• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

মহানবী (সা.)-এর কিছু অলৌকিক ঘটনা!

  • সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
  • প্রকাশিত ০৮ নভেম্বর ২০১৯

মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) বর্তমান সৌদি আরবে অবস্থিত মক্কা নগরীর কুরাইশ বংশের বনি হাশিম গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। প্রচলিত ধারণা মোতাবেক, তার জন্ম ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট বা ১২ রবিউল আওয়াল বা আরবি রবিউল আওয়াল মাসের ১২ তারিখ। বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক ও মহামানব।

মানুষ যাতে নবী রসুলদের প্রতি আস্থা স্থাপন করে সে জন্য তাদের আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন কিছু ক্ষমতা দান করা হয় যা অলৌকিক ক্ষমতা বলে বিবেচিত। আখেরি নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-ও ছিলেন এমনই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। প্রসঙ্গত, আকায়ে নামদার তাজেদারে মদিনা, দুলালে আমিনা হজরত মোহাম্মদ মুস্তফা আহমদ মুস্তফা (সা.) যে সত্যই আল্লাহর রসুল, তা তাঁর শৈশবের অনেক ঘটনা থেকেই প্রকাশ পায়, যা কোনো সাধারণ শিশুর পক্ষে সম্ভব নয়।

হজরত হালিমা বর্ণনা করেন, শিশু মোহাম্মদ (সা.)-কে আমার গৃহে আনার সঙ্গে সঙ্গেই রহমত বরকত প্রকাশ হতে লাগল। এত পরিমাণ দুধ নির্গত হলো যে, হজরত (সা.) এবং তাঁর দুধ ভাই একান্ত তৃপ্তির সঙ্গেই দুধ পান করে ঘুমিয়ে পড়তেন। আর উটনির দিকে চেয়ে দেখতে পাই, সেগুলোর স্তন দুধে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে।

বিবি হালিমা বলেন, আমার স্বামী উটনির দুধ দোহন করলেন এবং আমরা তৃপ্তির সঙ্গে তা পান করে সারা রাত আরামে কাটালাম। দীর্ঘদিন পর এটাই প্রথম রাত্রি, যাতে আমরা শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম। আমার স্বামী বললেন, হালিমা! তুমি খুবই ভাগ্যবান শিশু নিয়ে এসেছ। আমি বললাম, আমারও এটাই ধারণা, এই শিশু অত্যন্ত সৌভাগ্যবান।

বিবি হালিমা আরো বলেন, ‍‍‍মক্কা থেকে ফেরার পথে শিশু মোহাম্মদ (সা.)-কে কোলে নিয়ে যে দুর্বল বাহনটিতে চলতে লাগলাম, মোহাম্মদ (সা.)-এর বরকতে বাহনটি এত দ্রুত চলল যে, সবার বাহনকেই হার মানাল। আমার সাথি মহিলারা আশ্চর্য হয়ে বলতে লাগল, ‘এটা কি সেই দুর্বল সাওয়ারি যার ওপর আরোহণ করে তোমরা প্রথম এসেছিলে?’ এরপর বাড়ি এসে দেখলাম, সমস্ত বকরি দুধে পূর্ণ হয়ে আছে। অথচ কিছুক্ষণ পূর্বে সেগুলো দুধশূন্য ছিল।

আমার গোত্রের লোকেরা তাদের রাখালদের নির্দেশ দেয় যে, তোমরাও তোমাদের পশু ওই জায়গায় চরাও যেখানে হালিমার বকরি চরে, কিন্তু তা তো চারণ ক্ষেত্রের বিশেষত্ব ছিল না। বরং গায়েবি মদত ও বরকত এর মধ্যে নিহিত ছিল, তা ওই সমস্ত লোক কোথায় পাবে। এভাবে আমরা প্রায়ই তাঁর বরকতের ঘটনাবলি প্রত্যক্ষ করতাম।

হজরত হালিমা বর্ণনা করেছেন, তিনি কখনো শিশু মোহাম্মদ (সা.)-কে উলঙ্গ অবস্থায় রাখতে পারতেন না। সেরূপ করলেই তিনি চিৎকার করে কাটাতেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তার শরীরের ওপর চাদর টেনে দেওয়া না হতো ততক্ষণ তিনি ক্রন্দন থামাতেন না। তিনি বলেন, যেদিন হতে আমি জানতে পারলাম, শিশু মোহাম্মদ (সা.) উলঙ্গ থাকতে পছন্দ করেন না, সেদিন হতে আর কখনো তাঁকে উলঙ্গ রাখিনি। তাঁর দেহ আবৃত করে রাখার জন্য সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রাখতাম।

হজরত আব্বাস বিন আবদুল মুত্তালিব (রা.) বর্ণনা করেছেন, তিনি রসুল (সা.)-কে বলেছেন, আপনার নবুয়তের একটি মাত্র নিদর্শন ছিল আমার ইসলাম গ্রহণের কারণ। তা হলো, তিনি দেখলেন, রসুল (সা.) শৈশব অবস্থায় অঙ্গুলি সংকেতে চাঁদকে ইশারা করছেন। রসুল (সা.) যে দিকেই তাঁর অঙ্গুলি ফেরাচ্ছিলেন, চাঁদও ঠিক সেদিকেই আসা-যাওয়া করছিল। (বায়হাকি)।

রসুল (সা.) নবী হওয়ার এও একটি উজ্জ্বল প্রমাণ— শিশু হজরত (সা.) হালিমার গৃহে থাকাকালে কখনো তাঁর উভয় স্তন হতে দুধ পান করেননি। সব সময় তিনি একটি স্তন থেকেই দুধ পান করতেন। অপরটি তাঁর দুধভাইয়ের জন্য রেখে দিতেন। ন্যায়বোধের এমন চরম দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে খুবই বিরল। সত্যই এটা একজন মহামানবের পক্ষেই সম্ভব হতে পারে।

শিশু রসুল (সা.)-এর দ্রুত বর্ধনশীল দৈহিক অবস্থাও একটি লক্ষণীয় বিষয়। দুমাস বয়সের সময় তিনি অন্যান্য শিশুর সঙ্গে হামাগুড়ি দিয়ে ফিরতে লাগলেন। তিন মাসের সময় দেয়াল ধরে হাঁটতে লাগলেন। যখন তাঁর বয়স মাত্র পাঁচ মাস তখন বিনা অবলম্বনে হাঁটতে শিখলেন। সাত মাস বয়সের সময় তিনি ফিরতে লাগলেন এবং মাত্র আট মাস বয়সের সময় তিনি কথা বলতে সক্ষম হন। তাঁর এই গুণগুলো নিশ্চয়ই তাঁর মুজেজার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত এবং তিনিই উম্মতে মোহাম্মদির শাফায়েতের কাণ্ডারি।

সারোয়ারে কায়েনাত দোজাহানের সম্রাট রসুল (সা.) অতি শৈশবকাল থেকেই একান্তভাবে পাকসাফ থাকতেন। শিশুরা সাধারণত নিজের পায়খানা প্রস্রাব নিজের অঙ্গে-প্রত্যঙ্গে বা জামাকাপড়ে মেখে থাকে, এমনকি তা মুখে দিয়ে থাকে। রসুল (সা.)-এর দুধমাতা হালিমা (রা.) বর্ণনা করেন, শিশু মোহাম্মদ (সা.) কখনো বিছানায় প্রস্রাব পায়খানা করে নিজ অঙ্গ বা কাপড় অপবিত্র করেননি। তাঁকে বিছানা থেকে উঠিয়ে দুপায়ের ওপর দাঁড় করানো ব্যতীত কখনো পায়খনা প্রস্রাব করতেন না। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে পরিষ্কার করে দিতাম। তিনি যে আল্লাহতায়ালার সৃষ্ট নূরের তৈরি মানুষ তাতে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। সুতরাং সর্বাবস্থায় পাকসাফ থাকা তাঁর পক্ষে অস্বাভাবিক কিছু নয়।

মহানবী (সা.)-এর দেহ নূরের তৈরি বলে তাঁর শরীরের কোনো ছায়া ছিল না। মানুষের ছায়া কত ময়লা-আবর্জনার ওপর পতিত হয়, কত পশু-পাখি অথবা মানুষের পায়ের তলায় পতিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র দেহের ছায়া এভাবে অপদস্থ হওয়া আল্লাহতায়ালার অভিপ্রেত নয়। এজন্য আল্লাহতায়ালা তাঁর দেহ ছায়াহীন করে তৈরি করেছেন।

একই কারণে তাঁর দেহের ওপর কখনো মাছি বসেনি। কেননা মাছি অপবিত্র বস্তু হতে জন্ম লাভ করে। তাই মাছির দেহও অপবিত্র। তাই তা রসুল (সা.)-এর শরীরে কোনোদিন স্থান পায়নি।

হজরত মাইসারা (রা.) ছিলেন হজরত খাদিজা (রা.)-এর দাস। তাঁকে খাদিজা (রা.) রসুল (সা.)-এর খেদমতে পেশ করেন। তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করে বিম্ময়ে অভিভূত হয়েছেন। তিনি দেখেছেন, রসুল (সা.) যখন পথ দিয়ে চলতেন, তখন এক খণ্ড মেঘ তাঁর মাথার ওপর ছায়া বিস্তার করে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ভেসে বেড়াত। মানুষের প্রতি প্রকৃতির এই যে অযাচিত অভাবিক কার্যকলাপ, এটা নিঃসন্দেহে রসুল (সা.)-এর একটি বড় রক মুজেজা, যা রসুল (সা.)-এর শৈশবকাল থেকেই লক্ষ করা যায়।

উল্লিখিত প্রত্যেকটি বিষয়ই রসুল (সা.)-এর শৈশবকালীন মুজেজা। তবে এগুলো স্থায়ী নয়।

নবী (সা.)-এর অন্যতম অলৌকিক ঘটনা ‘রদ্দে শামস’। এটি হলো অস্তমিত সূর্যকে ফিরিয়ে আনয়ন করা। হজরত আসমা বিনতে ওমায়স (রা.) থেকে বর্ণিত আছে- একদা নবী করিম (সা.) খায়বারের কাছে ‘সাহবা’ নামক স্থানে ছিলেন। তার মাথা মোবারক হজরত আলী (রা.) কোলে রেখে বিশ্রাম করছিলেন। হজরত আলী (রা.) কিন্তু আসরের নামাজ আদায় করেননি। এমতাবস্থায় ওহি নাজিল শুরু হলো। শেষ পর্যন্ত সূর্য অস্তমিত হয়ে গেল। নবীজি (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা কি আসরের নামাজ আদায় করেছ?’ হজরত আলী (রা.) বললেন, ‘না।’ তখনই রসুলুল্লাহ (সা.) হস্ত উত্তোলন করে দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! আলী আপনার রসুলের অনুগত ছিল, সূর্য ফিরিয়ে দিন, যাতে সে আসরের নামাজ সঠিক ওয়াক্তে আদায় করতে পারে।’ হজরত আসমা বিনতে মায়স (রা.) বলেন, ‘অস্তমিত সূর্য পুনরায় দিগন্তে দৃশ্যমান হলো।’ ইমাম তাহাবি (রহ.) বলেন, ‘হাদিসটি বিশুদ্ধ। হাদিসের সব বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য।’

শায়খ জালাল উদ্দীন সুয়ুতি (রহ.) উল্লিখিত হাদিসটি সম্পর্কে ‘কাশফুল লাবস আন হাদিসে রদ্দে শামস’ নামে একটি ক্ষুদ্র পুস্তিকা রচনা করেছেন। ওই পুস্তিকায় হাদিসের সনদ নিয়ে আলোচনা করে হাদিসের বিশুদ্ধতা প্রমাণ করেছেন।

মহানবী (সা.) মিরাজ থেকে প্রত্যাবর্তন করে কুরাইশদের সম্মুখে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ এবং স্বীয় ভ্রমণকাহিনী ও মিরাজের ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন। কুরাইশরা ঘটনার সত্যতা যাচাই করার জন্য বায়তুল মোকাদ্দাসের বিভিন্ন নিদর্শন সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিল এবং বাণিজ্য উপলক্ষে সিরিয়ার দিকে যে কাফেলা গমন করেছিল, তারা কখন মক্কায় প্রত্যাবর্তন করবে, তা জানতে চেয়েছিল।

মহানবী (সা.) উত্তর দিয়েছিলেন, ‘তারা বুধবার মক্কায় পৌঁছবে।’ বুধবার আস্তে আস্তে অতিক্রান্ত হতে চলল, দিবসের পড়ন্ত বেলাও অতিক্রম হতে চলল। এমনকি সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার নিদর্শন পরিলক্ষিত হতে লাগল; কিন্তু কাফেলা মক্কায় পৌঁছেনি। তাই মক্কার কাফিরকুল তার নবুয়তের সত্যতা সম্পর্কে সমালোচনা করতে শুরু করে দিল। এমতাবস্থায় রসুলুল্লাহ (সা.) দোয়া করলেন, আল্লাহপাক সূর্যের গতিরোধ করলেন। কাফেলা মক্কায় প্রবেশ করা পর্যন্ত সূর্য থেমে ছিল।

বিশ্বনবীর জীবনে শ্রেষ্ঠ মুজেজা হচ্ছে আল-কোরআন, যা কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী থাকবে। তা ছাড়া আমরা তাঁর জীবনী আলোচনা করলে দেখতে পাই, মহানবী (সা.)-এর পুরো সংগ্রামী জীবনটাই অলৌকিকতায় পরিপূর্ণ, যা তাঁর নবুয়তের জন্য যথেষ্ট প্রমাণ বহন করে।

 

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads