• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

ধর্ম

ইসলামে সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই

  • প্রকাশিত ২৭ অক্টোবর ২০২০

মুফতি মাহফুজুর রহমান হোসাইনী

 

 

আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনুল করিমে ইরশাদ করেন, ‘(হে নবী) আমি আপনাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।’ (সুরা : সাবা-২৮)। মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ তথা সমস্ত মানুষের হেদায়তের জন্য আল্লাহ রাসুলকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন এবং সকল মানুষের জন্য রাসুলকে বানিয়েছেন রহমত। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘(হে নবী) আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সুরা : আম্বিয়া-১০৭)

আল্লাহতায়ালা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিশ্বের সমস্ত মানুষের কল্যাণকামী করে পাঠিয়েছেন। আর মানবতার নবী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সারা বিশ্বে রহমত ছড়িয়ে দিয়েছেন। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় ও মানবাধিকার বাস্তবায়নের বিরল দৃষ্টান্ত তিনি রেখে গেছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের আপনজন ও আত্মীয়-স্বজন অনেকেই ছিল ইসলামের কট্টর দুশমন। তারপরও নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের প্রতিশোধ তো দূরের কথা, তাদের প্রতি মৌখিক অভিযোগও উত্থাপন করেননি। বরং কোনো বিরোধী যখন অসুস্থ হতো, তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে দেখতে যেতেন। অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের সময় মক্কায় প্রবেশকালে মক্কার অমুসলিমরা প্রাণের ভয়ে থরথর করে কাঁপছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমস্ত অমুসলিমদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে বলেন, তোমাদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। আজ তোমরা মুক্ত ও স্বাধীন। তিনি সবাইকে আপন করে নেন। যেই মক্কাবাসী নবীজিকে তেরোটি বছর চরম অমানবিক নির্যাতন করেছে, তাঁকে হত্যা করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে। শেষ পর্যন্ত তিনি প্রাণ বাঁচাতে নিজ মাতৃভূমি ছাড়তে বাধ্য হন। সেই মক্কাবাসীর হেফাজতের দায়িত্ব তিনি নিজেই নিলেন। মুসলিমদের ন্যায় তাদের জান-মালের শতভাগ নিরাপত্তা দিলেন। ইতিহাস সাক্ষী, এমন নজিরবিহীন উদারতার পরিচয় আর কেউ দিতে পারেনি এবং কোনোদিন পারবেও না।

এটাই হলো ইসলামের আদর্শ। ইসলাম সকল মানুষের শান্তিকামী। ইসলাম শান্তির কথা বলে। দাঙ্গা-হাঙ্গামা ইসলাম সমর্থন করে না। অন্যায়, অবিচারকে ইসলাম ঠাঁই দেয় না। ইসলামে কোনো সাম্প্রদায়িকা নেই। ইসলাম সম্প্রীতির বন্ধন অটুট রাখে। একজন প্রকৃত মুসলমান কখনোই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অনুভূতিতে আঘাত আসে এমন কোনো কাজ করতে পারে না। সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপারে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুল কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ধর্মের ব্যাপারে জোরজবরদস্তি নেই। ভ্রান্ত মত-পথকে সঠিক মত-পথ থেকে ছাঁটাই করে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে।’ (সুরা বাকারা : ২৫৬)। বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘যারা মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে ডাকে, সাম্প্রদায়িকতার জন্য যুদ্ধ করে, সংগ্রাম করে এবং জীবন উৎসর্গ করে তারা আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (সুনানে আবু দাউদ : ৫১২৩)। একজন ঈমানদার মুসলমান কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িকা দাঙ্গায় নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারে না। বিধর্মীদের দেবদেবীকে গালি দিতে পারে না। মুমিনদের উদ্দেশে আল্লাহতায়ালা বলছেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব দেবদেবীর পূজা-উপাসনা করে, তোমরা তাদের গালি দিও না। যাতে করে তারা শিরক থেকে আরো অগ্রসর হয়ে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে গালি দিয়ে না বসে।’ (সুরা আনআম : ১০৮)। রাসুলুল্লাহ (সা.) ও খোলাফায়ে রাশেদিনের চিরাচরিত নিয়ম ছিল, যখন কোনো সেনাবাহিনী প্রেরণ করার প্রয়োজন হতো, তখন যুদ্ধ সম্পর্কিত বিভিন্ন নসিহত, দিকনির্দেশনার পাশাপাশি একথা অবশ্যই বলে দিতেন যে, ‘যুদ্ধকালীন সময়ে বা যুদ্ধের পর কোনো মন্দির-গির্জা-উপাসনালয় ভেঙে ফেলবে না।’ (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা : ৩৩৮০৪)

ইসলাম শান্তি-সম্প্রীতি ও মানবতার ধর্ম। কোনোরূপ সহিংসতা, বিবাদ-বিসংবাদের স্থান ইসলামে নেই। ন্যূনতম শান্তি-শৃঙ্খলা ও সম্প্রীতি বিনষ্ট হয় এমন আচরণকেও ইসলাম প্রশ্রয় দেয় না। ইসলামের আবির্ভাব হয়েছে শান্তি প্রতিষ্ঠা, মানবকল্যাণ ও মানবতার জন্য। মুসলিম হোক বা অমুসলিম হোক মুসলিম বিশ্বে কোনো নিরপরাধ মানুষ হত্যা মহা অন্যায়। আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করা ছাড়া (অন্যায়ভাবে) কাউকে হত্যা করে সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করে। এবং যে কারো জীবন রক্ষা করে, সে যেন সবার জীবন রক্ষা করে।’ (সুরা : মায়িদা-৩২)।

মুসলিম-অমুসলিম সকলের মানবাধিকার ইসলামে সমান। ইসলাম জননিরাপত্তার গ্যারান্টি। মুসলিম দেশে অমুসলিম সংখ্যালঘুর জান-মালের নিরাপত্তা সংরক্ষিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের যে কেউ কোনো চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমের ওপর অত্যাচার করবে, বা তার হক নষ্ট করবে, কিংবা তার সামর্থ্যের বাইরে তাকে কষ্ট দেবে, অথবা ইচ্ছার বিরুদ্ধে (জোরপূর্বক) তার কোনো জিনিস নেবে, আমি কিয়ামতের দিন তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করব।’ (আবু দাউদ : হাদিস নং-৩০৫৪)। তিনি আরো ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলিম দেশে চুক্তিবদ্ধ কোনো অমুসলিমকে কতল করবে সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। যদিও জান্নাতের ঘ্রাণ ৪০ বসরের দূরত্ব থেকে পাওয়া যায়।’ (বুখারি হাদিস নং- ৩১৬৬)।

মুসলিম দেশে চুক্তিবদ্ধ কোনো অমুসলিমকে যদি ভুল করেও হত্যা করা হয়, এ ব্যাপারেও ইসলামে ক্ষতিপূরণের বিধান রয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ভুলক্রমে হত্যাকৃত ব্যক্তি যদি চুক্তিবদ্ধ কোনো সম্প্রদায়ের অন্তর্গত হয়, তবে তার স্বজনদের রক্ত বিনিময় সমর্পণ করবে এবং একজন মুসলমান ক্রীতদাস মুক্ত করবে, অতঃপর যে ব্যক্তি (ক্রীতদাস মুক্ত করতে) না পায়, সে আল্লাহর কাছ থেকে গুনাহ মাফ করার জন্য লাগাতার দুই মাস রোজা রাখবে। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা নিসা-৯২)।

ইসলামের ছায়াতলেই কেবল সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হলো ইসলামী শাসনামল। তথা খোলাফায়ে রাশেদিনের শাসনামল। সেই স্বর্ণ যুগে মুসলিম-অমুসলিম সকলেই নিরাপদে জীবনযাপন করেছে। হজরত উমর (রা.)-এর শাসনামলে মিসরের এক অমুসলিম সংখ্যালঘু অভিযোগ করল, মিসরের গভর্নর হজরত আমর ইবনে আ’স (রা.)-এর ছেলে তাকে নির্যাতন করেছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলো। আমিরুল মুমিনিন হজরত উমর (রা.) গভর্নরের ছেলেকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নিজের চাবুক সেই অমুসলিমের হাতে দিয়ে বললেন, তোমাকে যেভাবে যতটুকু আঘাত সে করেছে তুমিও সেভাবে তাকে আঘাত করো। সে যার ছেলেই হোক না কেন! রাজা-প্রজা, মন্ত্রী-মিনিস্টার, ধনী-গরিব, মুসলিম-অমুসলিম সমস্ত মানুষের রক্তের মূল্য ইসলামে সমান। ইসলাম ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্যই এসেছে।

বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নিদর্শন। এ দেশের মুসলিম-অমুসলিম সকলেই আপন। একে অপরের প্রতি সহনশীল। যারা সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব লাগানোর গভীর চক্রান্ত করে যাচ্ছে, নিঃসন্দেহে তারা স্বাধীনতাবিরোধী। এরাই হলো সত্যিকারের দেশদ্রোহী। এরা দেশের শত্রু, মানবতার শত্রু, ইসলামের শত্রু। অন্যায়ভাবে সংখ্যালঘুদের ওপর যারা আক্রমণ করে তারা কখনো সত্যিকারের মুসলমান হতে পারে না। আসুন আমরা দেশ ও ইসলামের এসব শত্রুদের মোকাবিলায় প্রতিরোধ গড়ে তুলি।

 

লেখক : মুহাদ্দিস

জামিয়া শায়খ আবদুল মোমিন, মোমিনশাহী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads