• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
ইসলাম ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ সমর্থন করে কি?

ফাইল ছবি

ধর্ম

প্রসঙ্গ : হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক

ইসলাম ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ সমর্থন করে কি?

  • প্রকাশিত ০৩ জানুয়ারি ২০২০

শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (আইসিএমএইচ), নবজাতক পরিচর্যা কেন্দ্র (স্ক্যানো) এবং নবজাতক আইসিইউ (এনআইসিইউ)-এর উদ্যোগে ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের’ মাধ্যমে স্বেচ্ছায় প্রসূতি মায়ের বুকের দুধ সংগ্রহ প্রক্রিয়া চলছে, যা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কথাও চলছে। ইসলামী শরিয়া মোতাবেক সঠিক মান নিরূপণে এ বিষয়ে বিশিষ্টজনদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এস এম আরিফুল কাদের

‘হিউম্যান মিল্ক’-এর মূল কনসেপ্ট ইসলামে নাজায়েজ নয়। বরং ইসলামে এটিকে উৎসাহিত করেছে। কিন্তু ‘ব্যাংক’ করায় ওলামায়ে কেরামগণ এটাতে ফেতনার আশঙ্কা থাকতে পারে বলে এটাকে হারাম ফতওয়া দিয়েছেন। ফেতনাটি হলো- যে শিশুরা এই ব্যাংক থেকে দুধ পান করবে এবং যে মায়েরা দুধ প্রদান করবেন তাদের মধ্যে দুধ সম্পর্কীয় আত্মীয়তা স্থাপিত হবে। ফলে অজ্ঞাতানুসারে যদি উভয়ের পরিবারের মধ্যে বিবাহ-শাদি হয় তাহলে তা হারাম হবে। যা কোরআন, হাদিস ও মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরিয়ত) প্রয়োগ ১৯৩৭-এর সম্পূর্ণ বিরোধী।  কোরআনে পাকে ইরশাদ হচ্ছে- ‘তোমাদের উপর হারাম করা  হয়েছে... তোমাদের সে সব মাতাকে যারা তোমাদেরকে দুধপান করিয়েছেন, তোমাদের দুধবোনদের...।’ (সুরা নিসা : ২৩)। হাদিসের ভাষায়, দুধবোনকে বিয়ে করা সম্পূর্ণ হারাম ও নিষেধ। বংশীয় সম্পর্কে সহোদর বোনের মেয়েকে বিয়ে করা যেমন হারাম, দুধবোনের মেয়েকে বিয়ে করাও তেমনি হারাম। (সহিহ বোখারি, হাদিস নং : ২৬৪৫)। এমনকি ওআইসি’র আল মাজমাউল ফিকহিল ইসলামী আদ দাউলি ১৯৮৫ এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ফিকহ বোর্ড আল মাজমাউল ফিকহিল ইসলামি জিদ্দা ২০০৬ ইং সর্বসম্মতিক্রমে ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংককে’ হারাম ফাতওয়া দিয়েছেন।

‘ব্যাংক’ করে অসহায় শিশুদের দিকে তাকিয়ে হালালের কোনো পথ বের করা যায় না?

‘মিল্ক ব্যাংক’ জায়েজ হওয়ার জন্য দুটি দিক বিবেচনা করা যেতে পারে। (ক) হানাফি মাজহাবের অন্যতম ফকিহ ইমাম কারখী (রহ.) বলেন, দুগ্ধ সম্পর্কীয় আত্মীয়তা সাব্যস্তের জন্য শর্ত হলো শিশুকে সরাসরি মায়ের স্তন থেকে দুধ পান করানো জরুরি। মায়ের স্তন থেকে আলাদভাবে দুধ পান করালে দুগ্ধ সম্পর্কীয় আত্মীয়তা সাব্যস্ত হয় না। যদিও সূত্রটি দুর্বল। আল্লামা ইবনে হাজম (রহ.)ও এই মত পোষণ করেন। (আল মুহাল্লা ১০ম খণ্ড ৭ পৃ.)। (খ) কতটুকু দুধ পান করালে দুগ্ধ সম্পর্কীয় আত্মীয়তা সম্পর্ক স্থাপন হবে তা নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। ইমাম আজম আবু হানিফা ও ইমাম মালেক (রহ.)-এর মত, সামান্য দুধ পান করলেই দুগ্ধ সম্পর্কীয় আত্মীয়তা সম্পর্ক সাব্যস্ত হয়। পরিমাণ কোনো ধর্তব্য নয়। পক্ষান্তরে ইমাম শাফেয়ী ও আহমদ (রহ.) বলেন, নির্দিষ্ট পরিমাণে দুধপানে সাব্যস্ত হবে। পরিমাণ হলো পাঁচবারের বেশি ভিন্ন ভিন্নভাবে পরিতৃপ্ত সহকারে দুধ পান করতে হবে। (ফতহুল বারী ৯ খণ্ড ১৪৭ পৃ.)। তারা আম্মাজান আয়েশা (রা.)-এর হাদিস দলিল হিসেবে পেশ করেন। আম্মাজান আয়েশা (রা.) বলেন, দশবার দুধ চুষলে হারাম হওয়া সাব্যস্ত হয়— একথা কোরআনে পাকে নাজিল হয়েছিল। পরে এ হুকুম মানসুখ হয়ে পাঁচবার চুষলে হারাম হওয়া সাব্যস্ত হওয়ার হুকুম হয়েছিল। এমতাবস্থায় বিশ্বনবী (সা.)-এর ইন্তেকাল হয়। যার কারণে এটা (পাঁচবার) কোরআনের অংশ হিসেবে তিলাওয়াত করা হতো। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৩৪৬১)। এই হাদিসের প্রেক্ষিতে ড. ইউসুফ আল কারজাভীও জায়েজের পক্ষে মত দিয়েছেন।

বিষয়টি যদি হারাম হতো তাহলে ইরান, ইরাক, কুয়েত, আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান ও সিঙ্গাপুরে কীভাবে প্রচলিত আছে? বিষয়টি যদি খুলে বলতেন।

যদি মায়ের দুধ পৃথকভাবে সংরক্ষণ করা যায় এবং দুধ দানকারী ও পানকারী উভয়ের তথ্য সংরক্ষণ করে উভয় পরিবার বিষয়টি জ্ঞাত থাকে তাহলে সম্ভব হতে পারে। যদিও বিষয়টি অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। শরিয়তের বিষয়টি মাথায় রেখে ওলামায়ে কেরামদের একটি পর্যবেক্ষণ বোর্ড রেখে এ কাজটি করা আবশ্যক। যদি কয়েকটি ইসলামী রাষ্ট্রে ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ চালু থাকে। দেখতে হবে তারা কীভাবে ব্যবস্থাপনা করছে? বাংলাদেশের ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের’ কিছু নিয়মনীতি আছে। সেসব নিয়মনীতি যদি উল্লিখিত ইসলামী রাষ্ট্রের মতো এবং শরিয়ত হয় তাহলে ওলামায়ে কেরামগণ এর সঠিক পদ্ধতি বিবেচনা করবেন।

এ পদ্ধতিটি কখন ও কোথা থেকে চালু হয়েছে?

সর্বপ্রথম ১৯০৯ সালে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাতে ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। পরবর্তীকালে ইউরোপ আমেরিকাসহ অন্যান্য রাষ্ট্রে শুরু হয়। মুসলিম বিশ্বে সর্বপ্রথম কুয়েতে শুরু হয়।

ইসলাম তো মানবতা কল্যাণের ধর্ম। স্বাভাবিকভাবে ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ তো শিশুদের কল্যাণের জন্যই। কিন্তু এর পক্ষে-বিপক্ষে কথা চলছে। আপনার মত কী?

হ্যাঁ, স্বাভাবিকভাবে ‘হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক’ শিশুদের কল্যাণের জন্য। শিশুদের কল্যাণের স্বার্থেই গঠন করা হয়েছে। ওলামায়ে কেরামগণ এর পক্ষে-বিপক্ষে মত দিয়েছেন। কিন্তু এ পদ্ধতিটা তখনই জায়েজ হবে যখন সামাজিক উদ্যোগে স্থানীয়ভাবে কোনো নির্দিষ্ট নারী নির্দিষ্ট শিশুকে দুধ পান করান এবং তা সামাজিকভাবে জানাশোনা থাকে ও পরবর্তীতে পারিবারিকভাবে দুধ-রক্তের হারাম সম্পর্ক (মাহরাম) সুরক্ষিত রাখা যায়। দুধমাতা যিনি শিশুকে দুগ্ধ দিতে চান ও দুগ্ধপোষ্য শিশু যার দুধ পান করার প্রয়োজন তাদের মাঝে যোগাযোগ ও সম্পর্ক বা তথ্য আদান-প্রদানে সহযোগিতার জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও উদ্যোগ নেওয়া আবশ্যক। সামাজিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তা করা সম্ভব এবং সহজতর। এর মাধ্যমে সামাজিক দায়বদ্ধতা বাড়বে ও নিরাপত্তা জোরদার হবে।

ইসলামের দৃষ্টিতে মায়ের বুকের দুধ চেপে বের করার কোনো বিধি-নিষেধ আছে? বিজ্ঞান কী বলে?

ইসলাম প্রকৃতির ধর্ম। তাই সহজাত বিষয়গুলো স্বাভাবিক অবস্থায় স্থিত রাখাই ইসলামের বিধান। প্রসূতি মায়ের স্তন থেকে চেপে বা কোনো যন্ত্রের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করে দুগ্ধ নিষ্কাশন করা স্বাভাবিক প্রয়োজনে নয়। তাই বিশেষ সমস্যার সম্মুখীন হওয়া ছাড়া এটি অনুমোদিত নয়। মনে রাখতে হবে মানুষের স্রষ্টা, খালেক ও মালেক একমাত্র মহান আল্লাহতায়ালা। মানুষ নিজে তার নিজের দেহের বা দেহের কোনো অংশবিশেষের মালিক নয়। সুতরাং মানুষ তার নিজের শরীরের কোনো অঙ্গ বা অংশকে নিজের বুঝ বিবেচনা বা আপন বুদ্ধি বিবেক দ্বারা আল্লাহর বিধানের বিপরীতে ব্যবহার বা প্রয়োগ করার অধিকার রাখে না। বিজ্ঞান প্রকৃতিরই অংশ মাত্র। প্রাকৃতিক নিয়মের অনুসরণই প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞান অনুশীলন। এর ব্যতিক্রম সভ্যতা ধ্বংসের কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে।

এ পদ্ধতির দ্বারা কি শিশু মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব?

প্রকৃতি বিরুদ্ধ পদ্ধতি অনুসরণে সাময়িক কল্যাণ দেখা গেলেও দীর্ঘ মেয়াদে অকল্যাণ বয়ে আনবে। জীবন আল্লাহর দান, মরণ আল্লাহর অমোঘ বিধান। আল্লাহতায়ালা কোরআন মাজিদে বলেছন, ‘হে রাসুল (সা.), আপনি বলুন তোমাদের জন্য প্রতিশ্রুত সময় রয়েছে, যা তোমরা মুহূর্তকাল বিলম্বিত করতে পারবে না, আর ত্বরান্বিতও করতে পারবে না।’ (সুরা সাবা : ৩০)। ইসলামী আকিদা বা দর্শনে ঈমান বা বিশ্বাসের ৭৭টি শাখার প্রধান মৌলিক ৭টি বিষয়ের অন্যতম হলো ‘তাকদির’ বা ভাগ্য বিশ্বাস করা, যা কোরআন হাদিসের আলোকে ঈমানে মুফাসসালে বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং মৃত্যু হার কমানো নয় বরং শিশুদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার এটি একটি প্রক্রিয়া মাত্র। তাই কোরআন সুন্নাহ অনুযায়ী জায়েজের পদ্ধতি গ্রহণ করলে আশা করা যায় অপুষ্টিতে শিশু রোগাক্রান্ত না হয়ে বেঁচে থাকতে পারবে ইনশা আল্লাহ।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী : আলেম ও গবেষক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads