• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

মানবতার নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)

  • প্রকাশিত ১২ জানুয়ারি ২০২১

উবায়দুল হক খান

 

জাহেলিয়াতের চরম অন্ধকার যখন পৃথিবীকে গ্রাস করে বসেছিল, সেই চরম দুর্দিনে হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশ্বশান্তির বার্তা নিয়ে দুনিয়ায় এসেছেন। তখন মানুষ হয়ে পড়েছিল সৃষ্টির দাসত্বে বন্দি। নারীজাতি ও দাস-দাসিরা ছিল চরমভাবে নিপীড়িত। কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দেওয়ার মতো জঘন্য অপরাধ করতেও হূদয়হীন মা-বাবা কুণ্ঠিত হতো না। মানবতা ও মনুষ্যত্ব বলতে কিছুই তখন অবশিষ্ট ছিল না। অনিয়ম, হানাহানি, সন্ত্রাস, কুসংস্কার ও শোষণ-নিপীড়নে গোটা মানবসভ্যতা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হেদায়াত ও সংস্কারের এক আলোকবর্তিকা নিয়ে মানবতার কাছে উপস্থিত হন। হেরার যে আলোকরশ্মি তিনি আল্লাহর কাছ থেকে ধারণ করলেন, তার মাধ্যমেই তিনি মহান এক সভ্যতা বিশ্বের মানুষের কাছে উপস্থাপন করেন। অন্ধকারময় আরবে মানবতা ছিল বন্দি। সমাজে মানবাধিকারের লেশমাত্র ছিল না। এ অবস্থা থেকে মানবতাকে বাঁচাতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমাজের সব পর্যায়ে মানবাধিকারের এমন এক নমুনা পেশ করেন, যা আজো জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে গোটা বিশ্বের কাছে অনন্য হিসেবে স্বীকৃত।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শ্রেণি ও বংশগত বৈষম্যের অবসান ঘটান। চাকর-বাকর ও দাসরা এতদিন যে নীচ বলে পরিগণিত হতো, তাদের সঠিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বিশ্বমানবতার মুক্তির প্রতীক ও সত্য-সুন্দরের বার্তাবাহক। তাঁর আদর্শ ও চারিত্রিক মাধুর্যের কারণে বর্বর আরবজাতি একটি সুমহান জাতিতে পরিণত হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে আদর্শ সমাজ গড়ে তোলেন। বংশ কৌলীন্য ও আভিজাত্যের গৌরবের পরিবর্তে মানবতার ভিত্তিতে সমাজ বন্ধন সুদৃঢ় করেন। বিশ্ব ইতিহাসে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই সর্বপ্রথম দাসপ্রথার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। প্রাক-ইসলামী যুগে পৃথিবীর কোথাও নারীর সামাজিক মর্যাদা ছিল না। তারা ছিল অবহেলার পাত্র ও সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। তাদের অপবিত্র মনে করা হতো। পৃথিবীর ইতিহাসে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই সর্বপ্রথম নারীজাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।

মহানবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন মানবজাতির অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় মহান উদার, বিনয়ী ও নম্র ব্যক্তিত্ব। তিনি উত্তম চরিত্র ও মহানুভবতার একমাত্র আধার। পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, প্রতিবেশী সবার অকৃত্রিম শিক্ষণীয় আদর্শ ও প্রাণপ্রিয় ব্যক্তিত্ব নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একাধারে সমাজসংস্কারক, ন্যায়বিচারক, সাহসী যোদ্ধা, দক্ষ প্রশাসক, যোগ্য রাষ্ট্রনায়ক এবং সফল ধর্মপ্রচারক। কল্যাণকর প্রতিটি কাজেই তিনি সর্বোত্তম আদর্শ। তাঁর অসাধারণ চারিত্রিক মাধুর্য ও অনুপম ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি দিয়ে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে-‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সুরা আহযাব, আয়াত-২১)

তিনি অবিস্মরণীয় ক্ষমা, মহানুভবতা, বিনয়-নম্রতা, সত্যনিষ্ঠতা প্রভৃতি বিরল চারিত্রিক মাধুর্য দিয়েই বর্বর আরবজাতির আস্থাভাজন হতে সক্ষম হয়েছিলেন। যে কারণে তারা তাঁকে ‘আল আমীন’ বা বিশ্বস্ত উপাধিতে ভূষিত করেছিল। তিনি যে বিনয়-নম্র ও সৎচরিত্রের অধিকারী ছিলেন, তা তারা একবাক্যে অকপটে স্বীকার করেছে। দুনিয়ার মানুষকে অর্থের দ্বারা বশীভূত না করে; বরং তাদের সদাচরণ, উত্তম ব্যবহার এবং সততার দ্বারা বশীভূত করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর চারিত্রিক গুণাবলি সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘নিশ্চয় তুমি সুমহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।’ (সুরা কলম, আযাত-৪)

 

কখনো তিনি মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান ও হেয়প্রতিপন্ন করেননি বা নগণ্য ভাবেননি। জাতি, ধর্ম-বর্ণ, দল-মত নির্বিশেষে সব মানুষের সঙ্গে সদাচরণ করে পৃথিবীর বুকে শ্রেষ্ঠতর স্বভাব-চরিত্রের অতুলনীয় আদর্শ স্থাপন করেছেন। তাঁর স্বভাব-চরিত্রের মধ্যে বিনয় ও নম্রতা ছিল সদাজাগ্রত। সর্বোত্তম আদর্শের বাস্তবায়নকারী ও প্রশিক্ষক হিসেবেই তাঁকে বিশ্বমানবতার কল্যাণের জন্য পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছিল। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-‘আমি উত্তম চরিত্রের পরিপূর্ণতা সাধনের জন্যই প্রেরিত হয়েছি।’ (মুসনাদে আহমাদ)

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে-‘তোমাদের যা বিপন্ন করে তা তাঁর [মহানবীর] জন্য কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, ঈমানদারদের প্রতি স্নেহশীল ও দয়াময়।’ (সুরা তাওবা, আয়াত-১২৮) আয়াতের এ অংশে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চারটি গুণ বর্ণনা করা হয়েছে-

এক. মানুষের দুঃখ-কষ্ট তাঁর কাছে দুঃসহ। মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন ক্ষতি তাঁকে পীড়া দেয়। বিধিবিধান পালনে যেন মানুষের কষ্ট না হয় সেদিকে সব সময় তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকত। হাদিস শরিফে এসেছে-‘আমি বক্রতাবিহীন সহজ ধর্ম নিয়ে এসেছি।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং-২১০৮)

দুই. তিনি মানুষের মঙ্গলকামী। মানুষের হেদায়াতের ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহী। মানবতার মুক্তির ব্যাপারে তাঁর প্রচেষ্টার অন্ত নেই। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-‘যেসব বিষয় তোমাদের জান্নাতে পৌঁছে দেবে আর যা তোমাদের জাহান্নাম থেকে দূরে সরিয়ে দেবে, তার সবই আমি তোমাদের কাছে বর্ণনা করে দিয়েছি।’(মুসনাদে আহমাদ: ৫/১৫৩)

তিন ও চার নাম্বার গুণ হলো-তিনি ঈমানদারের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল ও করুণাময়। উম্মতের প্রতি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দয়া ও অনুগ্রহ বোঝাতে আল্লাহ ‘রউফ’ ও ‘রহিম’ শব্দদ্বয় ব্যবহার করেছেন। এই দুটি শব্দ আল্লাহর করুণা বোঝাতে ব্যবহূত হয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাড়া আল্লাহ এই দুটি শব্দ আর কারো জন্য ব্যবহার করেননি।’ (তাফসিরে মুনির)

 

লেখক : মুহাদ্দিস ও শিক্ষাসচিব, জামিআতুস সুফফাহ আল ইসলামিয়া গাজীপুর

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads