• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

ধর্ম

মুনাফিকের অন্তর অসুস্থ

  • সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
  • প্রকাশিত ৩০ আগস্ট ২০১৯

‘মুনাফিক’ শব্দটি ‘নিফাক’ শব্দমূল থেকে এসেছে, যার অর্থ কোনো কিছুকে গোপন রেখে এর বিপরীত কথা বা কাজ প্রকাশ করা। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় মুনাফিক বলা হয় ওই ব্যক্তিকে, যে অন্তরে কুফরি ও ইসলামবিরোধিতা রেখে মুখে ও প্রকাশ্যে ইসলাম প্রকাশ করে এবং মুসলমান হওয়ার দাবি করে। এরা কেন এ কাজ করে, এর ব্যাখ্যায় কোরআনের এক আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তারা আল্লাহ ও মুমিনদের ধোঁকা দিতে চায়, আসলে তারা নিজেদের সঙ্গেই প্রতারণা করছে, কিন্তু তারা তা উপলব্ধি করতে পারছে না’ (সুরা বাকারা : ৯)। অপর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা মূলত কাফিরদের কাছ থেকে মান-মর্যাদা পেতে চায়’ (সুরা আন-নিসা : ১৩৯)।

কারো মতে, ‘নাফেকুল ইয়ারবু’ (পাহাড়ি ইঁদুর) থেকে মুনাফিক শব্দটি গঠিত। পাহাড়ি ইঁদুরকে ‘নাফেকুল ইয়ারবু’ বলা হয়। কারণ পাহাড়ি ইঁদুর অত্যন্ত ধূর্ত হয়, এরা পাহাড়ে অনেক গর্ত খনন করে। এদের মারার জন্য এক গর্তে পানি বা অন্য কিছু দিলে অন্য গর্ত দিয়ে বের হয়ে পালিয়ে যায়, ফলে এদের সহজে মারা যায় না। মুনাফিকও অনুরূপ ধূর্ত। তাদের সহজে চেনা যায় না।

ইসলামের ইতিহাসে মুনাফিকের সরদার হিসেবে কুখ্যাতি লাভ করেছে আবদুল্লাহ বিন উবাই বিন সালুল। মুনাফিকদের অন্যতম নিকৃষ্ট কাজ হলো মুমিনদের নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মুমিনদের মধ্যে যারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সদকা দেয়, আর যারা নিজ অর্জিত শ্রম ছাড়া আর কিছুই (দান করতে) পায় না, তাদের যারা দোষারোপ করে ও বিদ্রুপ করে, আল্লাহও তাদের নিয়ে বিদ্রুপ করেন। তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি’ (সুরা তওবা : ৭৯)।

 

মুনাফিকের প্রকারভেদ

নিফাক ও মুনাফিকি দুই ধরনের— ১. বিশ্বাসগত মুনাফিকি, ২. কর্মগত মুনাফিকি। বিশ্বাসগত মুনাফিকি হলো, অন্তরে কুফরি রেখে নিজেকে মুসলমান বলে দাবি করা। এ ধরনের মুনাফিকির মাধ্যমে ইসলাম থেকে বের হয়ে যায়। আর কর্মগত মুনাফি যেমন— আমানতের খিয়ানত করা, মিথ্যা বলা, অঙ্গীকার ভঙ্গ করা, গালিগালাজ করা ইত্যাদি। এসব কর্ম মুনাফিকি হলেও এসবের মাধ্যমে কেউ ইসলাম ধর্ম থেকে বের হয়ে যায় না (সূত্র : তাফসিরে মা’আরেফুল কোরআন ও ইবনে কাছির)।

 

আল্লাহতায়ালা সুরা বাকারার ৮ থেকে ২০ পর্যন্ত মোট ১৩টি আয়াত মুনাফিকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে নাজিল করেছেন। তা ছাড়া বিভিন্ন সুরায় আরো ৩৮টি আয়াতে মুনাফিকদের আলোচনা করেছেন। তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো—

 

স্বভাবে দুমুখো

মুনাফিকরা দুমুখো আচরণ করে। বাহ্যিকভাবে নিজেদের মুমিন বলে পরিচয় দিলেও তাদের ভেতরে ঈমান নেই। প্রসঙ্গত, ঈমান হচ্ছে তিনটি বিষয়ের সমন্বয়ের নাম। ১. অন্তরের বিশ্বাস, ২. মৌখিক স্বীকৃতি এবং ৩. স্বীকৃতি অনুযায়ী আমল করা (ইবনে মাজাহ)। কিন্তু মুনাফিক শুধু মৌখিকভাবে ঈমানের স্বীকৃতি দান করে, আর অন্তরে মোটেও বিশ্বাস লালন করে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর মানুষের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে, যারা বলে আমরা আল্লাহ ও আখিরাতে ঈমান এনেছি, অথচ তারা মুমিন নয়’ (সুরা বাকারা : ৮)।

 

অসুস্থ অন্তরের অধিকারী

অসুস্থতা হলো সুস্থতার বিপরীত। সুস্থতার সীমা পার হলে তাকে অসুস্থতা বলা হয়। মুনাফিকদের আকিদা-বিশ্বাসে সন্দেহ, অস্বীকৃতি ও মিথ্যা থাকার কারণে তাদের কলবকে অসুস্থ কলব বলা হয়। দ্বিমুখী আচরণ একটি কঠিন ব্যাধি। আর খাঁটি বিশ্বাস হলো সুস্থতা। ঈমান আনার পর যারা দ্বিমুখী আচরণ করে, তারা মূলত অসুস্থ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘তাদের হূদয়ে রয়েছে ব্যাধি। অতঃপর আল্লাহ সে ব্যাধিকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাদের মিথ্যাচারের দরুন তাদের জন্য রয়েছে অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’ (আল বাকারা : ১০)।

 

মুমিনদের নির্বোধভাবে

মুনাফিকরা নিজেদের বুদ্ধিমান, ধূর্ত, চতুর ও চালাক মনে করে। আর মুমিন, মুত্তাকি ও নেককারদের নির্বোধ ও বোকা বলে মনে করে। অথচ আল্লাহতায়ালার কাছে তারাই বোকা ও নির্বোধ। এ প্রসঙ্গে মহান মাবুদ ইরশাদ করেন, ‘যখন তাদের বলা হয়, অন্য লোকদের ন্যায় তোমরাও ঈমান আনো, তখন তারা বলে, আমরা কি সেই নির্বোধ লোকদের মতো ঈমান আনব? আসলে তারাই তো নির্বোধ; কিন্তু তাদের সে জ্ঞান নেই’ (বাকারা : ১৩)।

 

ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী

মুনাফিকরা ইসলাম ও সামাজিক শান্তির বিরোধিতার মাধ্যমে অশান্তি সৃষ্টি করে। কিন্তু নিজেদের ভ্রষ্টতা ও অজ্ঞতার কারণে অনুভব করতে পারছে না। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘সাবধান! এরাই ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী; কিন্তু তাদের সে অনুভূতি নেই’ (বাকারা : ১২)।

 

নিজেদের ‘শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী’ দাবি করে

মুনাফিকরা সমাজে বিভিন্ন ধরনের ফ্যাসাদ ও অশান্তি সৃষ্টি করলেও সমাজে নানা প্রচার-প্রপাগান্ডায় তারা নিজেদের শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী বলে পরিচয় দেয়। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর যখনই তাদের বলা হয়, পৃথিবীতে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করো না, তারা জবাবে বলে— আমরাই তো সংশোধনকারী ও শান্তিকামী’ (বাকারা : ১১)।

 

প্রতারক ও ধোঁকাবাজ

ধূর্ত, প্রতারক ও ধোঁকাবাজ মুনাফিকরা আল্লাহ ও মুমিনদের সঙ্গে প্রতারণা করে। তারা মনে করছে, এতে তারা সফলকাম ও বিজয়ী হচ্ছে, অথচ প্রকারান্তরে তারাই প্রতারিত ও প্রবঞ্চিত হচ্ছে। সত্য পথ থেকে দূরে গিয়ে পথভ্রষ্ট হচ্ছে এবং তিলে তিলে ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ ও ঈমানদারদের তারা ধোঁকা দিতে চায়, আসলে তারা অন্য কাউকে ধোঁকা দিচ্ছে না, বরং নিজেদেরই প্রতারিত করছে, অথচ তাদের সে অনুভূতি নেই’ (বাকারা : ৯)।

 

সুসময়ের সঙ্গী

আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘বিদ্যুৎ চমক যেন তাদের দৃষ্টিশক্তিকে ছিনিয়ে নেয়। যখনই তারা তাদের একটু আলো দেয়, তারা পথ চলে, আর যখনই অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়, তখনই থমকে দাঁড়ায়।’ অর্থাৎ সুসময়ে ইসলামের ছায়াতলে চলে আসে, আর যখন বিপদ দেখতে পায়, তখন সিটকে পড়ে এবং আগের নিফাকিতে অবিচল ও অটল থাকে।

 

মিথ্যাবাদী

মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী। তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) সম্পর্কে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী’ (মুনাফিকুন : ১)।

 

ভ্রষ্টতা ক্রয় করে

মুনাফিকরা দুনিয়ার লালসায় হেদায়েতের ওপর ভ্রষ্টতাকে অগ্রাধিকার দেয়। মানুষ যে জিনিসকে ভালোবাসে ও পছন্দ করে, সে জিনিসই ক্রয় করে। মুনাফিকরা ঈমান বিক্রি করে নিফাককে ক্রয় করে— অর্থাৎ ঈমানের ওপর নিফাককে প্রাধান্য দেয়। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তারা এমন লোক, যারা হেদায়েতের পরিবর্তে ভ্রষ্টতাকে ক্রয় করে নিয়েছে। সুতরাং তাদের এ ব্যবসা লাভজনক হয়নি; আর তারা হেদায়েতও পায়নি’ (বাকারা : ১৬)।

 

তারা আলোর কাছে আসে না

বিশ্বনবী (সা.) সর্বত্র দ্বীনের আলো প্রজ্বলিত করলেও মুনাফিকরা সে আলো থেকে উপকৃত হতে পারেনি। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তাদের উদাহরণ হলো ওই ব্যক্তির মতো, যে (অন্ধকারে) আগুন জ্বালিয়েছে; কিন্তু যখন তা তার চারপাশ আলোকিত করল, তখন আল্লাহ তাদের আলো অপসারিত করে তাদের ঘোর অন্ধকারে ফেলে দিয়েছেন, যাতে তারা কিছুই দেখতে পায় না’ (বাকারা : ১৭)।

 

তারা বধির, মূক ও অন্ধ

হক কথা শোনার ব্যাপারে মুনাফিকরা বধির; তারা হক কথা শোনে না এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে চলার ব্যাপারে অন্ধ। মহান মাবুদ তাদের অবস্থা বর্ণনা করেন, ‘তারা বধির, বোবা ও অন্ধ। তারা (হকের দিকে) আদৌ ফিরে আসবে না’ (বাকারা : ১৮)।

 

আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টিকারী

মানুষ আল্লাহর দিকে আসতে চাইলে মুনাফিকরা নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তারা আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করে। তারা যা করছে, তা খুবই মন্দ’ (মুনাফিকুন : ২)।

 

অহংকারী

মুনাফিকরা অহংকারী ও দাম্ভিক। এ প্রসঙ্গে মহান মাবুদ ইরশাদ করেন, ‘আপনি তাদের দেখবেন যে তারা অহংকার করে মুখ ফিরিয়ে নেয়’ (মুনাফিকুন : ৬)।

 

প্রতারক

মুনাফিকদের প্রতারক হওয়া প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘অবশ্যই মুনাফিকরা আল্লাহর সঙ্গে প্রতারণা করছে, অথচ তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতারিত করে। বস্তুত তারা যখন নামাজে দাঁড়ায় তখন একান্ত শিথিলভাবে লোকদেখানোর জন্য দাঁড়ায়। তারা আল্লাহকে অল্পই স্মরণ করে। এরা দোদুল্যমান অবস্থায় ঝুলন্ত; এদিকেও নয়, ওদিকেও নয়’ (নিসা : ১৪৩-১৪৪)।

 

এ ছাড়া কোরআন ও হাদিস শরিফে মুনাফিকদের অসংখ্য বৈশিষ্ট্য ও চারিত্রিক দোষ-ত্রুটি বর্ণিত আছে।

 

মুনাফিকের শাস্তি ও পরিণতি

সুরা আন-নিসার ১৪৫তম আয়াতে আল্লাহতায়ালা স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, ‘মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্ব নিম্নস্তরে অবস্থান করবে।’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘মুনাফিকরা অগ্নিগর্ভ সিন্দুকে থাকবে।’ হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তাদের ঊর্ধ্বে ও নিম্নে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হবে।’

 

হে দয়াময়, আমাদের এসব থেকে হেফাজত করুন। আমীন!

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads