• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

রাসুল প্রেম ঈমানের অঙ্গ 

  • প্রকাশিত ২৯ নভেম্বর ২০১৯

মায়িশা আতিয়া

 

রাসুল পাক (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা ঈমানের অন্যতম অঙ্গ। কিন্তু অজ্ঞতার কারণে অনেকেই এ বিষয়ে বেখেয়াল থাকেন অথবা ভিন্ন আকিদা পোষণ করেন। যা মোটেও কাম্য নয়। যাকে সৃষ্টি না করলে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সমগ্র সৃষ্টি জগতের কিছুই সৃষ্টি করতেন না। তার প্রতি ভালোবাসার কারণের সৃষ্টিকর্তা এ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। তাই আল্লাহর বান্দা হিসেবে এবং রাসুল পাক (সা.)-এর উম্মত হিসেবে প্রত্যেক মুমিন-মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য রাসুল পাক (সা.)-কে সবকিছুর ওপর ভালোবাসা প্রদর্শন করা।

হুব্বে রাসুল মানে রাসুল প্রেম—রাসুলের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। আনাস বিন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘তিনটি জিনিস যার মধ্যে পাওয়া যাবে, সে ঈমানের স্বাদ গ্রহণ করবে। ১. আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুল তার কাছে দুনিয়ার সবকিছু হতে প্রিয় হওয়া, ২. কোনো মানুষকে একমাত্র আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ও ৩. ঈমান আনার পর কুফরিতে ফিরে যাওয়াতে এমন অপছন্দ করবে, যেমন আগুনে নিক্ষেপ করাকে অপছন্দ করে।’

হজরত মুহাম্মদ (সা.) হলেন সর্বশেষ, সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বোত্তম নবী ও রাসুল। তার ওপর ঈমান রাখা ও তাকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসা মুমিনের একান্ত কর্তব্য। পবিত্র কোরআন ও হাদিসের একাধিক বর্ণনায় মুমিনদের রাসুলের প্রতি অগাধ প্রেম-ভালোবাসা বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে। যে হূদয়ে নবীজির ওপর সম্মানবোধ নেই, মায়া ও অনুভূতির দৈন্যতা রয়েছে, উহাতে ঈমানের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। মনে রাখা চাই, শুধু সম্মানের অনুভূতিই যথেষ্ট নয়, বরং মুমিনেরা তাদের স্বীয় জীবনের সঞ্চিত ধন-সম্পদ, পিতামাতা, সন্তান-সন্ততি এবং সবকিছুর ওপর আল্লাহর রাসুলকে অগ্রাধিকার দেবে। তা নবী (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসারই দাবি। এক্ষেত্রে কোরআনের বক্তব্য সুস্পষ্ট : ‘নিশ্চয়ই মুমিনদের কাছে নবী তাদের স্বীয় জীবনের চাইতেও মর্যাদার ও শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার’। (সুরা আল আহযাব : ৬)-এর সারকথা হলো, প্রত্যেক মুসলমানের পক্ষে মহানবী (সা.)-কে ভালোবাসা ও তার নির্দেশ পালন করা স্বীয় পিতামাতার নির্দেশের চাইতেও অধিক করণীয়। যদি পিতামাতার নির্দেশ মহানবী (সা.)-এর নির্দেশের বিপরীত হয়, তা পালন করা মোটেও জায়েজ নয়। এমনকি রাসুল (সা.)-এর নির্দেশকে নিজের সব আশা-আকাঙ্ক্ষার চাইতে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

মহানবী (সা.) বলেন, ‘এমন কোনো মুমিন নেই যার পক্ষে আমি ইহকাল ও পরকালে সব মানবকুলের চাইতে হিতাকাঙ্ক্ষী ও আপনজন নই’। (বুখারি) এক্ষেত্রে নবী (সা.)-এর বাণীও স্মরণযোগ্য : ‘তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না একমাত্র আমিই তার কাছে তার জীবন, সন্তান-সন্ততি, পিতামাতা এবং দুনিয়ার সবকিছুর চেয়ে অধিক প্রিয় না হই।’ (বুখারি ও মুসলিম)

রাসুল (সা.)-কে যে যতটুকু ভালোবাসে তার মধ্য ততটুকু ঈমান রয়েছে। ঈমান অধ্যায়ন করার বিষয় নয়, এটি অন্তরে ধারণ করার বিষয়। যারা আল্লাহ ও তার হাবিব হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে মন, প্রাণ ও হূদয় দিয়ে ভালোবাসতে পেরেছেন তারাই হলেন ঈমানদার বা মুমিন।

আল্লাহতায়ালা তার রাসুল (সা.)-কে বলেছেন, তিনি যেন তার উন্মতকে একথা স্মরণ করিয়ে দেন, যারা আল্লাহকে ভালোবাসার দাবি করে তাদের প্রতি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে ভালোবাসাও অবশ্য কর্তব্য হয়েছে। এরশাদ হয়েছে— ‘হে হাবিব, আপনি বলে দিন : ওহে মানবকুল! যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবেসে থাক তবে আমার অনুগত হও, আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন’। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৩১)। মহানবীকে ভালোবাসার এই অবশ্য কর্তব্য বিষয়টির মানে হলো তাকে মান্য করা, তার স্মরণ (জিকির) করা, তার আনুগত্য করা এবং তাকে নিয়ে গর্ব করা, যেমনিভাবে আল্লাহতায়ালা তাকে নিয়ে গর্ব করেছেন তারই পবিত্র কিতাবে—‘নিশ্চয় আপনার চরিত্র মহামর্যাদাময়’ (সুরা ক্বলম, আয়াত : ৪)।

মুমিন মুসলমানদের ঈমানের পূর্ণতা রাসুল প্রেমের ওপর নির্ভরশীল। বুখারি ও মুসলিম শরিফে উদ্ধৃত একটি সহিহ হাদিসে রাসুলে খোদা (সা.) এরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ঈমানদার মুসলমান হতে পারবে না যতক্ষণ না আমি তোমাদের পুত্র, পিতা ও সব মানব জাতির চেয়ে তোমাদের কাছে প্রিয়ভাজন হই’। বুখারি শরিফে উদ্ধৃত অপর এক হাদিসে তিনি বলেন, ‘তোমাদের কেউই ঈমানদার হবে না যতক্ষণ না আমি তোমাদের কাছে তোমাদের আপন সত্তার চেয়েও প্রিয় পাত্র হই।’

 

রাসুল পাক (সা.)-এর প্রতি দরুদ পাঠ করতে আল্লাহর নির্দেশ

ঈমানের পূর্ণতা রাসুল প্রেমের ওপর নির্ভরশীল। কেননা আল্লাহপাক ও ফেরেশতাকুল নিরন্তর তার সম্মান ও মর্যাদা সমুন্নত করছেন, যেমনিভাবে কালামে পাকে ঘোষিত হয়েছে—‘নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাবৃন্দ মহানবী (সা.)-এর প্রতি সালাম তথা দরুদ প্রেরণ করে’। (সুরা আহজাব, আয়াত : ৫৬)। অতঃপর খোদায়ি আদেশ জারি হয়েছে একই আয়াতে করিমায়—‘ওহে ঈমানদারগণ! তোমরাও পূর্ণ সম্মানসহ তার প্রতি দরুদ প্রেরণ কর।’ (সুরা আহজাব, আয়াত : ৫৬)। এ আয়াতে প্রতিভাত হয় যে মুমিন মুসলমান হওয়ার বৈশিষ্ট্য মহানবী (সা.)-এর প্রতি দরুদ-সালাম প্রেরণের ওপর নির্ভরশীল এবং এর দ্বারাই প্রকাশমান। হে আল্লাহ! বিশ্বনবী (সা.), তার আহল তথা পরিবারের সদস্য ও আসহাবে কেরামবৃন্দের (সম্মানিত সঙ্গী) প্রতি শান্তি ও আশীর্বাদ বর্ষণ করুন।

 

রাসুল পাক (সা.)-এর শুভাগমনে খুশি উদযাপন করতে আল্লাহর নির্দেশ

এ বিশ্ব জগতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শুভাগমন উপলক্ষে আমাদের খুশি উদযাপন করতে আদেশ করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে, ‘হে রাসুল, বলুন : আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা (রহমত)-প্রাপ্তিতে মানব জাতির উচিত খুশি উদযাপন করা’ (সুরা ইউনুস, আয়াত : ৫৮)। এই আদেশ জারি করা হয়েছে এ কারণে যে খুশি উদযাপন দ্বারা আল্লাহর করুণার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা যায়। আর আল্লাহতায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ করুণা মহানবী (সা.) ছাড়া কী হতে পারে? যেমন এরশাদ হয়েছে—‘এবং আমি আপনাকে প্রেরণ করিনি কিন্তু বিশ্ব জগতের জন্য রহমত করে (পাঠিয়েছি)।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ১০৭)

যেহেতু মহানবী (সা.)-কে সমগ্র মানব জাতির জন্য রহমত করে পাঠানো হয়েছে সেহেতু শুধু মুসলমান সম্প্রদায়ই নয় বরং সব মানুষের প্রতি তার সত্তা মোবারকের ওপর খুশি উদযাপন করা অবশ্য কর্তব্য করা হয়েছে।

 

রাসুল পাক (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে হাদিস শরিফের নির্দেশনা

কোনো এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)! শেষ বিচার দিবস কখন হবে’? তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি এর জন্য কী প্রস্তুতি গ্রহণ করেছ’? ওই ব্যক্তি জবাব দিলেন, ‘কিছুই না; তবে আমি আল্লাহ ও তার রাসুলকে ভালোবাসি’। অতঃপর মহানবী (সা.) এরশাদ করেন—‘তুমি যাদের ভালোবাস, তাদের সঙ্গে থাকবে।’ এই হাদিসের রেওয়ায়েতকারি হজরত আনাস (রা.) বলেন, ‘রাসুলে খোদা (সা.)-এর ওই কথা শুনে আমরা যত খুশি হয়েছিলাম তার চেয়ে বেশি খুশি আগে কখনো হইনি। অতএব, আমি হুজুর পূর নূর (সা.), হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত ওমর (রা.)-কে ভালোবাসি এবং আশা করি যে এর ফলে আমি তাদের সঙ্গে থাকব, যদিও আমার আমল তাদের মতো নয়।’

একবার কেউ একজন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে আরজ করলেন, ‘হে আল্লাহর নবী! আমি আপনাকে আমার পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। আমি আপনাকে স্মরণ করি এবং আপনার কাছে এসে আপনাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করতে পারি না। আমি জানি আমি পরলোকবাসী হব এবং আপনিও বেসালপ্রাপ্ত হবেন; এও জানি আপনি তখন বেহেশতে (নবীকুল সরদার হিসেবে) নবীদের সঙ্গে উচ্চ মকামে অধিষ্ঠিত হবেন। তখন তো জান্নাতে আপনার দেখা পাব না।’ এমতাবস্থায় আল্লাহতায়ালা আয়াত নাজিল করলেন, ‘এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর হুকুম মান্য করে, তবে সে তাদের সঙ্গ লাভ করবে যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন—অর্থাৎ নবীগণ, সত্যনিষ্ঠ বুজুর্গানে দ্বীন, শাহাদতপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও সৎ-কর্মপরায়ণ মানবকুল। এরা কতই উত্তম সঙ্গী!’ (সুরা নিসা, ৬৯ : আয়াত)

মহানবী (সা.) ওই ব্যক্তিকে ডেকে উপরোক্ত আয়াতে করিমা তেলাওয়াত করে শুনালেন। এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন তাবারানী এবং মারদাওয়াইহ হজরত আয়েশা (রা.) ও হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে। এ ছাড়া ইমাম কাজী আয়াজ (রহ.) তার প্রণীত ‘শেফা শরিফ’ গ্রন্থে ও ইবনে কাসির তার তাফসির পুস্তকে একটি বর্ণনা করেছেন। আল বাগাভিও এটি বর্ণনা করেছেন তার তাফসিরে। হজরত ওমর (রা.) বর্ণিত অপর এক হাদিসেও বিষয়টির ওপর আলোকপাত করা হয়েছে : এক, ব্যক্তিকে মদ্যপানের কারণে মহানবী (সা.) প্রতিনিয়ত শাস্তি দিতেন; একবার তাকে ধরে আনা হলে তাকে আবারো প্রহারের শাস্তি দেওয়া হয়। এমতাবস্থায় উপস্থিত কেউ একজন ‘আল্লাহর লানত পড়ুক তার ওপর! তাকে কত ঘন ঘনই না ধরে আনা হয়’—একথাটি বলে উঠলে, রাসুলে পাক (সা.) তাকে বারণ করে বলেন, ‘ওকে লানত দেবে না; আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, ও আল্লাহ এবং তার রাসুলকে ভালোবাসে’ (আল বুখারি)।

মহানবী সা. এরশাদ করেন, ‘আমাকে ভালোবাসেন আমার এমন উন্মতদের মধ্যে কিছু মানুষ আছেন যারা আমার পরে আসবেন এবং যারা নিজেদের পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদের বিনিময়ে আমাকে দেখার জন্যে উদগ্রীব হবেন’ (সহিহ মুসলিম, ‘জান্নাত ও এর আশীর্বাদ এবং জান্নাতি মানব সম্প্রদায়’ শীর্ষক অধ্যায়)।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads