• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

সৎ ব্যবসায়ীদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার

  • প্রকাশিত ২৫ অক্টোবর ২০২০

আল্লাহতায়ালা ব্যবসাকে হালাল করেছেন আর সুদকে করেছেন হারাম। আর ব্যবসা হলো সম্পদ উপার্জনের অন্যতম একটি মাধ্যম। প্রাচীন কাল থেকে এখন পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করে আসছে মানবজাতি। তবে সর্বদাই নীতি-নৈতিকতার অভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতারিত হচ্ছে এক শ্রেণির মানুষ। আর যারা অনৈতিক পদ্ধতিতে সম্পদ উপার্জন করছে, বাহ্যিকভাবে তারা সফলতা পেলেও মান-সম্মান বিনষ্ট হচ্ছে তাদের চিরতরে। ব্যবসা-বাণিজ্যে এই অনৈতিকতার কারণে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য জটিল আকার ধারণ করছে। সমাজে দেখা দিচ্ছে বিশৃঙ্খলা ও অরাজগতা। আর এসব অবস্থা দূর করার জন্য ইসলাম সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা দিয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর হে আমার জাতি, ন্যায়নিষ্ঠার সাথে ঠিকভাবে পরিমাপ কর ও আর ওজন দাও এবং লোকদের জিনিসপত্রে কোনোরূপ ক্ষতি করো না, আর পৃথিবীতে ফাসাদ করে সীমা অতিক্রম করো না।’ (সুরা হুদ ৮৫)। ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাাতিক, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতিসহ সকল বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ দিক-নির্দেশনা রয়েছে ইসলামে। যারা ইসলামের বিধান অনুযায়ী চলবে তাদের দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মান ও কল্যাণের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। ইবাদাত কবুল হওয়ার জন্য শর্ত হলো হালাল রিজিক। আর রিজিক অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হলো ব্যবসা-বাণিজ্য। ইসলামী বিধি-বিধান অনুযায়ী ব্যবসা পরিচালনার জন্য কোরআন-হাদিসে বিভিন্ন বিধি-বিধান উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহপাক বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ। আর তোমরা নিজেদের কাউকে হত্যা করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহতায়ালা তোমাদের প্রতি দয়ালু।’ (সুরা নিসা ২৯)। কোরআনে আরো উল্লেখ রয়েছে, ‘তিনিই তো তোমাদের জন্য ভূমিকে সুগম করে দিয়েছেন, অতএব তোমরা দিক-দিগন্তে বিচরণ কর এবং তাঁর প্রদত্ত জীবনোপকরণ হতে আহার্য গ্রহণ কর। পুনরুত্থান তো তাঁরই নিকট।’ (সুরা মুলক ১৫)। যারা সততার সাথে ইসলামী বিধি-বিধান অনুযায়ী ব্যবসা পরিচালনা করে তাদের বিশেষ মর্যাদা ও পুরস্কারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘অতএব তোমরা মাপ ও ওজন পূর্ণ কর এবং মানুষকে তাদের দ্রব্যাদি কম দিয়ো না এবং ভূপৃষ্ঠে সংস্কার সাধন করার পর তাতে অনর্থ সৃষ্টি করো না। এই হলো তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও।’ (সুরা আরাফ ৮৫)। আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, ‘নামাজ সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সুরা জুমআ ১০)। জীবনর তাগিদে কাজ, পরিশ্রম, প্রচেষ্টা ও উপার্জন প্রয়োজন। তবে রোজগারের জন্য আল্লাহতায়ালার স্মরণ অতীব জরুরি। আল্লাহর স্মরণ থাকলে কাজ-কর্ম ও আয় রোজগারের যে চেষ্টা চালানো হয়, তা সবকিছুই ইবাদতে পরিণত হয়। যে সকল ব্যবসায়ী ইসলামী বিধি-বিধান পালন করে থাকে, আল্লাহ তাদের জীবিকা বৃদ্ধি করে দেন এবং অধিক সফলতা প্রদান করে থাকেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সেই সব লোক, যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ হতে, নামাজ কায়েম ও জাকাত প্রদান হতে বিরত রাখে না, তারা ভয় করে সেই দিনকে যেই দিন তাদের অন্তর ও দৃষ্টি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। যাতে তারা যে কর্ম করে তজ্জন্য আল্লাহ তাদের উত্তম পুরস্কার দেন এবং নিজ অনুগ্রহে তাদের অধিক দেন। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত জীবিকা দান করেন।’ (সুরা আন নুর ৩৭)। আল্লাহতায়ালা নিজেকে তাদের অংশীদার হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যারা ব্যবসা পরিচালনায় বিশ্বাসঘাতকতা না করে। এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেন, যতক্ষণ দুজন শরিকদার ব্যবসায়ে একে অপরের সাথে খিয়ানত (বিশ্বাসঘাতকতা) না করে ততক্ষণ আমি তাদের তৃতীয় শরিক হিসেবে (তাদের সহযোগিতা করতে) থাকি। অতঃপর যখন খিয়ানত করে, তখন আমি তাদের মধ্য থেকে বেরিয়ে যাই (তারা আমার সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হয়)।’ (আবু দাউদ)।  রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, ক্রেতা ও বিক্রেতার জন্যে পরস্পর পৃথক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত খিয়ার থাকবে। উভয়ে যদি সত্য কথা বলে এবং দোষত্রুটি বলে দেয় তবে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ের বরকত হবে। আর যদি তারা ক্রয়-বিক্রয়ের মধ্যে মিথ্যার আশ্রয় নেয় এবং দোষত্রুটি গোপন রাখে, তবে ততে বরকত থাকবে না।’ (সহিহ মুসলিম)। অপর একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত- ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটা খাদ্যস্তূপের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে তাঁর হাত তাতে প্রবেশ করালেন। ফলে তাঁর আঙুলে কিছু ভিজা অনুভূত হলো। তারপর তিনি বললেন, হে খাদ্য বিক্রেতা এ আবার কী? লোকটি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, ওতে বৃষ্টি পেয়েছে। তিনি বললেন, কেন তুমি ঐ ভেজা অংশটাকে ওপরে রাখলে না, তাহলে লোকে তা দেখতে পেত। যে ধোঁকাবাজি করে (কেনা-বেচা করে) সে আমাদের নীতিতে নয়।’ (সহীহ মুসলিম)। ইসলামে সৎ ব্যবসায়ীদের মুজাহিদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত- ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, বিধবা ও মিসকিনদের জন্য উপার্জনকারী ব্যক্তি আল্লাহর পথে জিহাদরত ব্যক্তির মতো। আর যারা রাত্রিতে নফল ইবাদত করে ও দিনে রোজা রাখে তাদের সমতুল্য (ইবনে মাজাহ)।’

ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে সাধারণত লোভ ও লালসার দাসত্বে পরিণত হতে দেখা যায়। আর এ ব্যবসা যে কোনো উপায়ে মুনাফা লুণ্ঠনের প্রবণতা প্রকট করে থাকে। আরো মুনাফা লাভের জন্যে মানুষকে প্ররোচিত করে। কিন্তু যে ব্যবসায়ী সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও বিশ্বস্ততা রক্ষা করে, সে অবশ্যই জিহাদকারী ব্যক্তি। কেননা সে প্রতিনিয়ত লোভ-লালসার মুকাবিলা করে চলছে। অতএব মুজাহিদের মর্যাদা তার জন্য খুবই শোভনীয় এবং বাঞ্ছনীয়। ইসলামী অর্থব্যবস্থায় ব্যবসায় সততা প্রতিষ্ঠার জন্য সৎ ব্যবসায়ীর মর্যাদা আরো বৃদ্ধি করেছে। দুনিয়াতে সৎ ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন মর্যাদা ও সফলতা প্রাপ্তির পর কিয়ামতের ময়দানে তাদের অসৎ ব্যবসায়ীদের থেকে পৃথক করে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করা হবে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, হজরত রিফা’আ (রা.) থেকে বর্ণিত- ‘তিনি বলেন, আমরা আল্লাহর রাসুল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে বের হলাম। তিনি দেখতে পেলেন, লোকেরা সকাল বেলা বেচাকেনা করছে। তখন তিনি তাদের এই বলে ডাকলেন, হে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। তারা যখন চোখ তুলে ও ঘাড় উঁচু করে দেখল, তখন তিনি বললেন, ব্যবসায়ীদের কিয়ামতের দিন পাপীদের সাথে উঠানো হবে। তবে ওইসব লোক ব্যতীত, যারা আল্লাহকে ভয় করে, সততার সাথে ব্যবসা করে ও সত্য কথা বলে।’ (ইবনে মাজাহ)। কিয়ামতের দিন সৎ ব্যবসায়ীরা আরশের নিচে স্থান পাবে এবং নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের কাতারে থাকবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘বিশ্বস্ত সত্যবাদী মুসলিম ব্যবসায়ী কিয়ামতের দিন শহীদের সাথে থাকবে।’ (ইবনে মাজাহ)। ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যে সরলতা প্রদর্শনে নিদের্শনা দিয়েছে। যারা সরলতা প্রদর্শন করে তাদের জান্নাতবাসী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘বেচাকেনার সময় যে সরলতা প্রকাশ করে, আল্লাহ তাকে বেহেশতে প্রবেশ করাবেন।’ (ইবনে মাজাহ)। সৎ ব্যবসায়ীদের প্রতিদানস্বরূপ দুনিয়া ও আখেরাতে বিশেষ পুরস্কার ও মর্যাদা রয়েছে। ইসলামের সকল বিধি-বিধান পালনের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনার মাধ্যমে সমাজে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

 

লেখক : ইমাম ও খতিব

টুটালিয়াড়া জামে মসজিদ, সাভার, ঢাকা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads