• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)

  • প্রকাশিত ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯

আমীন শাহ হামিদী

 

এ জগতে যত মহামানব শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন, তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠতম ছিলেন মানবতার মুক্তির মহান দিশারি, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত বিশ্বশান্তির মহান দূত মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। কারণ শান্তি প্রতিষ্ঠায় অনেকেই সফল হতে পারেননি। আবার কেউ কেউ আংশিক সফলতা লাভ করলেও পরিপূর্ণ সফলতায় পৌঁছাতে পারেননি। মুহাম্মদই (সা.) ছিলেন এমন ব্যক্তিত্ব, যিনি শান্তি প্রতিষ্ঠায় পরিপূর্ণ সফল হয়েছিলেন। এক্ষেত্রে বলা যায়, সফল তো তিনি হবেনই, যেহেতু স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহই তো তাকে এ জন্য পাঠিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মহান রাব্বুল আলামিন মুহাম্মদকে (সা.) উদ্দেশ করে বলেন, আমি আপনাকে বিশ্বজগতের জন্য রহমত ছাড়া অন্য কিছু হিসেবে পাঠাইনি (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ১০৭)। অন্যত্র আল্লাহ মুহাম্মদ এবং তার অনুসারীদের বলেন, তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মাহ, যাদের বাছাই করা হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য।

তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে, অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখবে আর বিশ্বাস রাখবে আল্লাহতে (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১১০)। এই দুটি আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি, মুহাম্মদকে (সা.) প্রেরণের উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানবজাতির কল্যাণ সাধন। সেই কল্যাণের মূলকথা হচ্ছে, মানবজাতিকে সৎ পথ তথা শান্তির পথের দিশা দেওয়া এবং অসৎ পথ তথা অকল্যাণ ও অশান্তির পথে চলতে বাধা দেওয়া। বলাবাহুল্য, মানবজাতির সবচেয়ে উপকারী কাজ হচ্ছে তাদের ন্যায়ের পথ দেখানো এবং অন্যায়ের অশুভ পরিণাম থেকে রক্ষা করা। কোনো সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার মূল মন্ত্র এটাই। কোনো দেশ বা জাতির মধ্যে কখনো শান্তি আসবে না, যদি না সেই জাতির লোকগুলো অন্যায় অপরাধ পরিত্যাগ করে ন্যায়ের পথে চলে। বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) ঠিক এই কাজটিই করেছেন। তিনি মানুষকে শান্তির জন্য অর্থ উপার্জন করে সম্পদের পাহাড় গড়তে বলেননি।

বরং অর্থ আর সম্পদের লোভ পরিহার করে ন্যায়ের সমাজ গঠনের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। অঢেল সম্পদ যে মানুষকে শান্তি দিতে পারে না, সেটার প্রমাণ বর্তমান সময়। বর্তমান বিশ্বে মানুষের সম্পদের কোনো অভাব নেই। অথচ ন্যায় ও সততার অনুপস্থিতির কারণে শান্তি আজ কোথাও নেই, অশান্তির আগুনে পুড়ছে সারা বিশ্ব। মানুষের মধ্যে যদি ন্যায় আর সৎ কাজের প্রবণতা থাকে, অসৎ কাজের প্রতি ঘৃণা থাকে, অন্যের সম্পদ, জীবন ও সম্মানের প্রতি তার শ্রদ্ধা থাকে, অন্যের কষ্টকে নিজের কষ্ট মনে করে, অন্যের প্রতি অবিচার করাকে সে জঘন্য অপরাধ বিবেচনা করে এবং সর্বোপরি সব অন্যায় অপরাধের জন্য একদিন তাকে জবাবদিহি করতে হবে, এর শাস্তি ভোগ করতে হবে- এ বিশ্বাস অন্তরে পোষণ করে চলে, তাহলে অবশ্যই সমাজ থেকে সব অন্যায় অপরাধ আর জুলুম বিদায় নেবে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে শান্তি।

আমরা যদি মহানবীর (সা.) জীবনের দিকে তাকাই, তাহলে সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাই, তিনি সারা জীবন মানুষকে এই দীক্ষাই দিয়েছেন। তিনি তার অনুসারীদের বলেছেন, তোমরা ততক্ষণ ইমানদার বিবেচিত হতে পারবে না, যতক্ষণ না নিজের জন্য যা পছন্দ করো, তা অপর ভাইয়ের জন্যও পছন্দ করবে। (বুখারি) তিনি আরো বলেন, ইমানদার হওয়া ছাড়া তোমরা জান্নাতে যেতে পারবে না আর পারস্পরিক ভালোবাসা ছাড়া তোমরা ইমানদার হতে পারবে না। (মুসলিম) বিদায় হজের ভাষণে তিনি তার অনুসারীদের উদ্দেশে বলেন, আজকের এই দিন, মাস ও শহর তোমাদের কাছে যেমন সম্মানীয়, তেমনি সম্মানীয় তোমাদের একের কাছে অপরের জীবন, সম্পদ ও সম্মান (বুখারি)। তিনি আরো বলেন, পৃথিবীর অধিবাসীদের প্রতি দয়া করো, তাহলে আকাশের মালিক তোমার প্রতি দয়া করবেন।

শান্তি প্রতিষ্ঠার অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে সমাজে অবস্থানরত প্রত্যেকের অধিকার আদায় করে দেওয়া, প্রত্যেকের প্রাপ্য তাকে বুঝিয়ে দেওয়া। একই সঙ্গে প্রত্যেকে যদি নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে, তাহলে সমাজে অশান্তি থাকবে না। নিজের দায়িত্ব পালনে ও অন্যের অধিকার আদায়ে অবহেলার কারণে মানুষের মাঝে বিদ্বেষ এবং প্রতিশোধের মনোভাব তৈরি হয়। এক পর্যায়ে তা বিদ্রোহে রূপ নেয়। ফলে সমাজে অশান্তি নেমে আসে। এ জন্য মুহাম্মদ (সা.) প্রত্যেকেই যেন নিজের দায়িত্ব পালন করে এবং অন্যের অধিকার আদায় করে দেয়, সেই তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেন, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। (বুখারি)। মহানবী (সা.) বলেন, যে নিজেকে ইমানদার দাবি করে, সে যেন প্রতিবেশীর অধিকার আদায় করে দেয়। (বুখারি)। এভাবে তিনি মাতাপিতা, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, এতিম, মিসকিন, মুসাফির, সহকর্মী, সহযাত্রী, অধীন- সবার অধিকার আদায়ের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন।

পবিত্র কোরআনের সুরা নিসা পাঠ করলে আমরা দেখতে পাব, মুহাম্মদ (সা.) একজন মানুষের জীবন চলার পথে সংশ্লিষ্ট সবার অধিকার বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠার রূপরেখা সংবলিত একটি জীবনবিধান মানুষের সামনে তুলে ধরে বলেন, ইসলামি জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করো, তাহলে শান্তি পাবে। তার এ বক্তব্যই স্পষ্ট করে দেয়, তিনি মানবজাতির জন্য কী চেয়েছিলেন। তিনি ইসলাম নামক একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান উপস্থাপন করে বলেন, এটা গ্রহণ করো, এটাই শান্তির মূল মন্ত্র। তিনি শুধু বলে যাননি, বরং নিজের বাস্তব জীবনে সেই বিধান প্রয়োগের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্তও স্থাপন করে গেছেন। নবুয়ত লাভ করার পূর্বেকার তার তৎপরতা এবং চারিত্রিক নির্মলতাই ইঙ্গিত দিয়েছিল যে, তিনি অচিরেই শান্তির দূত হতে যাচ্ছেন।

আরবের একটি বিশৃঙ্খল, বর্বর, অশান্ত সমাজে জন্ম নিয়েও তিনি কখনো সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করে এমন কোনো তৎপরতা দেখাননি। কারো কোনো সামান্য পরিমাণ ক্ষতিও করেননি। প্রত্যেকের সম্পদের একনিষ্ঠ আমানতদার ছিলেন। তাই তিনি সে সমাজে ‘আল আমিন’ হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। তার বয়স যখন মাত্র ১৫ বছর, তখন মক্কায় চলছিল হারবুল ফুজ্জার বা ফুজ্জারের যুদ্ধ। রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধ দেখে তিনি খুবই মর্মাহত হয়েছিলেন। তখন যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সব ধরনের জুলুম-অত্যাচার নির্মূল করার জন্য তিনি এবং আরো কিছু সম্মানীয় ব্যক্তি ইবনে জুদয়ান তাইমীর ঘরে একত্র হয়ে গঠন করেন ‘হিলফুল ফুজুল’ নামক সংগঠন। এতে অঙ্গীকার করা হয়, মক্কায় কোনো ধরনের জুলুম ঘটতে দেওয়া হবে না। কোনো ব্যক্তি, সে মক্কার অধিবাসী হোক কিংবা বাইরের লোক হোক, কারো দ্বারা অত্যাচারিত হলে তার ন্যায় প্রতিকার করা হবে। এত কম বয়সে এমন একটি সংগঠনের সদস্য হওয়াই প্রমাণ করে, সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা তার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই বয়সে একটা ছেলের তো খেল-তামাশা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা; অথচ মুহাম্মদ (সা.) তখন নেমে পড়লেন শান্তি প্রতিষ্ঠায়। নবুয়ত লাভের পর এ সংগঠনের সদস্য হতে পারাকে লাল উটের চেয়েও তার কাছে বেশি পছন্দনীয় বলে মন্তব্য করেছেন।

মহানবীর (সা.) ২৩ বছরের নবুয়তি জীবন ছিল বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এক রক্তপাতহীন (হতাহতের সংখ্যা বিবেচনায় রক্তপাতহীন না বললে অন্যায় হবে) সফল বিপ্লব। বর্তমান অশান্ত পৃথিবীতে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তার থিওরি অনুসরণের বিকল্প নেই। তার ব্যাপারে মহান মাবুদ বলেন, (হে মুহাম্মাদ) নিশ্চয়ই তুমি সর্বোত্তম চরিত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত। (সুরা কলম, আয়াত : ৪)।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads