• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

সত্য আদর্শ সমুন্নত রাখাই কারবালার শিক্ষা

  • সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
  • প্রকাশিত ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

হিজরি সালের মর্যাদাপূর্ণ মহররম মাসের ১০ তারিখ পবিত্র আশুরা- ঐতিহাসিক ঘটনাবহুল ও ব্যাপক তাৎপর্যময় একটি দিবস। এদিন অন্যায়ের প্রতিবাদ ও ন্যায়ের আদর্শের জন্য আত্মত্যাগের মহিমান্বিত স্মৃতিবিজড়িত কারবালার শোকাবহ, মর্মস্পর্শী, হূদয়বিদারক ও বিষাদময় ঘটনা সংঘটিত হয়। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৬১ হিজরির ১০ মহররম আশুরার দিনে ইরাকের কুফা নগরের অদূরে ফোরাত নদীর তীরবর্তী কারবালা প্রান্তরে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) বিশ্বাসঘাতক অত্যাচারী শাসক এজিদের নিষ্ঠুর সেনাবাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ ও পরিবেষ্টিত হয়ে পরিবার-পরিজন এবং ৭২ জন সঙ্গীসহ নির্মমভাবে শাহাদতবরণ করেন।

তাঁদের অবরুদ্ধ দিনগুলো ছিল মানবেতর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। অবরুদ্ধ ইমাম বাহিনীর তাঁবুর পাশেই ফোরাত নদী। তাঁবু থেকে নদীর বয়ে যাওয়া কলকল ধ্বনি কানে আসে; কিন্তু ফোরাতের এক ফোঁটা পানিও মুখে পড়ে না ইমাম বাহিনীর। কারণ এজিদের পাপিষ্ঠ সৈনিক দল যে নদীও অবরুদ্ধ করে রেখেছে। হে ফোরাত! তোমার পানি পিয়ে কত শত প্রাণ তৃষ্ণা মিটিয়েছে। এজিদের কত সৈনিক তোমার পরশে শীতল হয়েছে। সৃষ্টির শুরু থেকে কিয়ামত পর্যন্ত আরো কত তৃষিত প্রাণে তুমি স্পন্দন জোগাবে। কিন্তু নবী-দুলাল তোমার থেকে এক চুমুক পানিও পাননি— এ যন্ত্রণা তুমি কী করে ভুলবে? যখন পানির বদলে রক্তমাখা তীর নিয়ে ফিরল শিশু আসগর, হে কারবালা! তখন তুমি কী প্রার্থনা করেছিলে প্রভুর কাছে? তুমি কি চেয়েছিলে, তোমার থেকেই প্রবাহিত হোক নতুন কোনো আবে জমজম কিংবা এক এজিদ বাহিনীর কবর রচনা হোক তোমার বুকে?

আহত অবস্থায় হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) একাকী শত্রুবাহিনীর ওপর বীর বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং অসীম সাহসিকতার সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ করে শহীদ হন। ইমাম হোসাইন (রা.) কারবালার ময়দানে অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে শাহাদতবরণ করেছেন; কিন্তু অসত্য, অধর্ম ও অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি। তারুণ্য-দীপ্ত ঈমানের অধিকারী ইমাম হোসাইন (রা.) অন্যায়ের প্রতিবাদে নিজের জীবন উৎসর্গ করে মুসলিম উম্মাহকে শিখিয়েছেন— ‘বাতিলের সামনে মাথানত নয়, ঈমান বিকিয়ে দেব না।’

ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন বাজি রেখে সপরিবারে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। ইসলামের সুমহান আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য তাঁর এ বিশাল আত্মত্যাগ ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার মুসলিম উম্মাহর জন্য এক উজ্জ্বল ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। কারবালার ঘটনা থেকে মানবগোষ্ঠীর জন্য যেসব শিক্ষা রয়েছে, তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তবু ক্ষমতার লোভে কিংবা ন্যায়নীতির প্রশ্নে আপস করেননি। খিলাফতকে রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রে রূপান্তরে এজিদের বলপ্রয়োগে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের চক্রান্তের প্রতি আনুগত্য স্বীকার না করে তিনি প্রত্যক্ষ সংগ্রামে লিপ্ত হন। বিশ্ববাসীর কাছে তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও ন্যায়ের পক্ষে প্রতিরোধ সংগ্রামের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।

সেদিন রাজতন্ত্রের জনক কুখ্যাত এজিদের কাছে বায়াত গ্রহণ না করার ফলে যুগ যুগ ধরে বিশ্ব মুসলমানরা ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক’ হিসেবে স্মরণ করছেন ইমাম হোসাইন (রা.)-কে। বলা যায়, আধিপত্যবাদ, অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর সুমহান আদর্শের জন্য আত্মত্যাগের বেদনাবিধুর ও শোকবিহ্বল ঘটনার স্মরণে প্রধানত আশুরা পালিত হয়।

ইসলামের ইতিহাসে ফজিলতময় আশুরা বিভিন্ন ঘটনাপুঞ্জে সমৃদ্ধ থাকলেও সবশেষে সংঘটিত কারবালা প্রান্তরে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদতই এ দিবসের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

ঐতিহাসিক ১০ মহররম চিরকাল বিশ্বের নির্যাতিত, অবহেলিত এবং বঞ্চিত মানুষের প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা জোগাবে। এভাবে পৃথিবীতে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে আশুরার দিবসে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদত এক অনন্য, অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে। ইসলামের কালজয়ী আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্যই কারবালায় নবীবংশের আত্মত্যাগ হয়েছিল। মূলত আশুরার দিনে মুসলমানরা ন্যায় প্রতিষ্ঠাকল্পে আত্মত্যাগের এক অনুপম আদর্শ শিক্ষা গ্রহণ করেন। কারবালার রক্তাক্ত সিঁড়ি বেয়েই ইসলামের পুনরুজ্জীবন ঘটে। কারবালা ট্র্যাজেডির বদৌলতেই ইসলাম স্বমহিমায় পুনরুজ্জীবিত হয়েছে।

কারবালার শোকাবহ ঘটনায় চিরন্তন সত্যের মহাবিজয় হয়েছিল এবং বাতিলের পরাজয় ঘটেছিল। ইমাম হোসাইন (রা.) আসল এবং নকলের পার্থক্যটা পরিষ্কার করে দেখিয়ে গেছেন। তাকে ও তার সঙ্গী-সাথীদের যারা শহীদ করতে এসেছিল এবং যারা তার সামনে দাঁড়িয়েছিল, তারা ছিল নকল মুসলমান। যুগ যুগ ধরে এভাবেই প্রকৃত ও কপট মুসলমানরা চিহ্নিত হয়ে আসছে এবং আসবে। তাই তো কবি বলেছেন, ‘প্রত্যেক কারবালার পরেই ইসলাম জেগে ওঠে।’ মহররমের ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হওয়ার শিক্ষা যাবতীয় অন্যায়-অবিচার-অসত্য ও স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে সবসময় রুখে দাঁড়ানো। কোনো সমাজে বা রাষ্ট্রে এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হলে সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিরোধ করাই হোক কারবালার মূলমন্ত্র!

আশুরা দিবসে কারবালার শিক্ষণীয় ও করণীয় হলো, অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামীদের সামনে প্রতিপক্ষের তরফ থেকে কোনো সময় অর্থ, বিত্ত ও সম্মানের লোভনীয় প্রস্তাব এলেও ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করে আপসহীন মনোভাবের মাধ্যমে ত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে হবে। কারবালার শোকাবহ ঘটনার স্মৃতিতে ভাস্বর আশুরার শাশ্বত বাণী তাই অন্যায় প্রতিরোধ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে চলার প্রেরণা জোগায়। তাই মর্সিয়া ক্রন্দন নয়, কারবালার বাস্তব শিক্ষা, অর্থাৎ সত্যের জন্য আত্মত্যাগের যে অতুলনীয় শিক্ষা, তা সাদরে গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, ‘ফিরে এলো আজ সেই মহররম মাহিনা/ ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।’

রাসুলে খোদার বংশের ওপর সংঘটিত জুলুম অন্যায় ও অত্যাচারের প্রতিবাদ যারা করবে, তারাই হবে সত্য দ্বীনের প্রকৃত অনুসারী ও জিহাদি। রাসুলে করিম (সা.)-কে যারা প্রকৃত অর্থে ভালোবাসেন ও আহলে বায়াতদের বিশ্বাস করেন, তারা তাঁর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র ও বংশধরদের হত্যাকাণ্ডের স্মরণ ও প্রতিবাদ কিয়ামত পর্যন্ত শোকের মাধ্যমে করতে থাকবে।

আশুরার চেতনা জাতীয় জীবনে প্রতিফলিত হোক এবং সমাজ থেকে অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতনসহ সব অনাচার দূর হয়ে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক!

 

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads