• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

রাসুল (সা.)-এর সুন্নাত অনুসরণেই রয়েছে সফলতা

  • প্রকাশিত ২১ জানুয়ারি ২০২১

মাওলানা মুহাম্মদ মুনিরুল হাছান

 

 

 

আল-কোরআন ইসলামী শরিয়তের প্রথম ও প্রধান উৎস। এর পরে হলো সুন্নাহর স্থান। আল-কোরআনকে বলা হয় প্রদীপের স্তম্ভ। আর সুন্নাহ হলো তার বিচ্ছুরিত আলো। সুন্নাহ অর্থ হলো নিয়ম, রীতি নীতি, অভ্যাস, চলার রাস্তা বা পথ। সুন্নাহকে হাদিস নামেও অভিহিত করা হয়। ইসলামী পরিভাষায় সুন্নাহ হলো রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা, কাজ ও সম্মতি যা নবীজির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহতায়ালা জগদ্বাসীর জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় জীবন ব্যবস্থার মডেল হিসেবে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের জীবনে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সুরা আল-আহযাব-৭)।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাজগুলো ছিল দুই ধরনের। প্রথম কাজগুলো উম্মতের জন্য ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত, মুস্তাহাব, হালাল-হারাম শিরোনামে প্রচলিত রয়েছে। দ্বিতীয় কিছু আমল রয়েছে যা শুধু প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একান্ত ব্যক্তিগত আমল হিসেবে স্বীকৃত ও বিবেচিত। এই আমলগুলো উম্মতের অনুসরণের অনুমোদন নেই। যেমন সাওমে বেচাল (খাবার-পানাহারবিহীন লাগাতার দিনের পর দিন রোজা রাখা)। চারজনের অধিক স্ত্রী একসঙ্গে রাখা ইত্যাদি। সুতরাং উপরোক্ত উভয় প্রকারের কাজগুলোকে হাদিস বলা হলেও কেবল প্রথমোক্ত কাজগুলোই সুন্নাহ হিসেবে বিবেচিত। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘রাসুল তোমাদের যা দেন তা তোমরা গ্রহণ কর আর তোমাদের যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক। (সুরা হাশর-৭)। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উক্ত আয়াতটির বিধান অনুসরণ করে চলতেন। অর্থাৎ তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিটি আদেশ নিষেধকে কোরআনের অনুরূপ আদেশ-নিষেধ হিসেবে পালন করতেন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহের ওপর অনুসরণের মধ্যে মানুষের হেদায়াত ও উত্তম পরিণতি পাওয়া নির্ভরশীল। আল্লাহতায়ালা বলেন, হে ইমানদারগণ, আল্লাহর নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য করো রাসুলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তাদের। তারপর যদি তোমরা কোনো বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড় তাহলে তা আল্লাহ ও তার রাসুলের প্রতি প্রত্যার্পণ করো, যদি তোমরা আল্লাহ ও কেয়ামত দিবসের ওপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম। (সুরা নিসা-৫৯)। কোরআনের বর্ণনা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে হলে সুন্নাহর সাহায্য নেওয়া অপরিহার্য। কেননা সুন্নাহ ও হাদিস হলো কোরআনের ব্যাখ্যাস্বরূপ। কার্যত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যে-কোনো কথা বা কাজ বর্ণিত হয়েছে মানবজাতির প্রতি তার সকল কিছুই কোরআনের মতোই নির্দেশনা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এবং আপনার কাছে আমি স্মরণিকা অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি লোকদের সামনে এইসব বিষয় বিবৃত করেন, যেগুলো তাদের প্রতি নাজিল করা হয়েছে। যাতে তারা চিন্তাভাবনা করে। (সুরা আন-নাহাল :৪৪)।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বিভিন্ন হুকুম আহকামের বর্ণনা পেশ করেছেন। যেমন নামাজ, জাকাত, হজ, রোজা ইত্যাদি। কিন্তু নামাজ কীভাবে আদায় করা হবে? কোন কোন সময়ে আদায় করা হবে এসব বর্ণনা কোরআন শরিফে নেই। এগুলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস তথা সুন্নাহর মধ্যে বিদ্যামান রয়েছে। অনুরূপভাবে জাকাত কীভাবে আদায় করতে হবে? জাকাত সারাজীবনে একবার আদায় করতে হবে কি না? নাকি প্রতি বছরে বা মাসে আদায় করতে হবে? হজ কী প্রতি বছর নাকি জীবনে একবার আদায় করতে হবে? এ সমস্ত কিছুর বিশদ বর্ণনা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসের মধ্যেই বিদ্যমান রয়েছে।

দশম হিজরিতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লক্ষাধিক সাহাবাদের নিয়ে বিদায় হজ পালন করেন। এতে তিনি আরাফাতের ময়দানে পাশে জাবালে রহমত নামাক পাহাড়ে উঠে তিনি ঘোষণা করলেন। আমি তোমাদের মধ্যে দুটি জিনিস রেখে গেলাম। যতক্ষণ এ দুটিকে শক্তভাবে আকঁড়ে থাকবে কখনো গোমরাহ হবে না। তা হলো আল্লাহর কিতাব ও তার নবীর সুন্নাত। (মোস্তাদরাকে হাকিম, কানযুল উম্মাল ১ম খণ্ড পৃষ্ঠা : ১৮৭)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উম্মতদের জন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ হেদায়াতের দিশারি রেখে যাওয়ার মধ্যে সুদূরপ্রসারী ইঙ্গিত রয়েছে। কেননা ইসলামের নামে বেনামে অনেক ফেতনা সেই আদিকাল থেকেই সূচনা হয়েছিল। কিয়ামতের পূর্বে এই ফেতনা আরো ব্যাপকভাবে দেখা দেবে। যার সম্পর্কে প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতদের সতর্ক করেছেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, শেষ যমানায় কিছু সংখ্যক দাজ্জালের আবির্ভাব হবে। তারা তোমাদের নিকট এমন সব অলীক (মনগড়া) কথাবার্তা নিয়ে আসবে, যেগুলো না তোমরা শুনেছ না তোমাদের বাপ দাদারা শুনেছে। সাবধান তোমরা তাহাদের সংশ্রব থেকে দূরে থাকবে, যাতে তারা তোমাদেরকে গোমরাহ করতে কিংবা বিপদে ফেলতে না পারে। (সহিহ মুসলিম)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোনো ব্যক্তিই পূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না যে পর্যন্ত না এর প্রবৃত্তি ওই জিনিসের অধীনে হবে যা আমি আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে দিন ও শরিয়ত হিসেবে এনেছি। (মিশকাত, বাবুল ইতেসাম বিল কিতাব ওয়াস সুন্নাহ)।

প্রিয়নবীর পূর্ণ আনুগত্য এবং সুন্নাতে রাসুলের অনুসরণ ছাড়া জান্নাতে যাওয়া যাবে না। যদিও আগে পরে প্রত্যেক ঈমানদার জান্নাতে প্রবেশ করবে শুধুমাত্র প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অস্বীকার না করে আনুগত্য প্রকাশের কারণে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যারা আমাকে অস্বীকার করে তারা ব্যতীত আমার উম্মতের সকলেই জান্নাতে প্রবেশ করবে। সাহাবাগণ জিজ্ঞাসা করল, কে আপনাকে অস্বীকার করে? তিনি বললেন, যে আমার আনুগত্য স্বীকার করেছে সে জান্নাতে যাবে। আর যে ব্যক্তি আমাকে অস্বীকার বা অমান্য করেছে সে জান্নাতে যাওয়াকে অস্বীকার করেছে। (সহিহ বুখারি)। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘বলুন, আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসুলের আনুগত্য কর। অতঃপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে রাসুলের দায়িত্বে তাই রয়েছে, যা তার ওপর অপরিহার্য করা হয়েছে এবং তোমাদের ওপর তাই রয়েছে, যার ভার তোমাদের ওপর অর্পিত হয়েছে। যদি রাসুলের আনুগত্য কর তবে সৎপথ পাবে। রাসুলের দায়িত্ব তো কেবল সুস্পষ্টভাবে পৌঁছে দেওয়া । (সুরা আল-নুর-৫৪)।

আল্লাহতায়ালা পূর্বে অনেকগুলো আসমানি কিতাব নাজিল করেছেন। প্রতিটি কিতাব বা সহিফা স্ব-স্ব গোত্রের জন্য হেদায়তের উৎস। কিন্তু কোরআন মাজিদ নাজিলের পর আর কোনো আসমানি কিতাবের অনুসরণ গ্রহণযোগ্য হবে না। একমাত্র কোরআন ও নবীজির সুন্নাতই হলো মুক্তির উপায়। হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত- একদিন হজরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) তাওরাতের একটি কপি নিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে হাজির হলেন। তিনি নিবেদন করলেন ইয়া রাসুলুল্লাহ! এটা তাওরাতের একটি নুসখা। রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিশ্চুপ রইলেন। হজরত উমর (রা.) তা পড়া শুরু করলেন আর রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা মোবারক পরিবর্তন হতে লাগল। হজরত উমর (রা.) পড়তে থাকেন কিন্তু হুজুরের চেহারা মোবারকের পরিবর্তন লক্ষ করেননি। হজরত আবু বকর (রা.) হজরত উমর (রা.)-কে ধমক দিয়ে বললেন, তোমার অমঙ্গল হোক। দেখছো না রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা মোবারক! তখন হজরত উমর (রা.) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা মোবারকের প্রতি দৃষ্টিপাত করে তৎক্ষণাৎ বললেন, আমি আল্লাহ ও তার রাসুলের ক্রোধ থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই। আমি (মনে-প্রাণে) সন্তুষ্ট আল্লাহকে নিজের রব মেনে, আর ইসলামকে নিজের দিন বানিয়ে এবং হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী ও রাসুল মেনে। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সেই আল্লাহর শপথ, যার হাতে মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রাণ। যদি মুসা (আ.) তোমাদের সামনে আসেন আর তোমরা আমাকে ছেড়ে তার অনুসরণ কর তবে সত্য ও সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গোমরা হয়ে যাবে। আর যদি হজরত মুসা (আ.) জীবিত থাকতেন এবং আমার নবুয়তি যুগ পেতেন তবে তিনিও আমার অনুসরণ করতেন (মুসনাদে দারেমি)।

 

লেখক : সহকারী শিক্ষক, ইসলাম শিক্ষা, চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads