• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
জুমাবার সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন

সংগৃহীত ছবি

ধর্ম

জুমাবার সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন

  • প্রকাশিত ২২ জানুয়ারি ২০২১

আজ শুক্রবার। অন্যতম একটি দিন। এ দিনে রয়েছে ইসলামের বিশেষ এক নামাজ। জুমার নামাজ। জুমা শব্দটি আরবী। অর্থ একত্রিত হওয়া, সম্মিলিত হওয়া, কাতারবদ্ধ হওয়া ইত্যাদি। যেহেতু সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিন শুক্রবারে প্রাপ্তবয়স্ক মুমিন-মুসলমান একটি নির্দিষ্ট সময়ে একই স্থানে একত্রিত হয়ে জামাতের সাথে জোহরের নামাজের পরিবর্তে এই নামাজ ফরজরূপে আদায় করা হয়, সে জন্য এই নামাজকে ‘জুমার নামাজ’ বলা হয়। আর জুমাবার হলো সাপ্তাহিক ঈদের দিন। সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন। ইসলামে এ দিনটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনেক। প্রথম হিজরিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা ছেড়ে মদিনা গেলেন। নবী (সা.) এর মদিনায় পৌঁছার দিনটি ছিল ইয়াওমুল আরুবা (শুক্রবার)। সেদিন তিনি বনি সালেম গোত্রের উপত্যকায় গেলে জোহর নামাজের সময় হয়। সেখানে তিনি জোহর নামাজের পরিবর্তে জুমার নামাজ আদায় করেন। এটাই ইতিহাসের প্রথম জুমার নামাজ।

জুমার দিন ও জুমার নামাজের গুরুত্ব স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনও কোরআনে তুলে ধরেছেন। জুমার নামাজ আদায়ের ব্যাপারে ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! জুমার দিনে যখন নামাজের আজান দেওয়া হয়, তোমরা আল্লাহর স্মরণে দ্রুত চলো এবং বেচাকেনা বন্ধ করো। এটা তোমাদের জন্যে উত্তম যদি তোমরা বুঝ। অতঃপর নামাজ শেষ হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ খোঁজ করো ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’  (সুরা জুমা, আয়াত-৯, ১০) হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে অজু করল, অতঃপর জুমা পড়তে এলো এবং মনোযোগ সহকারে নীরব থেকে খুতবাহ শুনল, সে ব্যক্তির এই জুমা ও (আগামী) জুমার মধ্যেকার এবং অতিরিক্ত আরো তিন দিনের (ছোট) পাপসমূহ মাফ করে দেওয়া হলো। আর যে ব্যক্তি (খুতবাহ চলাকালীন সময়ে) কাঁকর স্পর্শ করল, সে অনর্থক কাজ করল। [অর্থাৎ সে জুমার সওয়াব ধ্বংস করে দিল।(মুসলিম, তিরমিযি, আবু দাউদ)

শুক্রবার জুমার নামাজকে ফরজ করা হয়েছে। জুমার দুই রাকাত ফরজ নামাজ ও ইমামের খুতবাকে জোহরের চার রাকাত ফরজ নামাজের স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। হজরত তারেক ইবনে শিহাব (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘ক্রীতদাস, মহিলা, নাবালেগ বাচ্চা ও অসুস্থ ব্যক্তি এই চার প্রকার মানুষ ছাড়া সব মুসলমানের ওপর জুমার নামাজ জামাতে আদায় করা অপরিহার্য কর্তব্য।’ (আবু দাউদ, হাদিস নং-১০৬৭, মুসতাদরেকে হাকেম, হাদিস নং-১০৬২, আস্-সুনানুল কাবীর, হাদিস নং-৫৫৮৭) হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে বলা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো শরিয়তসম্মত কারণ ছাড়া জুমার নামাজ বর্জন করবে, তার নাম মুনাফিক হিসেবে এমন দপ্তরে লিপিবদ্ধ হবে, যা মুছে ফেলা হবে না এবং পরিবর্তনও করা যাবে না।’ (তাফসিরে মাজহারি, খণ্ড-৯, পৃষ্ঠা-২৮৩) হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এ মর্মে হাদিস বর্ণনা করেছেন যে, যে লোক জুমার নামাজ থেকে দূরে থাকে (পড়ে না) তাদের সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমার ইচ্ছা হয় যে আমি কাউকে নামাজ পড়ানোর আদেশ করি, সে মানুষকে নামাজ পড়াক। অতঃপর যেসব লোক জুমার নামাজ পড়ে না, আমি তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিই।’ (মুসলিম, হাদিস নং-৬৫২, মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং-৩৮১৬)

জুমার দিনের নিষিদ্ধ কাজ : জুমার দিনে মূলত আজানের পর থেকে নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত সময়টিতে কিছু ফরজ বিধান রয়েছে। এ সময়টিতে কিছু বিধান মেনে চলতে হবে। শরীয়ত বর্হিভূত কোনো কাজ করা যাবে না। যেমন আজান হয়ে যাওয়ার পরও ব্যবসা বা অনর্থক কাজে ব্যস্ত থাকা। উপস্থিত মুসল্লিদের জন্য খুতবা শ্রবণ করা ওয়াজিব। তাই খুতবা চলাকালে নিরর্থক কাজে লিপ্ত থাকা শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ নয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘জুমার দিন খুতবা প্রদানের সময় যদি তুমি তোমার সঙ্গীকে বলো, চুপ করো তখন তুমি অনর্থক কথাই বললে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-১/১২৮) বর্ণিত হাদিসের মাধ্যমে সুদৃঢ়ভাবে প্রমাণ হয়, খুতবার সময় নিশ্চুপ হয়ে খুতবা শ্রবণ করা ওয়াজিব এবং কথাবার্তা বলা হারাম। অনুরূপ খুতবার সময় সুন্নত-নফল নামাজ পড়াও বৈধ নয়। অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, যখন ইমাম খুতবার জন্য বের হবেন, তখন নামাজ পড়বে না, কথাও বলবে না। (মেশকাত, হাদিস নং-৩/৪৩২) ফিকহশাস্ত্রের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ ফাতাওয়ায়ে শামীতে একটি মূলনীতি উল্লেখ হয়েছে, যেসব কর্ম নামাজের মধ্যে হারাম, তা খুতবা চলাকালীন সময়ও হারাম। যেমন : কথাবার্তা বলা, পানাহার করা ইত্যাদি। (ফাতাওয়ায়ে শামী : ৩/৩৫)

জুমাবারের বিশেষ আমল : জুমার দিনের সীমাহীন ফজিলত রয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন হাদিসে এসব ফজিলতের কথা তুলে ধরেছেন। বুখারি শরিফের হাদিসে রয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কোনো পুরুষ যখন জুমার দিন গোসল করে, সাধ্যমতো পবিত্রতা অর্জন করে, তেল ব্যবহার করে বা ঘরে যে সুগন্ধি আছে তা ব্যবহার করে, তারপর (জুমার জন্য) বের হয় এবং (বসার জন্য) দুই জনকে আলাদা করে না, এরপর সাধ্যমতো নামাজ পড়ে এবং ইমাম যখন কথা বলে তখন চুপ থাকে, তাহলে অন্য জুমা পর্যন্ত তার (গুনাহ) মাফ করা হয়। হাদিসের ভিত্তিতে ফেকাহবিদরা এসব আমলকে নির্দিষ্ট করেছেন। যেমন, ১. জুমার দিন গোসল করা। ২. পরিচ্ছন্নতার অংশ হিসেবে সেদিন নখ ও চুলকাটা একটি ভালো কাজ। ৩. জুমার সালাতের জন্য সুগন্ধি ব্যবহার (বুখারি) ৪. মিস্ওয়াক করা। (ইবনে মাজাহ) ৫. গায়ে তেল ব্যবহার করা। (বুখারি) ৬. উত্তম পোশাক পরিধান করে জুমা আদায় করা।  (ইবনে মাজাহ) ৭. মুসল্লিদের ইমামের দিকে মুখ করে বসা। (তিরমিযি) ৮. পায়ে হেঁটে মসজিদে যাওয়া।  (আবু দাউদ) ৯. জুম্মার দিনও জুম্মার রাতে বেশি বেশি দুরুদ পাঠ।  (আবু দাউদ: ১০৪৭) ১০. এ দিন বেশি বেশি দোয়া করা। (বুখারি) ১১. মুসুল্লিদের ফাঁক করে মসজিদে সামনের দিকে এগিয়ে না যাওয়া।  (বুখারি) ১২. জুমার দিন সুরা কাহাফ পড়া। পাঠকারীর জন্য আল্লাহতায়ালা দুই জুমার মধ্যবর্তী সময়কে আলোকিত করে দেন।

জুমার দিন দোয়া কবুলের সময় : জুমাবারের ফজিলতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো, এই দিনে এমন একটা সময় আছে, যখন মুমিন বান্দা কোনো দোয়া করলে মহান আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জুমার দিনে একটা এমন সময় আছে, যে সময়ে কোনো মুমিন বান্দা আল্লাহর কাছে ভালো কোনো কিছু প্রার্থনা করলে, অবশ্যই আল্লাহ তাকে তা দান করবেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-৮৫২) জুমার দিনে দোয়া কবুল হওয়ার সে মহামূল্যবান সময় কোনটা? এ সম্পর্কে ৪৫টা মতামত পাওয়া যায়। তবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মত হলো, আসরের নামাজের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত দোয়া কবুলের সময়। হজরত আনাস (রা.) থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, জুমার দিনের কাঙ্ক্ষিত সময়টা হলো আসরের পর থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত। (মুসনাদে ইবনে আবি শাইবা : ৫৪৬০, তিরমিযি : ৪৮৯)

জুমার দিনের বিশেষ দরুদ শরিফের আমল : আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা জুমার দিনে বেশি বেশি দরুদ শরিফ পাঠ করো। কারণ জিবরাঈল আলাইহিস সালাম এইমাত্র আল্লাহতায়ালার বাণী নিয়ে উপস্থিত হলেন। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, পৃথিবীতে যখন কোনো মুসলমান আপনার ওপর একবার দরুদ পাঠ করে আমি তার ওপর দশবার রহমত নাজিল করি এবং আমার সব ফেরেশতা তার জন্য দশবার ইস্তেগফার করে। (তারগিব : ৩/২৯৯) হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমার ওপর দরুদ পাঠ করা পুলসিরাত পার হওয়ার সময় আলো হবে। যে ব্যক্তি জুমার দিন ৮০ বার দরুদ পড়ে তার ৮০ বছরের গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। অন্য রেওয়াতে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি জুমার দিন আসরের নামাজের পর নিজ স্থান থেকে ওঠার আগে ৮০ বার এই দরুদ শরিফ পাঠ করে, আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিনিন নাবিইয়্যিল উম্মিইয়ি ওয়া আলা আলিহি ওয়া আস হাবিহি ওয়াসাল্লিমু তাসলিমা। তার ৮০ বছরের পাপ ক্ষমা হয়ে যায় এবং ৮০ বছরের ইবাদতের সওয়াব তার আমলনামায় লেখা হয়। আল্লাহতায়ালা আমাদের জুমার দিনের আমলসমূহ সঠিক আদায় করার  তৌফিক দান করুক। আমিন!

লেখক : ডা. মাওলানা মাহতাব হোসাইন মাজেদ

এম এ কামিল  হাদিস, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া

সম্পাদক ও প্রকাশক,  দৈনিক স্বাস্থ্য তথ্য

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads