• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
শ্রম, শ্রমিকের মর্যাদা ও মে দিবস

শ্রম, শ্রমিকের মর্যাদা ও মে দিবস

প্রতীকী ছবি

ধর্ম

শ্রম, শ্রমিকের মর্যাদা ও মে দিবস

  • সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
  • প্রকাশিত ২৬ এপ্রিল ২০১৯

শ্রম আল্লাহ প্রদত্ত মানবজাতির জন্যে এক অমূল্য শক্তি ও সম্পদ। এ সম্পর্কে কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি মানুষকে শ্রমনির্ভর করে সৃষ্টি করেছি’ (সুরা বালাদ : ৩)। তাই এ কথা সুস্পষ্ট যে, ইসলামে শ্রম আর শ্রমিকের যথাযথ মর্যাদা ও গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। কেননা শ্রমিকই হলো সব উন্নয়ন ও উৎপাদনের চাবিকাঠি।

শ্রমিকের যে বিষয়টি প্রথমেই নির্ধারণ করতে হয় তা হলো তার পেশা বা কাজ নির্ধারণ। কোনো কোনো পেশাকে কোনো কোনো সমাজে নিন্দনীয় মনে করে থাকে। তাই ইসলাম শ্রমিককে তার নিজস্ব চিন্তা-চেতনা অনুযায়ী পেশা নির্ধারণের অধিকার প্রদান করেছে। ইসলাম এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদার মনোভাব পোষণ করে। মূলত এটি ইসলামের মূল শিক্ষার একটি। আর ইসলাম সব ধরনের পেশাকেই সম্মানিত মনে করে। কারণ যত নিন্দনীয় (অবৈধ না হলেই হলো) কাজই হোক না কেন তা কিছু লোক না করলে তা কে করবে? যেমন সুইপারের কাজ। প্রকৃত অর্থে, কোনো পেশাই অসম্মানজনক নয়। বরং পরিশ্রম করে স্বহস্তে উপার্জিত সম্পদ সর্বোত্তম সম্পদ। তবে সমাজ বা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শ্রমিকের ওপর কোনো কাজ চাপিয়ে দেওয়া অনুচিত। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘তিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে সুগম করেছেন। অতএব, তোমরা তার ভূপৃষ্ঠে বিচরণ কর এবং তার দেওয়া রিজিক আহরণ কর’ (সুরা মুলক : ১৫)।

হজরত আদম (আ.) থেকে সর্বশেষ মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সব নবী-রসুল নিজ হাতে কাজ করতেন। স্বহস্তে কাজ সম্পাদন করা অতিশয় উত্তম। রসুলুল্ল্লাহ (সা.) শ্রমের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ ও শ্রমিকের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে বাণী প্রদান করে বলেছেন, ‘উত্তম উপার্জন হলো (পেশাজীবী) কর্মীর হাতের (শ্রমের) উপার্জন, যখন সে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে।’ রসুল (সা.) নিজে পানি বহন করতেন। নিজের জুতা নিজেই সেলাই করতেন। মসজিদ নির্মাণ, পরিখা খননসহ সামাজিক কাজে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আল্লাহর নবীর (সা.) শ্রমের মাধ্যমে।

ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রমিক ও পুঁজি মালিকের পারস্পরিক সম্পর্ক ভ্রাতৃত্বের ও সাহায্যকারীর। পণ্য উৎপাদনে কিছু লোক শ্রম দিচ্ছে, অন্য কিছু লোক একান্ত জরুরি পুঁজি দিচ্ছে। আর অপর কিছু লোক দিচ্ছে ব্যবস্থাপনা, শ্রম ও সময়। তাই পণ্য উৎপাদন করে শ্রমিকরা যেমন ন্যায়সঙ্গত পরিমাণ মজুরি পাওয়ার অধিকারী, তেমনি ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত লোকেরা নির্দিষ্ট পরিমাণ বেতন-ভাতা ও পুঁজি মালিক উদ্যোক্তারা ন্যায়সঙ্গত মুনাফা লাভের অধিকারী। এরা একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। একজনকে ছাড়া অন্যজন উৎপাদনে অংশগ্রহণ করতে পারে না। এক্ষেত্রে বলতে হয়, ইসলাম মূলত এমন শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়, যেখানে সব মানুষের অধিকারই সংরক্ষিত থাকে এবং চাওয়ার আগেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে প্রত্যেকের অধিকার আদায় করে দিতে সবাই উদ্বুদ্ধ থাকে।

শ্রমজীবীদের প্রতি রসুল (সা.) কতটা দরদী ছিলেন, তার প্রমাণ মেলে বায়হাকির একটি হাদিসে। একদিন জনৈক ব্যক্তি রসুল (সা.)-কে বললেন, ‘আমার খাদেম (গৃহপরিচারক) আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও অন্যায় করে (এখন আমি তার সঙ্গে কেমন আচরণ করব?)।’ রসুল (সা.) বললেন, ‘দৈনিক তাকে ৭০ বার ক্ষমা করবে।’ কিন্তু গোটা দুনিয়ায়ই বর্তমান বাস্তবতা যে ভিন্ন। অবশ্য শোষক আর শোষিত আধুনিক যুগে সৃষ্ট নতুন কোনো চরিত্র নয়।

একথা সত্য— মালিকপক্ষ সুযোগ পেলেই শ্রমিকদের শোষণ করে, যা ইসলাম কথনো সমর্থন করে না। আর শোষণের বিরুদ্ধে শোষিত মানুষের অধিকার আদায়ে ঐতিহাসিক এক সংগ্রামের দিন ‘মহান মে দিবস’। পৃথিবীর সব দেশে মজদুররা যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে ঐতিহাসিক এ দিবস (পহেলা মে) পালন করে। জুলুমের বিরুদ্ধে মজলুমের জয় একদিন না একদিন হয় বলেই ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও, লড়াই কর’ স্লোগানটি মে দিবসে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। অবশ্য লড়াইয়ের শুরুটা হয়েছিল ১৮৮৬ সালের পহেলা মে আমেরিকার শিকাগো শহরে হে মার্কেটে। মানবের প্রতি দানবীয় শ্রমঘণ্টার বিরুদ্ধে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে সেদিন লাখ লাখ মানুষ ন্যায্য অধিকার আদায়ে সমবেত হয়েছিল শিকাগোর হে মার্কেটে। সেদিনকার শিকাগো ধর্মঘট শেষ পর্যন্ত রক্ত সংগ্রামে পরিণত হয়। বলা যায়, পহেলা মে’র ধর্মঘট এক পর্যায়ে অবস্থান কর্মসূচিতে পরিণত হয়। অব্যাহত ধর্মঘট চলাকালে ৩ মে রাজপথের বিক্ষোভ মিছিলে শাসক গোষ্ঠীর পুলিশি অভিযানে প্রাণ হারায় ৫ জন কর্মবীর শ্রমিক।

নিরস্ত্র শ্রমজীবী মানুষের ওপর অস্ত্রধারী পুলিশের হামলার প্রতিবাদে বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ সোচ্চার হয়ে ওঠে। পরে ১৮৯০ সালে গ্রেট ব্রিটেনের হাইড পার্কে লাখো শ্রমিকের সমাবেশে ‘মে দিবস’ পালন করা হয়। এর আগে ১৮৮৯ সালে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আন্তর্জাতিকভাবে পহেলা মে ‘মহান মে দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ধীরে ধীরে পহেলা মে শ্রমজীবী মানুষের প্রতি সংহতির প্রতীক হিসেবে মহান মে দিবস পৃথিবীর দেশে দেশে যথাযোগ্য মর্যাদা লাভ করে। সেই থেকে মহান মে দিবস পালন করা হচ্ছে। কিন্তু দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এ যেন দিবস আছে রজনী নেই! শোষণ বঞ্চনা ও অমানুষিক নির্যাতন যেন শ্রমজীবীর মানুষের পিছু ছাড়ছে না। ১৮৮৬ থেকে ২০১৯ সাল কালের ব্যবধান ভিন্ন হলেও এখনো অভিন্ন শ্রমজীবী মানুষের সেই দাবি অপূরণই থেকে গেছে। কেবল দিবস আসলেই আমরা শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকারের কথা বলি; কিন্তু বাস্তবে মজদুর মেহনতি মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে মালিকপক্ষ আদৌ আন্তরিক হতে পারেনি। যে কারণে পরিবর্তন আসেনি শ্রমজীবীদের জীবনযাত্রায়। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা আজও তাদের কাছে অধরাই থেকে গেল।

  লেখক : কলামিস্ট ও সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads