• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

চিকিৎসা বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান

  • প্রকাশিত ১৯ জানুয়ারি ২০২১

তারেক সাঈদ

 

 

মানুষ সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই চিকিৎসাশাস্ত্রের সূচনা। মানবজীবনের সাথে এই চিকিৎসার একটা প্রাকৃতিক যোগ। যেমন, চিকিৎসা ছাড়া মানুষ অসাড়। আর মানুষ অসাড় তো পৃথিবী, জীবনযাপন সবই যেন ভিত্তিহীন। সুস্থ মানুষ থাকলে সুস্থ পৃথিবী গড়ে উঠবে, সুস্থ পৃথিবীর দ্বারা পরিচালিত হবে নির্মল জীবনাচার। তাই প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ রোগ নিরাময়ের জন্য বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করে আসছে। সভ্যতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা পদ্ধতিতেও লক্ষ করা গেছে ব্যাপক পরিবর্তন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই পরিবর্তনে মুসলমানদের অবদান অতুলনীয়। যাদের আবিষ্কারের সূত্র ধরেই বর্তমান চিকিৎসাবিজ্ঞান এগিয়েছে, হয়েছে আধুনিক। বলা যেতে পারে তাদের মৌলিক আবিষ্কারের ওপর ভিত্তি করে বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞান এগিয়েছে অনেক দূর। আর তার সুফল ভোগ করছে আজকের বিশ্ববাসী। চিকিৎসা বিজ্ঞানে মুসলমানদের যে অবদান রয়েছে, তা আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় এক অনন্য অধ্যায়। এটাকে অবজ্ঞা করা মানেই সভ্যতার ইতিহাসকে অস্বীকার করা। মানব সৃষ্টির পর থেকে তাদের অন্ন, বস্ত্র সংগ্রহ করা যতটা তাদের প্রয়োজন ছিল ততটাই প্রয়োজন ছিল চিকিৎসার। প্রথম সুস্থতার তাড়নায় নিজেরা আবিষ্কার করে ঝাড়-ফুঁকের বিষয়টি। অতঃপর ধীরে ধীরে গাছের লতাপাতা, ফুলফল, খোসা ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করে বনজ ঔষধ, যা এখনো বিদ্যমান।

ইতিহাসবিদ আল কিফতি তাঁর ‘তারিখুল হুকামাত’-এ লিখেছেন, ‘হজরত ইদ্রিস (আ.) হলেন প্রথম চিকিৎসাবিজ্ঞানী। এ বিষয়ে তাঁর কাছে ওহি আসে।’ তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রকে একটি পর্যায়ে নিয়ে এসে পরিপূরক গোছালো রূপ দেন। ইসলামের নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা বিজ্ঞানী। আর তার নিকট মহান আল্লাহ প্রদত্ত যে কোরআন করিম নাজিল হয়েছে সেটা হলো শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা শাস্ত্র। চিকিৎসাশাস্ত্রে কোরআনের অবদান উল্লেখ করতে গিয়ে জার্মান পণ্ডিত ড. কার্ল অপিতজি তাঁর ‘Die Midizin Im Koran’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে কোরআনের ১১৪টি সুরার মধ্যে ৯৭টি সুরার ৩৫৫টি আয়াত চিকিৎসাবিজ্ঞান-সংশ্লিষ্ট। ৩৫৫টি আয়াতে মানবদেহের সব বিষয়ের সুষ্ঠু সমাধান দেওয়া হয়েছে। হাদিসের শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থ বুখারি শরিফে ‘তিব্বুন নববি’ শীর্ষক অধ্যায়ে ৮০টি পরিচ্ছেদ রয়েছে। প্রতিটি পরিচ্ছেদের অধীনে হাদিস রয়েছে কয়েকটি করে। সব হাদিসই রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি, রোগ নিরাময় ও রোগ প্রতিরোধ কার্যাবলি সংবলিত। আর তা তিনি নিজ হাতে শিক্ষা দিয়েছেন সঙ্গীদের।

Prof. Brown বলেন, ‘নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চিকিৎসাবিজ্ঞানকে ধর্মের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছেন।’ রোগ নিরাময়ের ব্যবস্থা হিসেবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মোটামুটি পাঁচটি পদ্ধতি ব্যবহারের উল্লেখ করেছেন : ১. হাজামাত বা রক্তমোক্ষত পদ্ধতি। ২. লোলুদ বা মুখ দিয়ে ওষুধ ব্যবহার। ৩. সা’উত বা নাক দিয়ে ওষুধ ব্যবহার। ৪. মাসী’ঈ বা পেটের বিশোধনের জন্য ওষুধ ব্যবহার। ৫. কাওয়াই অর্থাৎ পেটের চিকিৎসায় ওষুধ ব্যবহার। আর ওষুধ হিসেবে তিনি ব্যবহার করেছেন মধু, কালিজিরা, সামুদ্রিক কুন্তা বা বুড়, খেজুর, মান্না বা ব্যাঙের ছাতার মতো এক প্রকার উদ্ভিদ, উটের দুধ প্রভৃতি। (সূত্র : বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান, মোহাম্মদ রহুল আমিন, পৃষ্ঠা ৬০)

প্রথম হাসপাতাল : রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবদ্দশায় বিশেষত যুদ্ধকালীন সময়ে যে ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন সে ধারণাকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তীতে মুসলিম শাসকগণ স্থায়ী চিকিৎসাকেন্দ্র তথা হাসপাতাল গড়ে তোলেন। খলিফা ওয়ালিদ ইবনে মালিকের শাসনামলে প্রথম স্থায়ী হাসপাতাল তৈরি করা হয়। ধর্ম-বর্ণ ভেদে সবাই সেখানে চিকিৎসা পেত। রোগভেদে ছিল আলাদা ওয়ার্ড ব্যবস্থা। মুসলিম সালতানাতে প্রতিষ্ঠিত তৎকালীন হাসপাতালের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, সিরিয়ার দামেস্ক শহরের আল-নুরী হাসপাতাল, জেরুজালেমের আল সালহানি, বাগদাদের আল-সাইয়িদাহ, আল-মুক্তির আদুদি হাসপাতাল, কায়রোর আল মানসুরি হাসপাতাল। আফ্রিকার মরক্কো ও তিউনিসে আল-মারওয়ান, মারাবেশ হাসপাতাল ইত্যাদি। মানব সভ্যতার যে জয়যাত্রা আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি, তা রাতারাতি সম্ভব হয়নি। এর নেপথ্যে আছে হাজারো মানুষের ঘাম ও শ্রম। আর সেই মানুষগুলো ছিল ইসলামী শাসনামলের দক্ষ জনশক্তি। তাদের অধ্যবসায় আর অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে পৃথিবীর এই আধুনিকায়ন। নবম থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ছিল মুসলিম মনীষীদের চিকিৎসাবিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনের স্বর্ণযুগ। নবম শতাব্দী থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত যেসব ইসলামী মনীষী চিকিৎসা বিজ্ঞানে অতুলনীয় অবদান রাখেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হলো।

ইবনে সিনা : পুরো নাম আবু আলী আল হুসাইন ইবনে সিনা। এ শতাব্দীতে চিকিৎসা বিজ্ঞানে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখেন তিনি। বর্তমানে উজবেকিস্তানের রাজধানী বুখারার কাছে (৯৮০-১০৩৭) জন্মগ্রহণ করেন। ইউরোপে আভিসিনা নামে পরিচিত। ইসলামের অন্যতম এ চিকিৎসাবিজ্ঞানী পুরো বিশ্বে চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক বলে সুপরিচিত। তিনি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম সেরা চিকিৎসক, গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও দার্শনিক। তাকে একই সঙ্গে ইরান, তুরস্ক, আফগানিস্তান ও রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা তাদের জাতীয় জ্ঞানবীর হিসেবে দাবি করেন। ইবনে সিনা আজ থেকে হাজার বছর আগে ক্যানসারের চিকিৎসায় যে ধারণা দিয়েছিলেন তার প্রয়োগ আজো চলছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ওপর তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আল কানুন ফিত তিব’ আরবজগৎ থেকে আনীত সর্বাধিক প্রভাবশালী গ্রন্থ। একে চিকিৎসাশাস্ত্রের বাইবেল বলা হয়।

আল রাজি : মুসলিম চিকিৎসাবিদদের মধ্যে আবু বকর মোহাম্মদ বিন জাকারিয়া আল-রাজি (৮৬২-৯২৫) ছিলেন, মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একজন চিকিৎসাবিদ। ইরানের রাজধানী তেহরানের ‘রে’ নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন, আরবীয় চিকিৎসাশাস্ত্রের এই দিকপাল। চিকিৎবিজ্ঞানে আল-রাজির অবদান অবিস্মরণীয়। দুই শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন তিনি। এর অর্ধেকই ছিল চিকিৎসাশাস্ত্র সম্পর্কীয়।

ইবনে রুশদ (১১২৬-১১৯৮) : মুসলিমদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও পণ্ডিত হিসেবে ইবনে রুশদের নাম ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করছে। রেনেসাঁর যুগে ইউরোপে তার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। স্পেনের কর্দোভায় এক সম্ভ্রান্ত ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ইবনে রুশদ। ইবনে রুশদের পুরো নাম আবু আল ওয়ালিদ মোহাম্মদ ইবনে আহমাদ ইবনে রুশদ। তবে পশ্চিমা বিশ্বে তিনি পরিচিত ‘অ্যাভেরোস’ নামে। তার রচিত অসাধারণ গ্রন্থ ‘কিতাব আল কুলিয়াত ফি আল তিব্ব’। সমগ্র ইউরোপ এবং আরব বিশ্বে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান পাঠ্যবই ছিল। এতে রয়েছে চিকিৎসাশাস্ত্রের তিনটি মৌল বিষয়। রোগ বিশ্লেষণ (ডায়াগনোসিস), নিরাময় (কিউরি) এবং প্রতিরোধ (প্রিভেনশন)।

আলী আত-তাবারি : আলী আত তাবারি (৮৩৯-৯২০) ছিলেন মুসলিম খলিফা মুতাওয়াক্কিলের গৃহচিকিৎসক। তিনি খলিফার পৃষ্ঠপোষকতায় ‘ফেরদৌস উল হিকমা’ নামে একখানা বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থে শুধু চিকিৎসাশাস্ত্রই নয়, দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, প্রাণিবিদ্যা সম্পর্কেও আলোচিত হয়েছে। এটি গ্রিক, ইরানি ও ভারতীয় শাস্ত্রের ওপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে।

আলী আল মাওসুলি : চক্ষু চিকিৎসায় মুসলমানদের মৌলিক আবিষ্কার রয়েছে। আলী আল মাওসুলি চোখের ছানি অপারেশনে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। জর্জ সার্টনও তাকে জগতের সর্বপ্রথম মুসলিম চক্ষু চিকিৎসক বলে অকপটে স্বীকার করেছেন। তার ‘তাজকিরাতুল কাহহালিন’ চক্ষু চিকিৎসায় সবচেয়ে দুর্লভ ও মূল্যবান গ্রন্থ। এছাড়া চিকিৎসাশাস্ত্রে হাসান ইবনে হাইসাম, আলবেরুনি, আলী ইবনে রাব্বান, হুনাইন ইবনে ইসহাক, আবুল কাসেম জাহরাবি, জুহান্না বিন মাসওয়াই, সিনান বিন সাবিত, সাবিত ইবনে কুরা, জাবির ইবনে হাইয়ান প্রমুখও উল্লেখযোগ্য। এসব মুসলিম বিজ্ঞানী পার্থিব জীবনে বিশেষ কোনো খ্যাতির জন্য নয় বরং মানুষের সেবায় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে তাদের জীবনটা চিকিৎসা শাস্ত্রে ব্যয় করে গেছেন তারা। আল্লাহতায়ালা এই মহান মনীষীদের তার রহমতের চাদরে আবৃত করুন! আমীন।

 

 লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads