• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

মূর্তি-ভাস্কর্যের ব্যাপারে ইসলাম যা বলে

  • প্রকাশিত ২৭ নভেম্বর ২০২০

মুফতি নাঈম কাসেমী

 

 

আল্লাহরাব্বুল আলামীন সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করেন শিরক করাকে। আর মূর্তির্  হলো শিরকের অন্যতম মাধ্যম। তাই আল্লাহতায়ালা এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত কঠোরভাবে মূর্তি-ভাস্কর্য থেকে বেঁচে থাকতে বলেছেন। কোনো প্রাণীর মূর্তি নির্মাণ ইসলামী শরিয়তে কবীরা গুনাহ ও হারাম। মূর্তি সংগ্রহ, মূর্তি সংরক্ষণ এবং মূর্তির বেচাকেনা ইত্যাদি ইসলামে কঠিনভাবে নিষিদ্ধ। মূর্তিপূজার কথা তো বলাইবাহুল্য। মূর্তি নির্মাণেরও কিছু কিছু পর্যায় এমন রয়েছে যা কুফরি।

মূর্তি ও ভাস্কর্যের মধ্যে বিধানগত কোনো পার্থক্য নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে মূর্তি ও ভাস্কর্য দুটোই পরিত্যাজ্য। কোরআন মাজিদ ও হাদিস শরিফে এ প্রসঙ্গে যে শব্দগুলো ব্যবহূত হয়েছে সেগুলো মূর্তি ও ভাস্কর্য দুটোকেই নির্দেশ করে। এ প্রসঙ্গে কোরআন  মাজিদের স্পষ্ট নির্দেশ“তোমরা পরিহার করো অপবিত্র বস্তু অর্থাৎ মূর্তিসমূহ এবং পরিহার করো মিথ্যা বলা।’ (সুরা হজ্ব, আয়াত-৩০) এই আয়াতে সবধরনের মূর্তি-ভাস্কর্য পরিত্যাগ করা এবং মূর্তিকেন্দ্রিক সব কর্মকাণ্ড বর্জন করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। অন্যত্র আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন“‘এবং তারা (কাফেররা) বলেছিল, তোমরা কখনো পরিত্যাগ করো না তোমাদের উপাস্যদেরকে এবং কখনো পরিত্যাগ করো না ওয়াদ্দ, সুওয়া, ইয়াগূছ, ইয়াঊক ও নাসরকে।’ (সুরা নূহ, আয়াত-২৩) আয়াতে কাফের সম্প্রদায়ের দুটো বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে। ১. মিথ্যা উপাস্যদের পরিত্যাগ না করা। ২. মূর্তি-ভাস্কর্য পরিহার না করা। তাহলে মিথ্যা উপাস্যের উপাসনার মতো ভাস্কর্যপ্রীতিও কোরআন  মাজিদে কাফেরদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত। অতএব এটা যে ইসলামে গর্হিত ও পরিত্যাজ্য তা তো বলাইবাহুল্য। আয়াতে উল্লিখিত মূর্তিগুলো সম্পর্কে সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রা.) বলেন, ‘এগুলো হচ্ছে নূহ (আ.)-এর সম্প্রদায়ের কিছু পুণ্যবান লোকের নাম। তারা যখন মৃত্যুবরণ করেছে তখন শয়তান তাদের সম্প্রদায়কে এই কুমন্ত্রনা দিয়েছে যে, তাদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোতে মূর্তি স্থাপন করা হোক এবং তাদের নামে সেগুলোকে নামকরণ করা হোক। লোকেরা এমনই করল। ওই প্রজন্ম যদিও ওইসব মূর্তির পূজা করেনি, কিন্তু ধীরে ধীরে প্রকৃত বিষয় অস্পষ্ট হয়ে গেল এবং পরবর্তী প্রজন্ম তাদের পূজায় লিপ্ত হল।’(সহিহ বুখারি শরিফ)

কোরআন  মাজিদে মূর্তি ও ভাস্কর্যকে পথভ্রষ্টতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এক আয়াতে এসেছে“‘ইয়া রব! এগুলো (মূর্তি-ভাস্কর্য) অসংখ্য মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে!’ (সুরা ইবরাহীম, আয়াত- ৩৬)। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে“‘আর তারা (কাফেররা) বলেছিল, তোমরা পরিত্যাগ করো না তোমাদের উপাস্যদের এবং পরিত্যাগ করো না ওয়াদ্দ, সুওয়া, ইয়াগূছ, ইয়াঊক ও নাসরকে। অথচ এগুলো অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে।’(সুরা নূহ, আয়াত-২৩ ও ২৪)।  কোরআনের ভাষায় মূর্তি ও ভাস্কর্য হলো বহুবিধ মিথ্যার উৎস। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন“‘তোমরা তো আল্লাহর পরিবর্তে উপাসনা কর (অসার) মূর্তির এবং তোমরা নির্মাণ কর ‘মিথ্যা’।’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত-১৭)। মূর্তি ও ভাস্কর্য যেহেতু অসংখ্য মিথ্যার উদ্ভব ও বিকাশের উৎস, তাই আয়াতে একে ‘মিথ্যা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই আয়াতগুলো থেকে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে যে, মূর্তি ও ভাস্কর্য দুটোই সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাজ্য।

হাদিস শরিফেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মূর্তি ও ভাস্কর্য সম্পর্কে পরিষ্কার বিধান বর্ণনা করেছেন।

১. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-‘আল্লাহতায়ালা আমাকে প্রেরণ করেছেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার, মূর্তিসমূহ ভেঙ্গে ফেলার এবং এক আল্লাহর ইবাদত করার ও তাঁর সঙ্গে অন্য কোনো কিছুকে শরিক না করার বিধান দিয়ে। (সহিহ মুসলিম)

২. আবুল হাইয়াজ আসাদী বলেন, আলী ইবনে আবী তালেব (রা.) আমাকে বললেন, ‘আমি কি তোমাকে ওই কাজের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করব না? যে কাজের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে প্রেরণ করেছিলেন? তা এই যে, তুমি সব প্রাণীর মূর্তি বিলুপ্ত করবে এবং সব সমাধি-সৌধ ভূমিসাৎ করে দেবে।’ অন্য বর্ণনায় এসেছে,... এবং সব চিত্র মুছে ফেলবে।’ (সহিহ মুসলিম)

৩. হজরত আলী (রা.) বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি জানাযায় উপস্থিত ছিলেন। তখন তিনি বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে কে আছে, যে মদীনায় যাবে এবং যেখানেই কোনো প্রাণীর মূর্তি পাবে তা ভেঙ্গে ফেলবে। যেখানেই কোনো সমাধি-সৌধ পাবে তা ভূমিসাৎ করে  দেবে এবং যেখানেই কোনো চিত্র পাবে তা মুছে দেবে।’ আলী (রা.) এই দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত হলেন। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে কেউ পুনরায় উপরিউক্ত কোনো কিছু তৈরী করতে প্রবৃত্ত হবে সে মোহাম্মদের (সা.)-এর প্রতি নাজিলকৃত দিনকে অস্বীকারকারী।’ (মুসনাদে আহমাদ)। এই হাদিসগুলো থেকে স্পষ্ট জানা যাচ্ছে, যে কোনো প্রাণীর মূর্তিই ইসলামে পরিত্যাজ্য এবং তা বিলুপ্ত করাই হলো ইসলামের বিধান। আর এগুলো নির্মাণ করা ইসলামকে অস্বীকারকারী সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য।

৪. আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-‘প্রতিকৃতি তৈরিকারী (ভাস্কর, চিত্রকর) শ্রেণি হলো ওইসব লোকদের অন্তর্ভুক্ত যাদেরকে কিয়ামত দিবসে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি প্রদান করা হবে।’ (সহিহ বুখারি)

৫. আবু হুরায়রা (রা.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, আল্লাহতায়ালা বলেন-‘ওই লোকের চেয়ে বড় জালেম আর কে যে আমার সৃষ্টির মতো সৃষ্টি করার ইচ্ছা করে। তাদের যদি সামর্থ্য থাকে তবে তারা সৃজন করুক একটি কণা এবং একটি শস্য কিংবা একটি যব!’ (সহিহ বুখারি) এই হাদিসটি বর্তমান সময়ের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, যখন ভাস্কর, চিত্রকর, এমনকী গল্পকার ও ঔপন্যাসিকদেরকে পর্যন্ত ‘স্রষ্টা’ বলতে এবং তাদের কর্মকাণ্ডকে ‘সৃষ্টি’ বলতে সামান্যতমও দ্বিধাবোধ করা হয় না। কোনো কোনো আলোচকের আলোচনা থেকে এতটা ঔদ্ধত্যও প্রকাশিত হয় যে, যেন তারা সত্যি সত্যিই স্রষ্টার আসনে আসীন হয়ে গিয়েছেন! সহিহ বুখারির বিখ্যাত ভাষ্যকার হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (র.) লেখেন-‘এই ভাস্কর ও চিত্রকর সর্বাবস্থাতেই হারাম কাজের মধ্যে লিপ্ত। আর যে এমন কিছু নির্মাণ করে যার পূজা করা হয় তার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। আর যে স্রষ্টার সামঞ্জস্য গ্রহণের মানসিকতা পোষণ করে সে কাফের ।’ (ফতহুল বারী ১০/৩৯৭)

৬. উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) ও আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-‘এই প্রতিকৃতি নির্মাতাদের (ভাস্কর, চিত্রকরদের) কিয়ামত দিবসে আজাবে নিক্ষেপ করা হবে এবং তাদেরকে সম্বোধন করে বলা হবে, যা তোমরা ‘সৃষ্টি’ করেছিলে তাতে প্রাণসঞ্চার কর!’ (সহিহ বুখারি)

৭. আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রা.) বলেন, আমি মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘যে কেউ দুনিয়াতে কোনো প্রতিকৃতি তৈরি করে কিয়ামত দিবসে তাকে আদেশ করা হবে সে যেন তাতে প্রাণসঞ্চার করে অথচ সে তা করতে সক্ষম হবে না।’ (সহিহ বুখারি)

৮. আউন ইবনে আবু জুহাইফা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুদ ভক্ষণকারী ও সুদ প্রদানকারী, উল্কি অঙ্কনকারী ও উল্কি গ্রহণকারী এবং প্রতিকৃতি প্রস্তুতকারীদের (ভাস্কর, চিত্রকরদের) ওপর লানত করেছেন। (সহিহ বুখারি)। এই হাদিসগুলো থেকে প্রমাণিত হয়, ভাস্কর্য নির্মাণ অত্যন্ত কঠিন কবীরা গুনাহ। আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা কুফরির পর্যায়েও পৌঁছে যায়। মূর্তি ও ভাস্কর্যের বেচাকেনাও হাদিস শরিফে সম্পূর্ণ হারাম সাব্যস্ত করা হয়েছে।

৯. হজরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা বিজয়ের সময় মক্কায় থাকা অবস্থায় এই ঘোষণা দিয়েছেন যে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল মদ ও মূর্তি এবং শুকর ও মৃত প্রাণী বিক্রি করা হারাম করেছেন।’ (সহিহ বুখারি)

১০. উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অসুস্থতার সময় তাঁর জনৈকা স্ত্রী একটি গির্জার কথা উল্লেখ করলেন। গির্জাটির নাম ছিল মারিয়া। উম্মে সালামা ও উম্মে হাবীবা ইতোপূর্বে হাবশায় গিয়েছিলেন। তারা গির্জাটির কারুকাজ ও তাতে বিদ্যমান প্রতিকৃতিসমূহের কথা আলোচনা করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শয্যা থেকে মাথা তুলে বললেন, ওই জাতির কোনো পুণ্যবান লোক যখন মারা যেত তখন তারা তার কবরের ওপর ইবাদতখানা নির্মাণ করত এবং তাতে প্রতিকৃতি স্থাপন করত। এরা হচ্ছে আল্লাহর নিকৃষ্টতম সৃষ্টি।’ (সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম, নাসায়ী)

১১. আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রা.) বলেন, ‘(ফতহে মক্কার সময়) নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বায়তুল্লাহ শরিফে বিভিন্ন প্রতিকৃতি দেখলেন তখন তা মুছে ফেলার আদেশ দিলেন। প্রতিকৃতিগুলো  মুছে ফেলার আগ পর্যন্ত তিনি তাতে প্রবেশ করেননি।’ (সহিহ বুখারি)

দৃষ্টান্তস্বরূপ এখানে এগারোটি হাদিস পেশ করা হলো। আলোচিত প্রসঙ্গে ইসলামী বিধান বোঝার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। কোরআন  মাজিদে যে কোনো ধরনের মূর্তির সংশ্রব ও সংশ্লিষ্টতা পরিহারের যে আদেশ মুমিনদেরকে করা হয়েছে সে সম্পর্কে একটা বিস্তারিত ধারণাও উপরিউক্ত হাদিসগুলো থেকে জানা গেল। কোরআন  ও সুন্নাহর এই সুস্পষ্ট বিধানের কারণে মূর্তি বা ভাস্কর্য নির্মাণ, সংগ্রহ, সংরক্ষণ ইত্যাদি সব বিষয়ের অবৈধতার ওপর গোটা মুসলিম উম্মাহর ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

লেখক : পরিচালক, জামিয়া শায়খ আরশাদ মাদানী বাংলাদেশ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads