• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

ধর্ম

সামাজিক অবক্ষয় ও নৈতিক শিক্ষা

  • মায়িশা আতিয়া
  • প্রকাশিত ২০ ডিসেম্বর ২০১৯

শিক্ষা ও নৈতিকতা একটির সঙ্গে অন্যটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শিক্ষা একজন ব্যক্তিকে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসে। আর নৈতিকতা মানুষের জীবনকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করে তোলে। এ দুটির সমন্বয় হলে একজন মানুষ সৎ, চরিত্রবান, আল্লাহভীরু, দেশপ্রেমিক ও দায়িত্বশীল হয়ে ওঠে। যার ফলে বর্তমান সমাজের জন্য নৈতিক শিক্ষা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

 

শিক্ষা

মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্যতম একটি হল শিক্ষা। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে নিজের জীবনে সফলভাবে প্রয়োগ করাকে শিক্ষা বলে। এ শিক্ষা মানুষকে প্রকৃত মানুষ হতে সাহয্যে করে এবং মানব হূদয়কে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে মুক্ত করে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করে। আর যে শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণরূপে তুলে ধরা হয়েছে তাকে ইসলামী শিক্ষা বলে।

আজ আমাদের সমাজে নৈতিক শিক্ষার সঠিক প্রয়োগ না থাকায় অপরাধ প্রবণতা বেড়েই চলছে। অনৈতিকতার প্রভাবে নৈতিকতা প্রায় বিলুপ্ত। পিতা-মাতা পাচ্ছেন না তাদের সেবা, সন্তান পাচ্ছে না তাদের অধিকার, শিক্ষক পাচ্ছেন না তার সম্মান, ছাত্র পাচ্ছে না সঠিক শিক্ষা। এভাবে খুঁজতে গেলে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অসংখ্য অন্যায় চোখের সামনে ফুটে উঠবে। যার একটাই কারণ, নৈতিক শিক্ষার অভাব এবং ইসলামকে নিছক ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করা।

বর্তমানে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় যে ধরনের ইসলামী দর্শন চর্চা চলে তা দিয়ে কিছুটা নৈতিকতা সৃষ্টি হলেও পূর্ণাঙ্গ নয়। স্কুল পর্যায়ে ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা নামের একটি বিষয় নির্ধারিত থাকলে ও কলেজ পর্যায়ে তা অতিরিক্ত বিষয়। তাও আবার সে অতিরিক্ত বিষয়টি শুধু মানবিক বিভাগের জন্য নির্ধারিত। বিজ্ঞান ও ব্যবসা বিভাগে কলেজ পর্যায়ে ইসলাম চর্চা হয় না বললেই চলে। আধুনিক বিশ্বে ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষাকে মানবজাতির মুক্তির বিধানরূপে পেশ করার যোগ্যতাসম্পন্ন লোক তৈরি করতে হলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল দিকের শিক্ষা এবং সাহিত্যে ইসলাম, নৈতিকতা মূল্যবোধের প্রাধান্য দিতে হবে।

একজন মুসলমানের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে জীবনের সর্বস্তরে আল্লাহর বিধিবিধান মেনে নেওয়া ও তার সন্তুষ্টি অর্জন করাই হলো ইসলামী শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। মূলত ইসলামী শিক্ষার মূল ভিত্তি হলো— তাওহিদ, রিসালাত, আখিরাত। যার মাঝে পরকালের ভয় থাকে তার দ্বারা খারাপ কাজ হতে পারে না। তাই এমনভাবে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা উচিত, যা গ্রহণ করলে একজন ব্যক্তি দীন ও দুনিয়ার প্রয়োজন মেটাতে পারে এবং সেটাই হবে ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা।

 

নৈতিকতা

নৈতিকতা বলতে আমরা বুঝি নীতির অনুশীলন, নীতির চর্চা। নৈতিকতা হলো এমন এক বিধান যার আলোকে মানুষ তার বিবেকবোধ ও ন্যায়বোধ ধারণ ও প্রয়োগ করতে পারে। সততা, সদাচার সৌজন্যমূলক আচরণ সুন্দর স্বভাব মিষ্টি কথা ও উন্নত চরিত্র এ সবকিছুর সমন্বয় হলো নৈতিকতা। একজন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চাল-চলন, ওঠা-বসা, খাওয়া-দাওয়া, আচার-ব্যবহার, লেনদেন সবকিছুই যখন প্রশংসনীয় ও গ্রহণযোগ্য হয় তখন তাকে নৈতিক গুণাবলি সম্পন্ন ব্যক্তি বলে। তাই নৈতিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিকে রাসুলুল্লাহ (সা.) সর্বোত্তম ব্যক্তি বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি উত্তম যার চরিত্র উত্তম।’ (বুখারি)

নৈতিকতা হলো ব্যক্তির মৌলিক মানবীয় গুণ এবং জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, যা অর্জন করলে তার জীবন সুন্দর ও উন্নত হয়। আর এর মাধ্যমে সে অর্জন করে সম্মান ও মর্যাদা। ইসলামী শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো- মানুষকে নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়া। নীতিহীন মানুষ চতুষ্পদ জন্তুর চেয়েও নিকৃষ্ট।

 

নৈতিকতার সংকট এবং অবক্ষয়

অবক্ষয় শব্দের অর্থ ‘ক্ষয়প্রাপ্তি’। নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধ তথা সততা, কর্তব্য, নিষ্ঠা, ধর্ম, উদারতা, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, নান্দনিক সৃজনশীলতা, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ, পারস্পরিক মমত্ববোধ ইত্যাদি নৈতিক গুণ লোপ পাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়াকে বলে সামাজিক অবক্ষয়। নৈতিকতা ও আদর্শিক শিক্ষার অভাবই সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ।

নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে মানুষের হূদয়বৃত্তিতে ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন। পরিণতিতে সমাজ ও পরিবারে বেজে উঠছে ভাঙনের সুর। নষ্ট হচ্ছে পবিত্র সম্পর্কগুলো। চাওয়া পাওয়ার ব্যবধান হয়ে যাচ্ছে অনেক বেশি। ফলে বেড়ে চলছে আত্মহত্যা, হত্যাসহ অন্যান্য অপরাধ প্রবণতা। মা-বাবা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সম্পর্কের এমন নির্ভেজাল জায়গাগুলোতে ফাটল ধরেছে। ঢুকে পড়েছে অবিশ্বাস। আর এর ফলে স্বামী-স্ত্রীর প্রেমময় সম্পর্কে সৃষ্টি হচ্ছে আস্থার সংকট।

নৈতিকতাহীন শিক্ষায় তারা দূরে সরে যাচ্ছে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়া থেকে। আর হয়ে যাচ্ছে বখাটে, মাদকাসক্ত, ধর্ষক, ইভটিজার, সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ, সুদখোর ও ঘুষখোর। এতে সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ন্যায়নীতি ও ন্যায়বিচার। স্যাটেলাইটের সুবাদে উন্মুক্ত অপসংস্কৃতির দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে চিরায়ত দেশীয় সংস্কৃতি। মোবাইলে ইন্টারনেট চালানো সহজ হওয়ায় যুবসমাজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এমনকি শিশুরাও ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছে। প্রযুক্তির অপব্যবহার কল্যাণের নামে অকল্যাণে বয়ে আনছে। ফলে নৈতিক শিক্ষার অভাবে জাতি আজ এক সর্বগ্রাসী অবক্ষয়ের কবলে পড়ছে।

দেশে ভয়াবহ ব্যাধির মতো দানা বাঁধছে নৈতিক ও সামজিক অবক্ষয়। সমাজ বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এখন থেকে এর লাগাম টেনে ধরতে না পারলে আগামী বছরগুলোতে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ভয়াবহ রূপ নেবে সামাজিক অবক্ষয়। প্রতিদিন একটু একটু করে অবক্ষয়ের অতল অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে দেশ। ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা সর্বক্ষেত্রে অন্তর্ভূক্ত করা সময়ের দাবি হয়ে উঠছে। শিক্ষার সর্বস্তরে ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটানো উচিত। তাহলে হয়তো আমরা সভ্য জাতি হিসেবে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব। আসুন জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মতপার্থক্য ভুলে সুন্দর একটি জাতি গড়ি। যে জাতি উপহার দেবে সুন্দর একটি সমাজ ও দেশ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads