহমাদ)। মহানবী (সা.)-এর এ দোয়ার মাধ্যমে সবার কাছে শাবান মাসের ফজিলত প্রতীয়মান হয়।

শাবান মাসে শবেবরাত নামে বিশেষ একটি রজনী আছে, যে রজনীতে বান্দার সারা বছরের আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয় এবং আগামী এক বছরের জন্য বান্দার হায়াত, মউত, রিজিক, দৌলত ইত্যাদির নতুন বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। যে কারণে শাবান মাসকে এত বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ মাসে মুসলমানদের আমল-আখলাক যেন সুন্দর হয়, রসুলুল্লাহ (সা.) সেদিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। শাবান মাসে ভারসাম্যপূর্ণ নেক আমলের তাগিদ দিয়ে রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের সাধ্যানুযায়ী আমল করবে, কেননা আল্লাহর কাছে প্রিয় আমল তা-ই যা সর্বদা পালন করা হয়’ (বুখারি)।

অতএব, পরম করুণাময় আল্লাহর অশেষ দয়া ও ক্ষমার দৃষ্টিলাভের আকাঙ্ক্ষায় শাবান মাসব্যাপী অন্যান্য মাসের তুলনায় অধিক পরিমাণে ইবাদত-বন্দেগি ও মধ্য শাবানের রজনীতে তওবা-ইস্তেগফার করে অতীতের সব গুনাহ থেকে মুক্ত হয়ে আল্লাহর আনুগত্য ও রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুমহান আদর্শ অনুসরণে নিজেদের জীবন পরিচালনার দৃঢ় প্রত্যয় ও শপথ গ্রহণ করা উচিত।

 

লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads