• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
মহাকালের মহাভাষণ

প্রতিবছর ৯ জিলহজ হাজিদের ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ ধবনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে আরাফাতের ময়দান

ছবি : সংগৃহীত

ধর্ম

মহাকালের মহাভাষণ

  • সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
  • প্রকাশিত ২৬ জুলাই ২০১৯

মানবজাতির হিদায়াতের জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কিতাব নাজিল করেছেন। সেই কিতাব নাজিল সমাপ্ত ও পরিপূর্ণ করেছেন পবিত্র কোরআনের মাধ্যমে। আবার মানবজাতির পথনির্দেশের জন্য পাঠিয়েছেন নবী-রাসুল, নবী-রাসুলদের পূর্ণতা ও সমাপ্তি সম্পাদন করেছেন মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে। আর ওহি নাজিল ও নবী জীবনের পরিপূর্ণতা সাধিত হয়েছে বিদায় হজের ভাষণে।

এটি ছিল মহানবী (সা.)-এর জীবনের সর্বশেষ আনুষ্ঠানিক ভাষণ, যা তিনি দশম হিজরি সনের ৯ জিলহজ আরাফার দিনে জাবালে রহমতের ওপর দাঁড়িয়ে উপস্থিত প্রায় সোয়া লাখ সাহাবির উদ্দেশে। মূলত বিদায় হজে রাসুল (সা.) তিনটি ভাষণ প্রদান করেছিলেন- ১. আরাফার ময়দানে। ২. কোরবানির দিন, মিনায়। ৩. ‘আয়্যাম-ই-তাশরিকে’র মধ্যবর্তী স্থানে, মিনায়।

এটি বিদায় হজের ভাষণ হিসেবে পরিচিত হলেও এ ভাষণকে ‘হাজ্জাতুল বালাগ’ ও ‘হাজ্জাতুত তামাম’ বা পূর্ণতার হজ নামেও অভিহিত করা হয়। সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত আগত ও বিগত সময়ের সব ভাষণের মধ্যে এ ভাষণ শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় বিভূষিত। বিশ্ব মানবতার মুক্তির এমন কোনো দিক নেই, যার ছোঁয়া এই মূল্যবান ভাষণে লাগেনি।

বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত ভাষণটি এখানে তুলে ধরা হলো। একথা সত্য যে, ভাষণের ধারাবাহিকতা প্রায় দেড় হাজার বছর পর কতটা রক্ষা করতে পেরেছি, সে বিষয়ে আমি নিজেও সন্দিহান। কারণ ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে ভিন্ন ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে মূলভাব সবধরনের সূত্রে প্রায় একই পাওয়া গেছে। আল্লাহ সর্বদর্শী ও ক্ষমাশীল।

 

মহানবী (সা.) তাঁর ভাষণের শুরুতে মহান আল্লাহর হামদ ও প্রশংসা জ্ঞাপন করার পর বলেন :

হে লোকসকল! আল্লাহতায়ালা বলেন : হে মানবজাতি! আমি তোমাদিগকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হতে পারো। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্মানিত, যে সর্বাধিক পরহেজগার’ (সুরা ৪৯ হুজরাত, আয়াত : ১৩)। সুতরাং কোনো অনারবের ওপর কোনো আরবের; কোনো আরবের ওপর কোনো অনারবের, এমনিভাবে শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের এবং কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই; তবে তাকওয়ার ভিত্তিতে। সব মানুষ আদম (আ.)-এর সন্তান; আর আদম (আ.) মাটি দ্বারা সৃষ্ট।

 

হে লোকসকল! এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই, সব মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই; তোমাদের অধীনদের (দাস-দাসী) প্রতি খেয়াল রাখবে—তোমরা যা খাবে, তাদের তা খাওয়াবে, তোমরা যা পরিধান করবে, তাদেরও তা পরাবে।

 

হে লোকসকল! তোমরা তোমাদের রবের ইবাদত করবে; পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে। রমজান মাসে রোজা রাখবে। সন্তুষ্টচিত্তে সম্পদের জাকাত প্রদান করবে। স্বীয় প্রভুর ঘরে এসে হজ পালন করবে এবং নেতাদের আনুগত্য করবে; তাহলে তোমাদের রবের জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।

 

হে লোকসকল! তোমরা আমার কথা শোনো। হয়তো আমি এ বছরের পর এখানে আর কখনো তোমাদের সঙ্গে মিলিত হবো না।

 

হে লোকসকল! তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ এই দিন ও এই মাসের মতো তোমাদের ওপর নিষিদ্ধ ও পবিত্র তোমাদের প্রভুর সঙ্গে সাক্ষাতের দিন পর্যন্ত। যেমন আজকের এই দিন, এই মাস, এই শহরে রক্তপাত করা হারাম বা নিষিদ্ধ।

 

হে লোকসকল! তোমাদের কারো কাছে যদি কোনো আমানত গচ্ছিত থাকে, তা তার প্রাপকের কাছে অবশ্যই পৌঁছে দেবে। নিশ্চয়ই সব ধরনের সুদ রহিত করা হলো। তবে তোমাদের মূলধন বহাল থাকবে। মহান আল্লাহ ফয়সালা দিয়েছেন যে, আর কোনো সুদ নয়। আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিবের সব সুদ রহিত করা হলো।

 

হে লোকসকল! তোমরা কোনো জুলুম করবে না; বরং তোমাদের প্রতিও কোনো জুলুম করা হবে না। জাহিলি যুগের যত রক্তের দাবি, তা সব রহিত করা হলো। প্রথম আমি রিবয়া ইবন হারিস ইবন আবদুল মুত্তালিবের শিশুপুত্রের রক্তের দাবি রহিত করলাম।

 

হে লোকসকল! বিশ্বাসীরা পরস্পরের ভাই, সাবধান! তোমরা একজন আরেকজনকে হত্যা করার মতো কুফরি কাজে লিপ্ত হয়ো না।’

 

হে লোকসকল! আজ শয়তান নিরাশ হয়েছে, সে আর কখনো তোমাদের কাছে পাত্তা পাবে না। কিন্তু সাবধান! অনেক বিষয়কে তোমরা ক্ষুদ্র বলে মনে করো, অথচ শয়তান সে বিষয় দিয়েই তোমাদের সর্বনাশ করে থাকে। ওই বিষয়গুলো সম্পর্কে খুবই সতর্ক থাকবে।

 

হে লোকসকল! নিশ্চয়ই মাসসমূহকে আগ-পিছ করা বস্তুত কুফরিকেই বৃদ্ধি করা, যা দ্বারা কাফিররা বিভ্রান্ত হয়। অথচ কাল (সময়) তার নিজস্ব নিয়মে প্রকৃতিতে আবর্তিত হয়।

 

হে লোকসকল! নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক প্রাপকের (উত্তরাধিকারীর) জন্য তার অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি নিজের জন্মদাতা ছাড়া অন্যের সঙ্গে নিজের বংশসূত্র স্থাপন করে, তার ওপর আল্লাহর লানত।

 

হে লোকসকল! শুনে রাখো, অপরাধের দায়িত্ব কেবল অপরাধীর ওপরই বর্তায়। পিতা তার পুত্রের জন্যে আর পুত্র তার পিতার অপরাধের জন্য দায়ী নয়।

 

হে লোকসকল! যদি কোনো হাবশী ক্রীতদাসকেও তোমাদের আমির নিযুক্ত করা হয়, আর সে যদি আল্লাহর বিধান অনুযায়ী তোমাদের পরিচালনা করতে থাকে, তবে তোমরা সর্বতোভাবে তার আদেশ মেনে চলবে; তার অবাধ্য হবে না।

 

হে লোকসকল! তোমরা নারীদের প্রতি কল্যাণকামী হও। কারণ তারা তোমাদের কাছে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ। তারা তো নিজেদের জন্য কিছু করে না। তোমরা তো তাদের আল্লাহর আমানতস্বরূপ গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর বাণীর মাধ্যমে তাদের সতীত্বের ওপর অধিকার লাভ করেছ (বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দাম্পত্য অধিকার লাভ করেছ)।

 

অতএব, হে লোকসকল! আমি তোমাদের মাঝে এমন সুস্পষ্ট দুটি বিষয় (বিধান) রেখে গেলাম, যা দৃঢ়ভাবে ধারণ করলে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না: আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর নবী (সা.)-এর সুন্নাহ।

 

হে লোকসকল! সাবধান! ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। এই সীমা লঙ্ঘনের দরুন তোমাদের পূর্ববর্তী বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে।

 

হে লোকসকল! তোমরা অবশ্যই জেনে রেখো, প্রত্যেক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই এবং মুসলিমরা ভ্রাতৃপ্রতিম।

 

হে লোকসকল! এখানে উপস্থিত লোকেরা যেন এই বার্তাগুলো অনুপস্থিত লোকদের কাছে পৌঁছে দেয়। হয়তো অনেক অনুপস্থিত লোক উপস্থিত শ্রোতা অপেক্ষা অধিক হেফাজতকারী হবে।

 

হে লোকসকল! তোমরা আল্লাহর দরবারে আমার ব্যাপারে যখন জিজ্ঞাসিত হবে, তখন কী উত্তর দেবে?

 

উপস্থিত সাহাবিরা উত্তর দিলেন, আপনার ওপর অর্পিত দায়িত্ব আপনি যথাযথ পালন করেছেন; ইয়া রাসুলুল্লাহ! (হে আল্লাহর রাসুল!) আপনি রিসালাতের হক পূর্ণরূপে আদায় করেছেন এবং উম্মতকে কল্যাণপথের দিশা দিয়েছেন।

 

তারপর তিনি সাহাবিদের উদ্দেশে বললেন, ‘আমি কি পৌঁছে দিয়েছি?’

 

উপস্থিত সাহাবিরা সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই আপনি পৌঁছিয়েছেন।’

 

তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) আকাশের দিকে শাহাদত অঙ্গুলি উত্তোলন করে বললেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন; হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন; হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন।’

 

অতঃপর নাজিল হয় : ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য ধর্ম হিসেবে ইসলাম দিয়ে আমি সন্তুষ্ট হলাম’ (সুরা মায়িদাহ, আয়াত : ৩)। (ইবনে কাসীর (র.), খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-১৯৮ ও ৩২০-৩৪২, ই. ফা. বা.)।

 

মূলত বিদায় হজের ভাষণ মহানবী (সা.)-এর ২৩ বছরের নবুয়তি জীবনের কর্মপন্থা ও প্রজ্ঞার নির্যাস। তা ছাড়া এ ভাষণ ছিল মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পর থেকে কিয়ামত অবধি বিপদসংকুল পৃথিবীর উদ্ভূত পরিস্থিতি ও সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান। এ ভাষণ ছিল বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার এক পূর্ণাঙ্গ ও বাস্তব কর্মসূচি। ইসলাম ধর্মের ক্রমসম্প্রসারমাণ প্রক্রিয়া ও রূপরেখার যে ধারাবাহিকতা হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু হয়েছিল, তারই পূর্ণ বিকাশ ও পরিসমাপ্তি ঘটেছিল এ ভাষণের মধ্য দিয়ে। এ ভাষণের পর তিন মাস অতিবাহিত হতে না হতেই তিনি এই নশ্বর দুনিয়া ছেড়ে অবিনশ্বর জগতে পাড়ি জমান।

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তিনি লাখো জনতার কণ্ঠে নবুয়তি দায়িত্ব যথার্থভাবে পালনের স্বীকারোক্তি গ্রহণ করেন। রাসুল (সা.)-এর মুখে ‘আল-বিদা, আল-বিদা’ ধ্বনি শুনে ভক্তকুলের আকাশ বিদীর্ণ করা আর্তনাদ ও নিঃশব্দ আকুতিতে সেদিন ভারী হয়েছিল আরাফার আকাশ।

‘আমি কি পয়গাম পৌঁছে দিয়েছি?’ বার বার ধ্বনিত হওয়া এ বাক্যটি শুনে বিগলিত মন ও সিক্ত নয়নে ভক্তকুলের মুখ থেকে কেবল একটি শব্দই বেরিয়ে এসেছিল, ‘নায়াম’— হ্যাঁ।

 

ভাষণগুলোর মানবাধিকারসংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে এখানে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।

শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা : ধর্ম, জাতি ও বর্ণবৈষম্যের কারণে হারিয়ে যায় মানবিক মূল্যবোধ। শুরু হয় মানুষে মানুষে হানাহানি, কাটাকাটি, মারামারি। আজকের বিশ্বে যা নিত্যনৈমিত্তিক এক ঘটনা। এসবের অবসানকল্পে মহানবী (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বলেন, ‘হে লোকসকল! আল্লাহতায়ালা বলেন : হে মানবজাতি! আমি তোমাদিগকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হতে পারো। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্মানিত, যে সর্বাধিক পরহেজগার’ (সুরা ৪৯ হুজরাত, আয়াত: ১৩)। সুতরাং কোনো অনারবের ওপর কোনো আরবের; কোনো আরবের ওপর কোনো অনারবের, এমনিভাবে শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের এবং কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই; তবে তাকওয়ার ভিত্তিতে।’

নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান করা : বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশে পৃথিবীর রাতগুলোকে যতই দিনের আলোর মতো জ্বলজ্বল করে তোলার চেষ্টা চলছে, ততই মানুষের অন্তঃকরণ ক্রমেই অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। পৃথিবীর সর্বত্র আজ হত্যা, লুণ্ঠন, ছিনতাই, সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছে। মানুষের জানমালের কোনো নিরাপত্তা নেই। ভূলুণ্ঠিত মানবতা নিভৃতে কাঁদছে। মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ পুনরুজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে মহানবী (সা.) বলেন, হে লোকসকল! তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ এই দিন ও এই মাসের মতো তোমাদের ওপর নিষিদ্ধ ও পবিত্র তোমাদের প্রভুর সঙ্গে সাক্ষাতের দিন পর্যন্ত। যেমন আজকের এই দিন, এই মাস, এই শহরে রক্তপাত করা হারাম বা নিষিদ্ধ।

ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা : আমাদের সমাজে অপরাধী শক্তিশালী হওয়ার দরুন, ঘুষের বিনিময়ে অথবা স্বজনপ্রীতি করে নিরীহ ব্যক্তির ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। একজনের অপরাধের কারণে তার পরিবার, বংশ, পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের ব্যাপারে ঢালাওভাবে মন্তব্য করার হীন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এ মর্মে রাসুল (সা.) বলেন, হে লোকসকল! শুনে রাখো, অপরাধের দায়িত্ব কেবল অপরাধীর ওপরই বর্তায়। পিতা তার পুত্রের জন্যে আর পুত্র তার পিতার অপরাধের জন্য দায়ী নয়।

নারী-পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক : একশ্রেণির লোক বলে বেড়ায়, ‘ধর্ম হলো শোষণের হাতিয়ার!’ নারীর অধিকার রক্ষার সস্তা স্লোগানধারী কিছু মানুষ বলে থাকে, ‘নারী নির্যাতনের জন্য ধর্ম ও ধর্মীয় মতামতই (ফতোয়া) দায়ী!’ তারা কি রাসুল (সা.)-এর এ কথাগুলো পড়ে দেখেছে?— হে লোকসকল! তোমরা নারীদের প্রতি কল্যাণকামী হও। কারণ তারা তোমাদের কাছে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ। তারা তো নিজেদের জন্য কিছু করে না। তোমরা তো তাদের আল্লাহর আমানতস্বরূপ গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর বাণীর মাধ্যমে তাদের সতীত্বের ওপর অধিকার লাভ করেছ (বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দাম্পত্য অধিকার লাভ করেছ)।

শ্রেষ্ঠতম শ্রমনীতি ঘোষণা : বর্তমান বিশ্বে শ্রমিক সমস্যা সবচেয়ে আলোচিত সমস্যা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাসুল (সা.) শ্রমনীতি ঘোষণা করেন। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যাবে- এটাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম শ্রমনীতি। তিনি বলেছেন, হে লোকসকল! এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই, সব মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই; তোমাদের অধীনদের (দাস-দাসী) প্রতি খেয়াল রাখবে— তোমরা যা খাবে, তাদের তা খাওয়াবে, তোমরা যা পরিধান করবে, তাদেরও তা পরাবে।

নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা যাবে না : মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ ও ঐক্যের ভিত মজবুত করা ও নিরপরাধ মানুষ হত্যা বন্ধের নির্দেশ দিয়ে মহানবী (সা.) বলেন, ‘হে মানুষ! বিশ্বাসীরা পরস্পরের ভাই, সাবধান! তোমরা একজন আরেকজনকে হত্যা করার মতো কুফরি কাজে লিপ্ত হয়ো না।’

মানব সভ্যতাবিরোধী সব বর্বরতা নিষিদ্ধ : মানব সভ্যতা, নৈতিকতাবিরোধী সব অপকর্ম, রক্তপাত, প্রতিহিংসা ও বিদ্বেষের আগুন পৃথিবী থেকে চিরতরে নির্বাপিত করার জন্য মহানবী (সা.) ঘোষণা দেন, ‘শুনে রাখো, তোমরা কোনো জুলুম করবে না, বরং তোমাদের প্রতিও কোনো জুলুম করা হবে না। জাহিলি যুগের যত রক্তের দাবি, তা সব রহিত করা হলো।’

সুদবিহীন অর্থনীতি প্রণয়ন : পুঁজিবাদী সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থার জাঁতাকলে পিষ্ট আজকের মানবসমাজ। সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা চিরতরে মূলোৎপাটন করে জাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহানবী (সা.) বলেন, ‘হে মানুষ! তোমাদের কারো কাছে যদি কোনো আমানত গচ্ছিত থাকে, তা তার প্রাপকের কাছে অবশ্যই পৌঁছে দেবে। নিশ্চয়ই সব ধরনের সুদ রহিত করা হলো। তবে তোমাদের মূলধন বহাল থাকবে। মহান আল্লাহ ফয়সালা দিয়েছেন যে, আর কোনো সুদ নয়। আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিবের সব সুদ রহিত করা হলো।’

যার যার প্রাপ্য তাকে দিয়ে দিতে হবে : প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা মানবতাকে ধ্বংস করছে। অন্যের অধিকার হরণ করে যে কোনো উপায়ে অর্থ উপার্জনের চিন্তা সমাজের সমস্যাগুলোকে বহু গুণে বাড়িয়ে দিচ্ছে। সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাসুল (সা.) প্রত্যেকের আমানত (প্রাপ্য অধিকার) তার হকদারের কাছে অবশ্যই ফেরত দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন।

ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি নয় : প্রত্যেক জাতি ও ধর্মাবলম্বীর রয়েছে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শ। বহুধাবিভক্ত সমাজব্যবস্থায় বহুদল-উপদল ও নানা মতের মানুষ থাকতে পারে। এক্ষেত্রে সংঘাত ও বাড়াবাড়ির কোনো সুযোগ নেই। মহানবী (সা.) বলেন, ‘সাবধান! ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। এই সীমা লঙ্ঘনের দরুন তোমাদের পূর্ববর্তী বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে।’

শাসক নিকৃষ্টমানের হলেও মেনে চলতে হবে : শাসক যদি কোরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনো কাজ না করে, তাহলে রাষ্ট্রের যে কোনো সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া নাগরিকের কর্তব্য- শাসক যতই নিকৃষ্টমানের হোক না কেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘হে লোকসকল! যদি কোনো হাবশী ক্রীতদাসকেও তোমাদের আমীর নিযুক্ত করা হয়, আর সে যদি আল্লাহর বিধান অনুযায়ী তোমাদের পরিচালনা করতে থাকে, তবে তোমরা সর্বতোভাবে তার আদেশ মেনে চলবে; তার অবাধ্য হবে না।’

ভবিষ্যৎ আগত সমস্যার সমাধান : ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। আর রাসুল (সা.) হলেন শেষ নবী। তাই সমস্যাসংকুল পৃথিবীতে ইসলাম নিত্যনতুন যুগজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হতে পারে। তারই সমাধানকল্পে মহানবী (সা.) বলেন, হে লোকসকল! আমি তোমাদের মাঝে এমন সুস্পষ্ট দুটি বিষয় (বিধান) রেখে গেলাম, যা দৃঢ়ভাবে ধারণ করলে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না— আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর নবী (সা.)-এর সুন্নাহ।

মানুষের কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছে দিতে হবে : পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা হলে উত্তম জাতি, তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে মানবতার কল্যাণে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ দেবে ও অসৎ কাজ থেকে বাধা প্রদান করবে’ (সুরা আলে ইমরান, ১১০)। তাই ধর্মের মর্মবাণীগুলো বিশেষত বিদায় হজের ভাষণের বার্তা বিশ্ব মানবতার কাছে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে লাখ লাখ সাহাবি আপন বাসস্থান ত্যাগ করে ছড়িয়ে পড়েছিলেন পৃথিবীর আনাচে-কানাচে। ঘরে ঘরে আজ পৌঁছে গেছে ইসলামের শান্তির বাণী। রাসুল (সা.) বলেন, ‘হে লোকসকল! এখানে উপস্থিত লোকেরা যেন এই বার্তাগুলো অনুপস্থিত লোকদের কাছে পৌঁছে দেয়। হয়তো অনেক অনুপস্থিত লোক উপস্থিত শ্রোতা অপেক্ষা অধিক হেফাজতকারী হবে।’

 

সবশেষে বলি, সমস্যায় জর্জরিত ও ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ফিরে যেতে হবে সেই প্রায় দেড় হাজার বছর আগে। কারণ সফল হতে হলে জীবনকে যে ঢেলে সাজাতে হবে বিদায় হজের ভাষণের সুমহান আদর্শে।

 

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads