• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

আত্মীয়তার বন্ধন যেন অটুট থাকে

  • মায়িশা আতিয়া
  • প্রকাশিত ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯

সমাজের কিছু মানুষ শুধু নিজের পরিবার-পরিজন নিয়েই ব্যস্ত থাকে এবং আত্মীয়-স্বজনের ব্যাপারে থাকে উদাসীন। আবার এমন বহু লোক আছে, যারা নিজের পরিবার-পরিজনের কথা ভুলে বন্ধুবান্ধবের পেছনেই টাকা পয়সা ব্যয় করে।

আয়াতে এমন লোকদের হুশিয়ার করে দেওয়া হয়েছে। মা-বাবার পরে প্রথমেই আত্মীয়-স্বজনের অধিকার বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে। এরপর অন্যদের কথাও ভাবতে হবে। আবার এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা থেকেও দূরে থাকতে হবে, যাতে বিষয়টি অপচয় পর্যন্ত না গড়ায়।

রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, সে যেন তার আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখে (বুখারি, হাদিস : ৬১৩৮)।

মানুষ একে অপরের সঙ্গে বিভিন্ন সম্পর্কে জড়িত। মানুষের মাঝের এই সম্পর্কের নাম হচ্ছে ‘আত্মীয়তা’। পরস্পরের সঙ্গে জড়িত মানুষ হচ্ছে একে অপরের ‘আত্মীয়’। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে আত্মীয়তার সম্পর্ক সর্বতোভাবে জড়িত। আত্মীয় ছাড়া এ জীবন অচল। কারণ আত্মীয়দের সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও ভালোবাসা নিয়েই মানুষ এ পার্থিব জীবনে বেঁচে থাকে। আর আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় না থাকলে জীবন হয়ে যায় নীরস, আনন্দহীন, একাকী ও বিচ্ছিন্ন।

‘আত্মীয়’ শব্দের অর্থ হচ্ছে স্বজন, জ্ঞাতি, কুটুম্ব। এর আরবি প্রতিশব্দ হচ্ছে আর-রাহিমু বা যুর রাহিমে। অর্থাৎ এমন পথ-পন্থা যাতে দুই ব্যক্তি, দল বা দেশ পরস্পরের সঙ্গে সদাচরণ করে বা পরস্পরে আলোচনা করে। আবার কেউ কেউ বলেন, আত্মীয় হচ্ছে তারা যাদের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ক আছে, তারা সম্পদের উত্তরাধিকারী হোক বা না হোক, মাহরাম হোক বা না হোক। অর্থাৎ আত্মার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিকে আত্মীয় বলা হয়।

 

আত্মীয় প্রধানত দুই প্রকার। যথা- ১. রক্ত সম্পর্কিত বা বংশীয়। যেমন বাবা-মা, দাদা-দাদি, ভাই-বোন, চাচা-চাচি, মামা-খালা প্রমুখ, ২. বিয়ে সম্পর্কিত যেমন শ্বশুর-শাশুড়ি, শ্যালক-শ্যালিকা ইত্যাদি। আবার পরিত্যক্ত সম্পদের অধিকারী হওয়ার দিক দিয়ে আত্মীয় দুই প্রকার যথা- ১. উত্তরাধিকারী; যেমন- বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা প্রভৃতি, ২. উত্তরাধিকারী নয়; যেমন- চাচা-চাচি, মামা-খালা ইত্যাদি।

আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার অর্থ ও তাৎপর্য হচ্ছে স্বজন ও আপনজনের সার্বিক খোঁজখবর রাখা ও তাদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করা। ইবনুল আছীর বলেন, এটা হচ্ছে বংশীয় ও বৈবাহিক সম্পর্কিত আত্মীয়দের প্রতি অনুগ্রহ-অনুকম্পা প্রদর্শন করা, তাদের প্রতি সদয় ও সহানুভূতিশীল হওয়া, তাদের অবস্থার প্রতি খেয়াল রাখা, যদিও তারা দূরে চলে যায় এবং খারাপ আচরণ করে।

আত্মীয়-স্বজনের হক সম্পর্কে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বিশদ বর্ণনা রয়েছে। আত্মীয়-স্বজনের হক সম্পর্কে মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘তোমরা আত্মীয়-স্বজনের হক আদায় করে দাও এবং মিসকিন ও মুসাফিরের হকও আদায় করো। আর কোনোভাবেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয়ই অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার প্রতিপালকের খুবই অকৃতজ্ঞ’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত ২৬-২৭)।

মহান আল্লাহপাক পবিত্র কোরআন মাজিদে বলেছেন, ‘আর আল্লাহর বন্দেগি কর এবং তার সঙ্গে কাউকে শরিক করো না। এ ছাড়া মা-বাবার সঙ্গেও উত্তম আচরণ কর, আর উত্তম আচরণ কর নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে’ (সুরা আন-নিসা, আয়াত ৩৬)।

পবিত্র কোরআন মাজিদে আল্লাহপাক এ বিষয়ে আরো বলেছেন যে, ‘হে মানবজাতি, তোমরা তোমাদের প্রভুকে ভয় কর। যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এক আত্মা থেকে, আর তা থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে এবং তাদের থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে চাও। আর ভয় কর রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে, তাদের হক আদায় করে দাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের পর্যবেক্ষক (সকল খবর জানেন)’ (সুরা নিসা, আয়াত ০১)।

 

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করিম (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘যে লোক রিজিক প্রশস্ত ও আয়ু বৃদ্ধি করতে চায়, সে যেন তার আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৫৫৯)।

আমরা অনেকেই সাধারণ বিষয় নিয়েও ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে দীর্ঘদিন পর্যন্ত কথাবার্তা বন্ধ রাখি। এমনকি অনেকে এভাবে রাগ করে সারা জীবন দেখা-সাক্ষাৎ কথাবার্তা বন্ধ রাখে। অথচ এ ব্যাপারে (সা.) স্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করেছেন। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কোনো মুসলমানের জন্য তিন দিনের বেশি তার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বন্ধ রাখা জায়েজ নেই’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস ৬২৯৫)।

আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, রেহম (আত্মীয়তার সম্বন্ধ) আল্লাহর আরশের সঙ্গে ঝুলন্ত রয়েছে। সে বলে, যে ব্যক্তি আমার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখবে আল্লাহ তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন। আর যে আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে আল্লাহ তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৬২৮৮)।

পবিত্র কোরআনের অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, আর স্মরণ কর, যখন আমি বনি ইসরাঈলের অঙ্গীকার গ্রহণ করলাম যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত করবে না এবং সদাচার করবে পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম ও মিসকিনদের সঙ্গে। আর মানুষকে উত্তম কথা বল, সালাত কায়েম কর এবং জাকাত প্রদান কর। অতঃপর তোমাদের মধ্য থেকে স্বল্প সংখ্যক ছাড়া তোমরা সবাই উপেক্ষা করে মুখ ফিরিয়ে নিলে (সুরা বাকারা, আয়াত: ৮৩)।

আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা অতি বড় গোনাহের কাজ। এর ফলে পারস্পরিক বন্ধন নষ্ট হয়, বংশীয় সম্পর্ক ক্ষুণ্ন হয়, শত্রুতা ও বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায়, বিচ্ছিন্নতা ও একে অপরকে পরিত্যাগ করা অবধারিত হয়। এটা পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, হূদ্যতা ও ভালোবাসা দূর করে, অভিশাপ ও শাস্তি ত্বরান্বিত করে, জান্নাতে প্রবেশের পথকে বাধাগ্রস্ত করে, হীনতা ও লাঞ্ছনা আবশ্যক করে। কেননা মানুষ যার কাছ থেকে ভালো ব্যবহার, কল্যাণ ও সুসম্পর্ক কামনা করে, তার পক্ষ থেকে কোনো বিপদ আসলে সেটা অধিক পীড়াদায়ক ও অসহনীয় হয়। এতদ্ব্যতীত পবিত্র কোরআন ও সহিহ হাদিসের বর্ণনামতে জ্ঞাতি সম্পর্ক ছিন্ন করার কবিরা গুনাহ।

আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীদের জন্য ভয়াবহ পরিণাম উল্লেখ করা হয়েছে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে। মহান আল্লাহপাক পবিত্র কোরআন শরীফে বলেছেন, ‘তোমরা শিগগির এ থেকে ফিরে যাবে এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। আর যারা এরূপ করবে তাদের ওপরই আল্লাহর অভিশম্পাত বর্ষিত হবে। আর এ ধরনের লোকদেরকেই বধির এবং অন্ধ করে দেওয়া হবে’ (সুরা মুহাম্মাদ, আয়াত : ২২-২৩)।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা এবং ওই সম্পর্ক অক্ষুণ্ন ও অটুট রাখার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা সবার জন্য আবশ্যক। যে ব্যাপারে মহান আল্লাহ ও তার রসুল (সা.) আমাদের বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন।

এ সম্পর্ক বজায় রাখলে ইহকালীন ও পরকালীন ফায়দা রয়েছে। আবার এ সম্পর্ক ছিন্ন করলে পরকালে শাস্তি রয়েছে। তাই আত্মীয়তার সম্পর্ক সংরক্ষণে আমাদের যথাসম্ভব সচেষ্ট হওয়া উচিত।

 

লেখক : আলেম ও গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads