• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

হিজড়া সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

  • প্রকাশিত ২১ নভেম্বর ২০২০

মুফতি মাহমুদুল হক জালীস

 

এই পৃথিবীতে যা কিছু হয় সব আল্লাহর নির্দেশেই হয়। তাঁর আদেশের বাইরে কোনো কিছুই হতে পারে না। তিনি যাকে ইচ্ছা পুরুষ বানান আবার যাকে ইচ্ছা নারী বানান। এখানে কারো কোনো হাত নেই। ক্ষমতা নেই তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কিছু সৃষ্টি করার। এ প্রসঙ্গে কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, আসমান ও জমিনের একমাত্র কর্তৃত্ব আল্লাহর। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন যাকে ইচ্ছে পুত্র সন্তান দান করেন। (সুরা শুরা-৪৯)। এই আয়াতে শুধুমাত্র নারী-পুরুষের কথা বলা হয়েছে। অথচ আমরা আমাদের সমাজে নারী-পুরুষ ছাড়াও তৃতীয় একশ্রেণির মানুষ দেখতে পাই। যাদেরকে সমাজের লোকেরা হিজড়া বলে সম্বোধন করে। বাংলা একাডেমির অভিধানে বলা হয়েছে-‘হিজড়া’ শব্দটি হিন্দি ভাষা থেকে এসেছে। তবে আবার কেউ কেউ বলেছে, হিজড়া শব্দটি এসেছে ফারসি থেকে। যার অর্থ ‘সম্মানিত ব্যক্তি’। কোরআন-হাদিস তথা ইসলামি ফিেহর ভাষায় হিজড়াকে উল্লেখ করা হয়েছে ‘খুনছা’ শব্দে। বাংলায় যার অর্থ আসে, নরম হওয়া, দুর্বল হওয়া, ভেঙে পড়া, ত্রুটিযুক্ত হওয়া ইত্যাদি। আরবি ভাষায় হিজড়াকে খুনছা বলার কারণ হচ্ছে, সে পুরুষের তুলনায় ভঙ্গুর হয়, দুর্বল হয়, ত্রুটিযুক্ত হয়। নারীর তুলনায় তার অবস্থা আবার কিছুটা উন্নত হয়। পারিভাষায় ‘হিজড়া’ হচ্ছে, এমন মানুষ যার পুরুষের অনুরূপ পুরুষাঙ্গ এবং নারীর অনুরূপ গুপ্তাঙ্গ বিদ্যমান অথবা বাস্তবে এদের কারো অনুরূপই নয়; বরং তার একটি ছিদ্র বিদ্যমান যা পুরুষ-নারী কারোর অনুরূপই নয়। এদেরকে হিজড়া বলে।

মোদ্দাকথা সৃষ্টির ক্ষেত্রে মানুষের কোনো হাত নেই। এটা সম্পূর্ণটা আল্লাহর হাতে। তিনি যাকে যেভাবে খুশি সেভাবে সৃষ্টি করেন। কাউকে দৈহিক পূর্ণতা দান করেন আবার কাউকে দৈনিক অপূর্ণতায় রেখে দেন। এ প্রসঙ্গে কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি (আল্লাহ) মাতৃগর্ভে তোমাদের যেমন ইচ্ছা তেমন রূপ দেন।’ (সুরা আলে ইমরান-৬)। হিজড়াদের ব্যাপারে ইসলামের বিধান হলো, তাদেরকে নারী বা পুরুষের যে কোনো একটি ক্যাটাগরিতে ফেলতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি মূলনীতি নির্ধারণ করে দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে, হযরত আলী (রা.) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঐ প্রসূত বাচ্চার বিধান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন যে পুরুষও না আবার নারীও না। জবাবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সে মিরাস পাবে যেভাবে প্রস্রাব করে। (সুনানে বায়হাকি, হাদিস-১২৯৪)। অর্থাৎ দেখতে হবে হিজড়ার প্রস্রাব করার অঙ্গটি কেমন? সে কি পুরুষদের মতো গোপনাঙ্গ দিয়ে প্রস্রাব করে? নাকি নারীদের মতো গোপনাঙ্গ দিয়ে প্রস্রাব করে? গোপনাঙ্গ যাদের মতো হবে, হুকুমও তাদের মতোই হবে। গোপনাঙ্গ যদি পুরুষের মতো হয়, তাহলে পুরুষ। যদি নারীর মতো হয়, তাহলে নারী। আর যদি কোনোটিই বোঝা না যায়, তাহলেও তাকে নারী হিসেবে গণ্য করা হবে।

এছাড়া কাফন-দাফন করার সময়ও এ বিষয়টি লক্ষ রাখতে হবে। যদি পুরুষ বা নারীর ক্যাটাগরিতে অন্তুর্ভুক্ত হয় তবে সেই অন্তুর্ভুক্ত অনুযায়ী দাফন করা হবে। আর যদি কোনো ক্যাটাগরিতেই না পড়ে, তাহলে নারীর মতো কাফন-দাফন করা হবে। অনেক হিজড়া এমন আছে, যারা নিজেদের অঙ্গ কর্তন করে হিজড়া সাজে। মানুষদেরকে ধোঁকা দিয়ে টাকাপয়সা ছিনিয়ে নেয়। অথচ এভাবে হিজড়া সাজা সম্পূর্ণ হারাম। কারণ, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এসব মানুষের ওপর অভিশাপ দিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যারা নারীদের সাদৃশ্য অবলম্বন করে তাদের ওপর অভিশাপ এবং ওই সব নারীর ওপরও অভিশাপ, যারা পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বন করে এবং আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করে। (বুখারি, হাদিস-৩৮৮৫)।

সমাজে সাধারণ মানুষের যেমন সম্মান রয়েছে, ঠিক তদ্রূপ মানুষ হিসাবে হিজড়াদেরও সম্মান রয়েছে। তাদেরকে ঘৃণার চোখে দেখা যাবে না। সামাজিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। কারণ, ইসলাম হিজড়াদের সম্মান দিয়েছে। সমাজের অন্য সবার মতো অধিকারও দিয়েছে। ইসলাম তাদেরকে আলাদা চোখে দেখেনি। অতএব তারা সাধারণ নারী-পুরুষের মতো সব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগ করবে। তাদেরকে হিজড়া বলে কোণঠাসা করা যাবে না। এমনকি ইসলামের বিধিবিধান পালনে তারা অন্য সবার মতো হবে। তাদের ইবাদতও হবে সাধারণ মানুষের ইবাদতের অনুরূপ। কেননা হাদিসে এসেছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের চেহারা ও সম্পদ দেখেন না; বরং তিনি তোমাদের হূদয় এবং আমলসমূহ দেখেন।’ (মুসলিম, হাদিস-৬৭০৮)। তাই আমাদের উচিত, হিজড়াদেরকে সমাজের অন্য মানুষের মতোই গণ্য করা। তাদেরকে ঘৃণা বা অন্য দৃষ্টিতে না দেখা। তারা যেন সমাজে অবহেলিত না হয়। তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করা। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।

 

লেখক : মুহাদ্দিস, খাদিমুল ইসলাম মাদরাসা, ঢাকা

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads