• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

হকের পথে বাধা আসলে করণীয় 

  • প্রকাশিত ২৪ জানুয়ারি ২০২১

মাওলানা মাহাথির মোবারক

 

 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘দুনিয়াটা মুমিনের জন্য জেলখানা আর কাফেরদের জন্য জান্নাত স্বরূপ।’ মুমিনের দুনিয়াবি জীবন সুখের নয়। বরং তা অতি কষ্টের। তার সামনে থাকে শত বাধার দুর্ভেদ্য প্রাচীর। তা জয় করে তাকে জান্নাতের পথে এগিয়ে যেতে হয়, বাঁচতে হয় জাহান্নাম থেকে। তাই দুনিয়াবি জীবনের শত বাধাবিঘ্নকে সে পেরিয়ে যায় হাসিমুখে। বরণ করে নেয় হাজারো নির্যাতন-নিপীড়ন। কারণ বাধার প্রাচীর ডিঙিয়ে তাকে লক্ষ্যপানে পৌঁছতেই হবে। এটাই তার সতত সাধনা ও একান্ত কামনা। ফলে দুনিয়াবি কোনো বাধাকে সে ভয় পায় না। মুষড়ে পড়ে না কোনো প্রতিকূল পরিবেশে। কারণ তার একমাত্র লক্ষ্য জান্নাত। দুনিয়াতে হকের পথে মুমিন যেসব বাধার সম্মুখীন হয় এবং সে অবস্থায় করণীয় কী. সে বিষয়ে আলোচনা করা হলো।

মুনাফিকদের অত্যাচার : সর্বপ্রথম মুমিনের সৎকাজে বাধা দিবে মুনাফিকরা। যেমনটি স্বয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালামের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। বিশ্বমানবতার দূত রাহমাতুল্লিল আলামিন বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম যখন দিনের দাওয়াত দিয়েছেন। ঠিক তখনই মুনাফিকদের পক্ষ থেকে হাজারো বাধা এসেছে। মুনাফিক হল ইসলামের গোপন শত্রু। তাদের দ্বারা ইসলাম যতোটুকু ক্ষতি হয়েছে অন্যান্য কাফের-মুশরিকদের থেকেও ততটুকু ক্ষতি হয়নি। রাসুলের জামানা থেকে নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত এমন কিছু মুনাফিক মুসলমান থাকবে যারা নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করবে ঠিকই কিন্তু গোপনে মুমিন ও ইসলামের বিপক্ষে কাজ করে যাবে। বেঈমানদের পক্ষে তারা লড়াই করে ইসলামকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিতে চায়বে। তাই মুনাফিক থেকে সাবধান। তাদের থেকে কখনো ভালো কিছুর আশা করিও না, যতক্ষণ না তারা মুমিন হয়।

কাফেরদের অত্যাচার: কোরআনে করিমে স্পষ্ট ভাষায় আল্লাহতায়ালা বলে দিয়েছেন ইহুদি-খ্রিস্টানরা তোমাদের বন্ধু নয় বরং তারা তোমাদের চরম শত্রু। অর্থাৎ তোমাদের প্রতিটি ভালো কাজে তারা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করবে। তোমাদের অকল্যাণ কামনা করবে। সুতরাং কখনো তাদের বন্ধু মনে করে তাদের সাথে অন্তরঙ্গ হওয়া যাবে না। বরং তাদের শত্রু জেনে তাদের থেকে দূরে থাকতে হবে। 

শয়তানের অত্যাচার : আজাজিল অর্থাৎ অভিশপ্ত শয়তান। সে আল্লাহতায়ালার কাছে ওয়াদাবদ্ধ হয়ে এসেছে মানুষের রগে রগে ঘোরাফেরা করবে এবং প্রত্যেকটি মানুষকে সে জাহান্নামের দরজায় পৌঁছে দেবে। যে-কোনো সৎকাজে সে বাধা দেবে। পরস্পরের মাঝে ঝগড়া ফাসাদ সৃষ্টি করবে। মানুষকে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল থেকে ফিরিয়ে দুনিয়ামুখী করতেই সে নিয়োজিত। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। শয়তানের কাছ থেকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

অহংকার : অহংকারের কারণে মানুষ হক গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। কল্যাণ লাভ থেকে সে বঞ্চিত হয়। আর অহংকার হলো সত্যকে অবজ্ঞা করা এবং মানুষকে তুচ্ছ মনে করা। মানব চরিত্রের দুষ্টক্ষত এই অহংকারের কারণে মানুষ হেদায়াতের আলো থেকে দূরে থাকে। হক থেকে বিচ্যুত হয়। আল্লাহ বলেন, ‘এ পৃথিবীতে যারা অন্যায়ভাবে অহংকার করে আমি তাদেরকে আমার আয়াতসমূহ থেকে ফিরিয়ে রাখব। তারা আমার সমস্ত আয়াত (নিদর্শন) দেখলেও তারা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করবে না। তারা হেদায়াতের পথ দেখলেও তারা সে পথে যাবে না। কিন্তু যদি ভ্রষ্টতার পথ দেখে তাহলে তারা সেটাই গ্রহণ করবে। এটা এ কারণে যে, তারা আমাদের আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করে এবং তারা এ থেকে উদাসীন।’ (সুরা আরাফ : ১৪৫)। অহংকার যে হক গ্রহণে বাধা দেয়, তার প্রথম উদাহরণ হলো ইবলিস। তাকে যখন বলা হলো আদমকে সিজদা কর, তখন সে অহংকার করল। আল্লাহ বলেন, ‘তখন ফেরেশতারা সবাই একযোগে সিজদা করল। ইবলিস ব্যতীত। সে অহংকার করল এবং কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। আল্লাহ বললেন, হে ইবীিস! আমি যাকে আমার দুহাত দিয়ে সৃষ্টি করেছি, তাকে সিজদা করতে তোমাকে কোনো বস্তু বাধা দিল? তুমি অহংকার করলে নাকি তুমি তার চাইতে বড়দের অন্তর্ভুক্ত? সে বলল, আমি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন, আর তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে’। (সুরা ছোয়াদ : ৭৩-৭৬)।

হিংসা-বিদ্বেষ : হিংসা-বিদ্বেষ মানুষকে দুনিয়াতে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত করে, তেমনি তার আমল নষ্ট করে দিয়ে তাকে পরকালে জাহান্নামি করে। মানুষ সাধারণত ভালোর প্রতি হিংসা করে থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তবে কি তারা লোকদের (মুসলমানদের) প্রতি এজন্য হিংসা করে যে, আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহ থেকে তাদের কিছু দান করেছেন। আর আমরা তো ইবরাহিমের বংশধরগণকে কিতাব ও হিকমত দান করেছিলাম এবং তাদের দান করেছিলাম বিশাল সাম্রাজ্য।’ (সুরা নিসা : ৫৪)।

কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ : প্রবৃত্তির অনুসরণ মানুষকে হক গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখে। এমনকি প্রবৃত্তির অনুসরণের ফলে অনেকে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। আল্লাহ বলেন, ‘এ বিষয়ে প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। তাহলে তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে।’ (সুরা ছোয়াদ : ২৬)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং যে ব্যক্তি কািমতে বিশ্বাস করে না ও নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, সে যেন তোমাকে উক্ত বিশ্বাস থেকে নিবৃত্ত না করে। তাহলে তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে।; (সুরা ত্বোয়াহা : ১৬)।

আল্লাহ ব্যতীত সৃষ্টিকে আঁকড়ে ধরা : আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে বাদ দিয়ে কোন মানুষকে কিংবা পূর্ব পুরুষকে আঁকড়ে ধরা বা তাদের আচার-আচরণের অনুসারী হলে হক থেকে বিচ্যুত হতে হয়। কারণ মানুষের স্রষ্টা ও নিয়ন্তা হিসাবে আল্লাহপাক কল্যাণের পথ প্রদর্শন করেন তাঁর নবী-রাসুলের মাধ্যমে। সুতরাং কেউ আল্লাহকে বাদ দিয়ে কোন সৃষ্টিকে আঁকড়ে ধরলে অবশ্যই পথভ্রষ্ট হবে। আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন তাদের বলা হয়, তোমরা আল্লাহ যা নাজিল করেছেন সেদিকে এবং রাসুলের দিকে এসো, তখন তারা বলে, আমাদের জন্য তাই-ই যথেষ্ট, যার ওপরে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছি। যদিও তাদের বাপ-দাদারা কোনো জ্ঞান রাখত না বা তারা সুপথপ্রাপ্ত ছিল না।’ (সুরা মায়েদাহ : ১০৪)। আল্লাহ আরো বলেন, ‘তারা তাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছিল পথভ্রষ্টরূপে। ফলে তারা তাদের পদাংক অনুসরণের প্রতি দ্রুত ধাবিত ছিল। তাদের পূর্বেকার অধিকাংশ পূর্বসূরিগণ বিপথগামী ছিল।’ (সুরা ছফ্ফাত : ৬৯-৭১)।

আত্মসম্মান ও আত্মগর্ব : আত্মসম্মান ও আত্মগর্ব হক গ্রহণের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন তাকে বলা হয়, আল্লাহকে ভয় কর, তখন তার মর্যাদার অহংকার তাকে পাপে স্ফীত করে তোলে। অতএব তার জন্য জাহান্নামই যথেষ্ট। আর নিশ্চিতভাবেই সেটা নিকৃষ্টতম ঠিকানা।’ (সুরা বাকরাহ : ২০৬)। আত্মগর্বই মক্কার কুরাইশদেরকে ইসলাম গ্রহণে বিরত রেখেছিল। আল্লাহ বলেন, ‘যখন কাফেরদের অন্তরে ছিল জাহেলিয়াতের উত্তেজনা।’ (সুরা ফাতাহ : ২০৬)। অর্থাৎ জাহেলিয়াতের অহংকার। ‘জাহেলী অহমিকা’ আবু জাহল, ওৎবাহ, শায়বাহসহ তুরাইশ নেতাদেরকে হক থেকে দূরে রেখেছিল। বর্তমানেও অনেক নেতাকে হক থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে তাদের আত্মঅহমিকা।

নিফাক বা কপটতা : নিফাক বা কপটতা এমন এক দোষ, যার কারণে মানুষের ভেতর ও বাহির থাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাহ্যিক চাল-চলন তার সুন্দর হলেও অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ড থাকে কলুষিত। এই মানসিকতা তাকে হক থেকে দূরে রাখে। আল্লাহ বলেন, ‘যখন তাদের বলা হয়, এসো আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তার দিকে এবং রাসুলের দিকে, তখন তুমি কপট বিশ্বাসীদের দেখবে যে, তারা তোমার থেকে একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নেবে।; (সুরা নিসা : ৬১)।

ক্রোধ-রাগ : মানুষের ভেতরের ক্রোধ অনেক সময় তাকে হক থেকে দূরে রাখে। অন্তরের এ ব্যাধির কারণে সে হক থেকে বঞ্চিত হয়। যেমন হাদিসে এসেছে, একবার নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মুখেই দু’ব্যক্তি গালাগালি করছিল। আমরাও নবীজির কাছেই উপবিষ্ট ছিলাম, তাদের একজন অপরজনকে এত রেগে গিয়ে গালি দিচ্ছিল যে, তার চেহারা রক্তিম হয়ে গিয়েছিল। তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি একটি কালিমা জানি, যদি এ লোকটি তা পড়ত, তবে তার রাগ দূর হয়ে যেত। অর্থাৎ যদি লোকটি ‘আঊযু বিল্লা-হি মিনাশশাইত্ব-নির রাজীম’ পড়ত। তখন লোকেরা সে ব্যক্তিকে বলল, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কী বলেছেন, তা কি তুমি শুনছ না? সে বলল, আমি নিশ্চয়ই পাগল নই।’ অর্থাৎ তার রাগ তাকে রাসুলের নির্দেশ পালন থেকে বিরত রাখল। এভাবে মানব মনের সীমাহীন ক্রোধ তাকে অন্ধ করে দেয়। ফলে তা তাকে হক থেকে বিরত রাখে।

ভীরুতা ও কাপুরুষতা : ভীরুতা ও কাপুরুষতা মানুষকে হক থেকে ফিরিয়ে রাখে। মানুষের ভয়, সমাজের ভয় ও লোকলজ্জার ভয় ইত্যাদি কারণে মানুষকে আল্লাহ থেকে দূরে রাখে এবং হক থেকে ফিরিয়ে রাখে। অথচ কেবল আল্লাহভীতি মানুষকে হক গ্রহণে সহায়তা করে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘শক্তিশালী মুমিন দুর্বল মুমিনের চাইতে উত্তম এবং আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়।’ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভীরুতা-কাপুরুষতা হতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। তিনি এভাবে দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি দুশ্চিন্তা ও পেরেশানি থেকে, অক্ষমতা ও অলসতা থেকে, কৃপণতা ও ভীরুতা থেকে, ঋণের বোঝা ও লোকজনের প্রাধান্য থেকে আপনার নিকট পানাহ চাচ্ছি’। যারা আল্লাহকে ভয় করে তারা যে-কোনো মূল্যে হক গ্রহণে তৎপর হয়। পক্ষান্তরে যারা আল্লাহকে ভয় করে না, তারা হক গ্রহণ করতে পারে না।

 

লেখক : আলেম

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads