• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
বিসমিল্লাহর তাৎপর্য

ফাইল ছবি

ধর্ম

বিসমিল্লাহর তাৎপর্য

  • সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
  • প্রকাশিত ১১ অক্টোবর ২০১৯

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম, গুচ্ছ গুচ্ছ আরবি শব্দাক্ষরে বিন্যস্ত একটি বাক্য। প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সময়, কাল, ভূখণ্ড ও অঞ্চলেরর সীমা অতিক্রম করে এসেছেন সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে আল্লাহর প্রতিনিধি হয়ে- বিশ্বমানবতার ইহলৌকিক-পারলৌকিক মুক্তির উদ্দেশ্যে। এসেছেন চির প্রবীণ, চির নবীন, শাশ্বত, চিরন্তন, সর্বকালের ও সর্বযুগের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ইসলাম ধর্ম নিয়ে। কালক্রমে রাত দিনের বিবর্তনে, সময়ের ঘূর্ণনে সে ধর্ম ছড়িয়ে পড়েছে যুগ থেকে যুগান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে।

আরব ভূখণ্ড থেকে হাজারো মাইল দূরে অবস্থিত লাল সবুজের পতাকা খচিত বাংলাদেশ। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলাম। ঐতিহাসিকভাবেই এ দেশের মানুষ ধর্মভীরু, ধর্মের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। তাই ঐতিহাসিক কারণেই বাঙালি মুসলমানদের কাজ-কর্মে, আচার-আচরণে ‘বিসমিল্লাহ’, ‘ইনশাআল্লাহ’, ‘মাশাআল্লাহ’ ও ‘আস্সালামু আলাইকুম’সহ বহু আরবি শব্দের প্রচলন ঘটেছে। ব্যক্তির ধর্ম আদর্শ ও চিন্তা-চেতনা, তার কর্ম, আচরণ ও সংস্কৃতিতে প্রভাব ফেলবে- এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এসব বাক্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরবি ব্যাকরণগত বিধিবদ্ধতার পাশাপাশি রয়েছে ধর্মীয় ব্যবহারবিধি ও সীমাবদ্ধতা। অনেকের না জানার কারণে সেসব ব্যবহারবিধি প্রায়ই লঙ্ঘিত হচ্ছে। এতে কেবল উদ্দেশ্যেরই বিচ্যুতি ঘটছে না; বড় ধরনের পাপ হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। এ নিবন্ধে ‘বিসমিল্লাহ’ নিয়ে আলোচনা করা হলো-

বিসমিল্লাহর ঐতিহাসিক পটভূমি

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম- এ বাক্যটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেছেন হজরত সুলায়মান (আ.)। সাবা নগরীর রানি বিলকিসের কাছে লেখা চিঠিতে তিনি এ বাক্যটি ব্যবহার করেছেন। পবিত্র কোরআনের সুরা নামলের ২৯-৩০ নম্বর আয়াতে সে চিঠির বিবরণ উল্লেখ রয়েছে। এরপর রাসুল (সা.) ছাড়া আর কোনো নবীকেই বিসমিল্লাহর বিধান দেওয়া হয়নি। প্রাথমিক যুগে রাসুল (সা.) ‘বিসমিকাল্লাহুম্মা’ লিখতেন। তারপর সুরা হুদের ৪১তম আয়াতে ‘বিসমিল্লাহি মাজরেহা’ নাজিল হলে তিনি কেবল ‘বিসমিল্লাহ’ লিখতে শুরু করেন। এরপর সুরা বনি ইসরাইলের ১০ নম্বর আয়াতে ‘কুলিদ্য়ুল্লাহা আওয়িদ্উর রাহমান’ অবতীর্ণ হলে তিনি ‘বিসমিল্লাহির রহমান’ লিখতে শুরু করেন। এরপর সুরা নামলের ৩০তম আয়াতে পুরো বিসমিল্লাহ নাজিল হলে তিনি পুরো ‘বিসমিল্লাহ’ লেখার রীতি প্রচলন করেন (রুহুল মাআনি)।

বিসমিল্লাহর তাৎপর্য ও দর্শন

ইসলাম কেবল পারলৌকিক ধর্ম নয়; এ ধর্মে ইহকাল ও পরকালের মধ্যে যৌক্তিক ভারসাম্য স্থাপন করা হয়েছে। ইসলামের নামাজ ও ইবাদত মসজিদের সঙ্গে সীমাবদ্ধ নয়। পৃথিবীর যে কোনো পবিত্র স্থানে নামাজের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এ ধর্মে বৈরাগ্যবাদ, কর্মহীন তপস্যার অনুমতি দেওয়া হয়নি। ইবাদতের জন্য ইহকালকে বর্জন করতেও বলা হয়নি। বরং এমন দুর্লভ ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে দুনিয়ার কাজও দিনের কাজে রূপান্তরিত হয়। বাহ্যত মানুষ পার্থিব কাজ করছে, অথচ সে পরকালের উদ্দেশ্যে পরমাত্মার ডাকে সাড়া দিচ্ছে। ইসলামী শিক্ষা অনুসারে প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি স্থানে, প্রতিটি কাজে এমন কিছু জিকির ও দোয়া বাতলে দেওয়া হয়েছে, যার ওপর আমল করতে কোনো পরিশ্রম হয় না। কাজেও ন্যূনতম ব্যাঘাত ঘটে না। অথচ এসবের মাধ্যমে নিজ নিজ কর্মে লিপ্ত মানুষগুলোও ঐশ্বরিক সূতিকায় গেঁথে যায়। অদৃশ্যের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায়।

বিসমিল্লাহও এমন এক বাক্য, যার মাধ্যমে ক্ষুদ্র মানুষ মহা ক্ষমতাবান স্রষ্টার সঙ্গে সংযুক্ত হয়। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে সেতুবন্ধ রচিত হয়। মর্ত্যের সঙ্গে মহাকালের সংযোগ স্থাপিত হয়। বিসমিল্লাহ কেবল একটি বাক্য নয়, এর মাধ্যমে আল্লাহর বড়ত্ব প্রকাশ পায়। একত্ববাদের সাক্ষ্য দেওয়া হয়। আল্লাহর নিয়ামতের স্বীকার করা হয়। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া হয়। আল্লাহর নাম নিয়ে শয়তানকে বিতাড়িত করা হয়। মুসলমানিত্বের জানান দেওয়া হয়।

ইসলামে বিসমিল্লাহর অবস্থান

পবিত্র কোরআন শুরু করা হয়েছে বিসমিল্লাহর মাধ্যমে। শ্রেষ্ঠতম ইবাদত নামাজের প্রত্যেক রাকাত শুরু হয় বিসমিল্লাহ দিয়ে। শ্রেষ্ঠতম স্থান মসজিদে প্রবেশ করতে হয় বিসমিল্লাহ পড়ে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘জিবরাইল (আ.) যখনই আমার কাছে অহি নিয়ে আসতেন, তিনি বিসমিল্লাহ পড়তেন।’ (দারে কুতনি)। কোরআনের একটি সুরা ছাড়া সব সুরার শুরুতে বিসমিল্লাহ রয়েছে। হাদিসের কিতাবগুলো শুরু করা হয়েছে বিসমিল্লাহ দিয়ে। রাসুল (সা.) সমকালীন সব রাজা-বাদশাহর কাছে চিঠি লিখেছেন বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু করে। এরপর হুদাইবিয়ার ঐতিহাসিক সন্ধিপত্রে রসুল (সা.) পুরো বিসমিল্লাহ লিখতে বলেছেন। অবশ্য লেখার পর কাফেরদের আপত্তির কারণে কেবল ‘বিসমিকাল্লাহুম্মা’ রাখা হয়। (আহকামুল কোরআন লিল জাস্সাস, খ. ১, পৃ. ৮)।

ঐতিহাসিক ‘মদিনা সনদ’ও শুরু হয়েছে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’-এর মাধ্যমে। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খ. ২ পৃ. ২২৩)।

বিসমিল্লাহ পবিত্র কোরআনের একটি অংশবিশেষ হওয়ার ব্যাপারে কারোই দ্বিমত নেই। তাই তারাবিহর নামাজে একবার উচ্চৈঃস্বরে বিসমিল্লাহ না পড়লে খতমে কোরআন আদায় হবে না।

বিসমিল্লাহ ব্যবহারের স্থানগুলো

ইসলামী শরিয়তে শব্দভেদে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিসমিল্লাহ ব্যবহারের পদ্ধতি শেখানো হয়েছে। এ ছাড়াও ওজু-নামাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়তে হয়। আর কোনো প্রাণী বিসমিল্লাহ ছাড়া জবাই করলে তা ভক্ষণ করা বৈধ নয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যেসব প্রাণীর ওপর আল্লাহর নাম নেওয়া হয়নি, তোমরা সেগুলো ভক্ষণ করো না।’ (সুরা আনআম : ১২১)। হানাফি ও মালেকি মাজহাব মতে, জীবজন্তু শিকারের আগেও বিসমিল্লাহ পড়তে হয়। খাওয়ার শুরুতে পুরো বিসমিল্লাহ পড়া সুন্নাত। তায়াম্মুমের শুরুতে বিসমিল্লাহ পাঠ করা সুন্নাত। এ ছাড়াও কোরআন পাঠের সময়, যানবাহনে আরোহণের সময়, ঘরে ও মসজিদে প্রবেশের সময় কিংবা বের হওয়ার সময়, বাতি প্রজ্বলিত করার সময়, বাতি নেভানোর সময়, প্রাকৃতিক ও বৈধভাবে জৈবিক চাহিদা পূরণের সময়, মিম্বরে আরোহণের সময়, কোনো পাত্র ঢেকে রাখার সময়, লিখিত ও গ্রন্থিত যে কোনো কাগজের শুরুতে ও মৃতদের কবরস্থ করার সময় বিসমিল্লাহ পড়া হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। এ বিষয়ে মূলনীতি হলো, প্রত্যেক ভালো কাজই বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু করতে হবে।

বিসমিল্লাহর বিকল্প ব্যবহার

কেউ কেউ বিসমিল্লাহর পরিবর্তে ৭৮৬ ব্যবহার করেন, এটি পুরো বিসমিল্লাহর সংখ্যার মান হলেও এতে বিসমিল্লাহর সুন্নাত আদায় হবে না। (আহসানুল ফতোয়া, খণ্ড ৮, পৃ. ২৪/ আপকে মাসায়েল, খ. ২ পৃ. ৫৭১) একইভাবে ‘বিসমিহি তায়ালা’ ব্যবহার করলেও সাওয়াব হবে না। রসুল (সা.)-এর যুগ থেকে চিঠিপত্রে, সরকারি কাগজপত্রে, লিখিত যে কোনো বস্তুর শুরুতে বিসমিল্লাহ লেখার রীতি প্রচলিত রয়েছে। সুরা নাহলের ৩০ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরে কুরতুবিতে রয়েছে, ‘গ্রন্থ, চিঠিপত্র ও সীলমোহরের ওপর বিসমিল্লাহ লেখার বিষয়ে সবাই ঐকমত্য পোষণ করেছেন... এ প্রথা আবহমানকাল থেকেই চলমান।’ একই কথা ওই আয়াতের অধীনে তাফসিরে রুহুল মাআনিতেও রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিসমিল্লাহর অনুবাদ পাঠ করলে কিংবা লিখলে বিসমিল্লাহর সুন্নাত আদায় হবে কি? প্রসিদ্ধ ফতোয়াগ্রন্থ আহসানুল ফতোয়াতে রয়েছে, ‘বিসমিল্লাহর পরিবর্তে অন্য বাক্যের ব্যবহার কোরআন, রাসুল (সা.)-এর আমল ও উম্মতের পরম্পরাগত কর্মের বিরোধী‘।’ (ঐ, খণ্ড. ৮, পৃ. ২৪) ইসলামী শরিয়তের অন্যতম মূলনীতি হলো, শরিয়ত যেসব স্থানে যে পদ্ধতিতে কোনো ইবাদত করতে বলেছে, সেগুলোর বিকল্প ব্যবহার নিষিদ্ধ। কোরআন-সুন্নাহ বর্ণিত দোয়াগুলোর ক্ষেত্রেও শরিয়তের নির্ধারিত শব্দ ব্যবহার করতে হয়। তাই নামাজে বিসমিল্লাহ, ফাতেহা, সুরা ও খোতবা আরবিতেই পড়তে হয়। একই কারণে সালামের বাংলা হিসেবে ‘আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক’ বললে সালাম আদায় হবে না। যেমনটা কাউকে তার নামের অর্থের আলোকে ডাকা সমীচীন নয়। তা ছাড়া ‘আল্লাহ’ শব্দের বঙ্গানুবাদ ‘স্রষ্টা’ শব্দ দিয়ে করা ভুল। স্রষ্টা বোঝাতে আরবিতে খালেক শব্দ ব্যবহার করা হয়। তর্কশাস্ত্রের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ শরহে তাহজিবে আল্লাহর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ ওই সত্তা, যার অস্তিত্ব সদা বিরাজমান, যিনি সব ধরনের পূর্ণতা ও গুণাবলির অধিকারী।’ আর স্রষ্টা তাঁর একটি গুণবাচক নামমাত্র।

বিসমিল্লাহর অপব্যবহার

খুবই দুঃখজনক কথা হলো, আমাদের অজ্ঞতার কারণে এ দেশে বিসমিল্লাহর অপব্যবহার বেড়ে চলছে। রাজনৈতিক নেতারা ‘বিসমিল্লাহ’ বলে বক্তৃতা শুরু করে থাকেন অথচ রাসুল (সা.) বক্তৃতাকালে হামদ বা আল্লাহর প্রশংসা করতেন। তিনি লেখালেখির ক্ষেত্রেই বিসমিল্লাহকে প্রাধান্য দিতেন। কেউ কেউ বক্তৃতার সূচনায় ‘আউজুবিল্লাহ’ও পড়ে থাকেন। অথচ কোরআন পাঠ ছাড়া অন্যত্র ‘আউজুবিল্লাহ’ পড়া কোরআন-সুন্নাহবিরোধী। তবে রাগ উঠলে, বাথরুমে যেতে আউজুবিল্লাহ পড়ার কথা রয়েছে। (তাফসিরে মা’আরেফুল কোরআন, খ. ৫, পৃ. ৪০১)। রাজনৈতিক পোস্টার থেকে শরিয়ত নিষিদ্ধ পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের পোস্টার, বিজ্ঞাপন ও লিফলেটে ‘বিসমিল্লাহ’র ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা যাচ্ছে। পাকিস্তানের সাবেক প্রধান মুফতি আল্লামা শফী (রহ.) লিখেছেন, ‘যদি কোনো কাগজের অপব্যবহার ও মর্যাদাহানি হওয়ার আশঙ্কা প্রবল হয়, তবে সেক্ষেত্রে বিসমিল্লাহ লিখবে না।’ (ফতোয়া ওসমানি, খ. ২, পৃ. ১৪৫)।

 

নিষিদ্ধ কাজ বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু

কোনো নিষিদ্ধ কাজ বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু করা হারাম ও কুফরি। একটি লিফলেটের নমুনা দেখুন : ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম, স র গ ম সংগীত একাডেমিতে সংগীত, নৃত্য, গিটার ও তবলা বিভাগে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি চলছে।’ আমাদের দেশে একটি প্রতিষ্ঠানের নাম ‘বিসমিল্লাহ ফ্যাশন’। এসব কেবল অজ্ঞতাই নয়; ধৃষ্টতাও বটে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি, অনেক সিনেমা হলে ছবি প্রদর্শনের আগে ‘বিসমিল্লাহ’ লেখা ভেসে আসে। এটি যদি অবজ্ঞা করে করা হয়, তাহলে তারা অবশ্যই কাফের হয়ে যাবে। আর অজ্ঞতাবশত করলেও এটি একটি কুফরি কাজ। কেউ যদি দোয়া-দরুদ নিয়ে ঠাট্টা করে অথবা মদ্যপানের সময়, ব্যভিচারের সময় কিংবা অকাট্য হারাম কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ পাঠ করে, সে কাফের হয়ে যাবে।

 

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads