• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

ইসলামে শিক্ষকের মর্যাদা

  • প্রকাশিত ২৯ নভেম্বর ২০১৯

রোকাইয়া শশী

 

 

শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর, জাতির প্রধান চালিকাশক্তি। একজন শিক্ষার্থীর প্রকৃত মানুষরূপে গড়ে ওঠার পেছনে বাবা-মার চেয়ে শিক্ষকের অবদান কোনো অংশে কম নয়। যার থেকে জ্ঞান অর্জন করা হয়, তিনিই আমাদের শিক্ষক। শিক্ষকের মর্যাদায় ইসলামের বক্তব্য সুস্পষ্ট। একবার হজরত জায়েদ ইবনে সাবিত (রা.) তার সওয়ারিতে ওঠার জন্য রেকাবে পা রাখলেন। তখন ইবনে আব্বাস (রা.) রেকাবটি শক্ত করে ধরেন। হজরত জায়েদ বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুলের (সা.) চাচাতো ভাই, আপনি (রেকাব থেকে) হাত সরান।’ উত্তরে ইবনে আব্বাস (রা.) বললেন, ‘না, আলেম ও বড়দের সঙ্গে এমন সম্মানসূচক আচরণই করতে হয়।’

মহান রাব্বুল আলামিনও শিক্ষকদের আলাদা মর্যাদা ও সম্মান দান করেছেন। ফলে মুসলিম সমাজে শিক্ষকমাত্রই বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী। এক কথায় বলা যায়, শিক্ষক মানুষ চাষ করেন। যে চাষাবাদের মধ্য দিয়ে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে নীতি-নৈতিকতা ও জীবনাদর্শের বলয়ে একজন শিক্ষার্থী তার ব্যক্তিগত ও কর্মময় জীবনকে মুখরিত করে। পাশাপাশি পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র তার দ্বারা উপকৃত হয়। মহানবী (সা.) যে ঐশী জ্ঞান অর্জন করেছেন, সে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি মানবজাতিকে সৃষ্টিকর্তা, মানুষ ও প্রকৃতির পারস্পরিক সম্পর্কের নীতিমালা শিক্ষা দান করেছেন। তিনি নিজেই এ পরিচয় তুলে ধরে ঘোষণা করেছেন- ‘শিক্ষক হিসেবে আমি প্রেরিত হয়েছি।’ (ইবনে মাজাহ)।

শিক্ষাকে যাবতীয় উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হলে শিক্ষকের ভূমিকার গুরুত্ব অপরিসীম। বলতে গেলে এর বিকল্প নেই। পবিত্র কোরআনে নাজিলকৃত প্রথম আয়াতে জ্ঞানার্জন ও শিক্ষা সংক্রান্ত কথা বলা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘পড়, তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন একবিন্দু জমাট রক্ত থেকে। পড়, আর তোমার প্রতিপালক পরম সম্মানিত। যিনি কলমের দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না।’ (সুরা আলাক : ১-৫)।

আল কোরআনের শিক্ষার আলোকে জ্ঞানার্জনের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে মহানবী মুহাম্মদ (সা.) বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন— ‘প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর ওপর বিদ্যার্জন করা ফরজ।’ (ইবনে মাজাহ)

একজন প্রাজ্ঞ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সত্যিকারভাবে শিক্ষিত শিক্ষক সমাজ বদলে একটি বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন। আদর্শ শিক্ষকই শুধু আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করতে পারেন। এ জন্যই শিক্ষকতাকে অপরাপর পেশার মানদণ্ডে পরিমাপ করা যায় না বলে অনাদিকাল থেকে এটি একটি সুমহান পেশা হিসেবে সমাজ-সংসারে পরিগণিত। কারণ জ্ঞানই মানুষের যথার্থ শক্তি ও মুক্তির পথনির্দেশ দিতে পারে। এ মর্মে নবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘দুই ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারো পদ-গৌরব লোভনীয় নয়। তা হলো— ১. ধনাঢ্য ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ ধন-সম্পদ দান করেছেন এবং তা সৎপথে ব্যয় করার ক্ষমতা দিয়েছেন; ২. ওই ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ বিদ্যা দান করেছেন এবং সে অনুসারে সে কাজ করে ও অপরকে শিক্ষা দেয় (বুখারি)।

শিক্ষা অনুযায়ী মানব চরিত্র ও কর্মের সমন্বয় সাধনই হচ্ছে রাসুলের (সা.) তাগিদ। নিজে শিক্ষা অর্জন করার পরক্ষণেই অপরকে সেই শিক্ষায় শিক্ষিত ও চরিত্র গঠন করার দায়িত্বও শিক্ষকের। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর পরে, রাসুলের পরে ওই ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা মহানুভব, যে বিদ্যার্জন করে ও পরে তা প্রচার করে।’ (বুখারি)। রাসুল (সা.) শিক্ষা, শিক্ষা উপকরণ, শিক্ষক ও শিক্ষার ব্যাপকীকরণে সদা সচেষ্ট ছিলেন। তাই তো প্রিয় নবী (সা.) বদরের যুদ্ধবন্দিদের মুক্তির জন্য মদিনার শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার চুক্তি করেছিলেন। যার মাধ্যমে তিনি বন্দিদের মুক্তির ব্যবস্থা করেছিলেন, যা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল।

সম্মানজনক জীবনধারণের জন্য শিক্ষকদের যথেষ্ট অর্থ প্রয়োজন। অথচ এই মহান পেশায় যারা নিয়োজিত, তাদের নেই কোনো অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা। সামাজিক মর্যাদা ও সম্মানজনক জীবনধারণ উপযোগী বেতন-ভাতা না থাকায় মেধাবীরা শিক্ষকতায় আকৃষ্ট হচ্ছেন না। অথচ জ্ঞান অন্বেষণের গুরুত্ব ও শিক্ষকের মর্যাদা প্রসঙ্গে আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন, ‘যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি সমান হতে পারে?’ (জুমার : ৯)। জ্ঞানার্জনের জন্য প্রয়োজনে সুদূর চীন দেশে পর্যন্ত যেতে বলা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত শিক্ষা অর্জন করো।’

শিক্ষকরা সমাজের বিবেক ও স্পন্দন। সামাজিক কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামি দূর করার ব্যাপারে শিক্ষকদের অবিস্মরণীয় অবদান আজও এ ভূখণ্ডের মানুষ ভক্তিভরে স্মরণ করে। শিক্ষকরা হচ্ছেন দেশ গড়ার প্রধান নিয়ামক শক্তি। তাই ইসলামের আলোকে শিক্ষকদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকদের আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আধুনিক শিক্ষাদানে তৈরি করে তুলতে হবে।

খেলাফতের যুগেই ইসলাম প্রত্যেকের জন্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে। শিক্ষাকে সহজলভ্য করতে তখন শিক্ষকের জন্য সম্মানজনক পারিশ্রমিকও নির্ধারণ করা হয়েছিল। যদিও দিনি শিক্ষাঙ্গনের শিক্ষকরা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জ্ঞান বিতরণ করতেন। আর তারা যেহেতু নিজেদের জীবিকার পেছনে ব্যতিব্যস্ত সময় পার না করে শান্ত মস্তিস্কে জ্ঞান বিতরণের পবিত্র কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন, তাই তৎকালীন খেলাফত ব্যবস্থা বা সরকার তাদের সম্মানে অভিষিক্ত করেছিল। তাদের জ্ঞান বিতরণের এ মহৎ কাজকে সম্মান জানিয়ে পরিবার-পরিজনের যাবতীয় আর্থিক খরচ বহন করেছিল, যেন জীবনের তাগিদে শিক্ষকদের ভিন্ন কোনো পথে পা বাড়াতে না হয়।

উমর (রা.) ও উসমান (রা.) তাদের শাসনামলে শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তারা শিক্ষক ও ধর্মপ্রচারকদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করেছিলেন। হজরত উমর (রা.), ওসমানের (রা.) যুগে মুয়াজ্জিন, ইমাম ও শিক্ষকদের সরকারি ভাতা দেওয়া হতো।

বস্তুত যুগ যুগ ধরে ইসলাম ও ইসলামের মনীষীরা শিক্ষক ও গুরুজনের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের শিক্ষা দিয়ে আসছেন। নিঃস্বার্থভাবে জ্ঞান বিতরণের দীক্ষাও দিচ্ছেন নিরন্তরভাবে।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads