• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

ধর্ম

নবীযুগের ভাগ্যবান পিতা-পুত্র

  • প্রকাশিত ২৬ জানুয়ারি ২০২১

মুফতি মুহাম্মদ জালাল উদ্দীন

 

 

হজরত জায়েদ (রা.) সেসব পুণ্যবান লোকদের অন্যতম, যারা ইসলাম গ্রহণের আগেই নিজেদের অন্তর দ্বারা তাওহীদের স্বাদ অনুভব করেছিলেন এবং স্বীয় যুগের সকল পাপাচার ও জাহিলিয়াতের কুসংস্কারকে ঘৃণা করতেন। তার ঘৃণাটা এত বেশি ছিল যে, ওদের জবাইকৃত জন্তুও খাওয়া থেকে বিরত থাকতেন তিনি। ইসলাম গ্রহণের আগে একবার রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে হজরত জায়েদ (রা.)-এর বালদাহ উপত্যকায় সাক্ষাৎ হয়। ‘বালদাহ’ তানয়ীমের পথে একটি জায়গার নাম। সেখানকার মুশরিকরা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করে। তা নবীজির সামনে উপস্থিত করলে রাসুল (সা.) তাদের খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকেন। হজরত জায়েদ (রা.)-ও রাসুল (সা.)-এর মতো মুশরিকদের খাবার গ্রহণ থেকে নিজেকে বিরত রাখেন। আর এও বললেন যে, আমি কখনো তোমাদের দেব-দেবীর নামে উৎসর্গকৃত জন্তুর গোশত খাবার হিসেবে ভক্ষণ করতে পারি না।

কুফর ও শিরককে ঘৃণাকারী এই মহান ব্যক্তি তাওহীদের পথ থেকে একসময় অনেক দূরে ছিলেন। তাওহীদের পথ খুঁজে পাওয়ার লক্ষ্যে তার ভ্রমণকাহিনী অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ও শিক্ষণীয়। সত্যের দিশা খুঁজে পাওয়ার জন্য তিনি আরবের বেশ কয়েকটি দেশ পরিভ্রমণ করেছিলেন। তিনি সিরিয়া পৌঁছার পর একজন ইহুদির কাছে নিজের সত্যের পথ খুঁজে পাওয়ার অদম্য ইচ্ছাটি ব্যক্ত করলেন। একথা শুনে ইহুদি বললেন, তুমি যদি আল্লাহর গজবপ্রাপ্ত ব্যক্তি হতে চাও, তাহলে আমাদের ধর্ম গ্রহণ করতে পারো। হজরত জায়েদ (রা.) ইহুদির কথা শুনে বলেন, আাামি তো উক্ত ধর্ম থেকেই পালাচ্ছি। পুনরায় তাতে বন্দি হতে চাই না। এছাড়া অন্য কোনো ধর্ম থাকলে বলতে পারো। ইহুদি বলল, এছাড়া অন্য একমাত্র সত্য ধর্ম হলো ‘দীনে হানিফ’। হজরত জায়েদ (রা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, দীনে হানিফ কী? প্রতিউত্তরে ইহুদি বলল, দীনে হানিফ হলো হজরত ইবরাহীম (আ.)-এর ধর্ম। তিনি ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের কোনোটারই অনুসারী ছিলেন না। তিনি শুধু এক আল্লাহ তাআলার উপাসনা করতেন।

সিরিয়া থেকে ফেরার পথে একজন ইহুদি আলেমের কাছে এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা চাইলে, তিনি তাকে বলেন, তুমি যদি আল্লাহ তাআলার লানতের জিঞ্জির গলায় পরিধান করতে চাও, তাহলে আমাদের ধর্ম গ্রহণ করতে পারো। হজরত জায়েদ (রা.) বলেন, হে রাব্বি! আমাকে এমন একটি ধর্মের পথ বাতলে দিন, যেখানে আল্লাহর গজব ও লানত কোনোটির স্থান নেই! আমি আল্লাহর গজব ও লানত উভয় থেকে বাঁচতে চাই। এ কথা শোনার পর ইহুদি আলেম বললেন, তোমার কাঙ্ক্ষিত ধর্ম হলো ‘দীনে হানিফ’। হজরত জায়েদ (রা.) যখন দেখলেন, সবার মতে সঠিক ধর্ম ‘দীনে হানিফ’ তথা ইবরাহীম (আ.)-এর ধর্ম, তখন তিনি সিরিয়া থেকে ফিরে আসেন। অতঃপর তিনি দু’হাত তুলে প্রার্থনা করে বলেন, হে আমার রব! আমি তোমাকে সাক্ষী রেখে বলছি, এখন থেকে আমি দীনে হানিফের অনুসারী হয়ে গেলাম।

হজরত জায়েদ (রা.)-এর সঠিক ধর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসার জবাবে ইহুদি ও খ্রিস্টান উভয় আলেমই নিজ নিজ ধর্মকে আল্লাহর গজব ও লানতের কারণ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, তারা নিজেদের ধর্ম সম্পর্কে এমন কঠিন সত্য কথাটি কেন বললেন? আর তারা নিজেদের ধর্মের দিকে হজরত জায়েদ (রা.)-কে কেন আহ্বান করলেন না? বিষয়টি সবাইকে সত্যিই কিছুটা অবাক করে বটে। কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করলে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে, এটা তো ছিল ইসলামের বেশ কিছুকাল আগের কথা। ইহুদি ও খ্রিস্টানদের আসমানি কিতাবে শেষ নবীর আগমনের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছিল। ইহুদি ও খ্রিস্টান আলেমদ্বয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনের অপেক্ষায় ছিল। তাদের ধারণা ছিল, শেষ নবীর আগমন বনি ইসরাঈল থেকেই হবে এবং শেষ নবী ওই ‘বনি ইসরাঈল’ ধর্মের প্রতিই আহ্বান করবে। এজন্যই তারা হজরত জায়েদ (রা.)-কে উক্ত দীনের প্রতি আহ্বান করেন, যে দীন সাদরে গ্রহণের ইচ্ছা তাদের ছিল; কিন্তু তাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়, যখন শেষ নবীর আগমন বনি ইসরাঈলে না হয়ে কুরাইশে হয়; তখন তারা বংশীয় গোঁড়ামির কারণে শেষ নবীকে অস্বীকার করে।

হজরত জায়েদ (রা.) কুফরে জর্জরিত আরব দেশে স্বীয় তাওহীদের বিশ্বাস নিয়ে গর্ববোধ করতেন। হজরত জায়েদ (রা.) সম্পর্কে হজরত আবু বকর (রা.)-এর কন্যা হজরত আসমা (রা.)-এর একটি বর্ণনা রয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুয়ত লাভের আগে আমি একবার হজরত জায়েদ (রা.)-কে দেখলাম, কাবা ঘরের দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে বলছিলেন : ‘হে কুরাইশ সম্প্রদায়! আল্লাহর কসম! আমি ছাড়া তোমাদের কেউ দীনে ইবরাহীমের ওপর প্রতিষ্ঠিত নও।’ জাহিলিয়াতের যুগে হজরত জায়েদ (রা.)-এর অনুপম এক মহৎ গুণ ছিল যে, আরব জাতি নিজেদের কন্যাসন্তানকে জীবিতাবস্থায় নির্দয়ভাবে দাফন করত, আর সে সময় আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী বান্দা জায়েদের মনে তাদেরকে বাঁচানোর জন্য দয়া অনুভূত হতো। কোনো জালেম, পাষাণ পিতা স্বীয় কন্যাসন্তানকে হত্যা করতে চাইলে হজরত জায়েদ (রা.) সেই কন্যাকে নিজে দায়িত্বে নিয়ে নিতেন। আর সে কন্যা যখন প্রাপ্তবয়স্কা হতো তখন হজরত জায়েদ (রা.) কন্যার পিতাকে বলতেন, ‘যদি আপনার মন চায় স্বীয় কন্যাকে নিয়ে যান অন্যথা আমার হেফাজতে থাকতে দিন। (বুখারির সূত্রে সিয়ারুসসাহাবা ২য় খণ্ড)

উপরিউক্ত উপাখ্যান তো ভাগ্যবান এক পিতার। এখন তাঁর মহৎ ছেলের গল্প শুনুন। ভাগ্যবান পিতার মহৎ ছেলেটা আসলে কে? কী তাঁর পরিচয়? মহৎ ছেলেইবা কী করে হলো? এমন নানা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে? তাহলে এবার শুনুন। সেই মহৎ ছেলে হজরত সাঈদ বিন জায়েদ (রা.)। তিনিই সেই সাঈদ বিন জায়েদ, যিনি হজরত ওমর (রা.)-এর ভগ্নিপতি ছিলেন। হজরত ওমর (রা.) যখন রাসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করার জন্য উদ্যত হলেন, তখন রাস্তায় কেউ তাকে বলল, প্রথমে নিজের বোনের খোঁজ নাও। হজরত ওমর (রা.) তাদের ঘরে পৌঁছে স্বীয় বোন ও ভগ্নিপতিকে মারধর করেন, এক পর্যায় তারা রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। দীনের ওপর তাদের উভয়ের অসম্ভব দৃঢ়তাই হজরত ওমর (রা.)-কে ‘ফারুকে আজম’ বানিয়েছে।

সাধারণত সর্বসাধারণের সামনে হজরত সাঈদ বিন জায়েদ (রা.)-এর মর্যাদা ও কীর্তি সম্পর্কে তেমন কোনো আলোচনা হতে দেখা যায় না। তবে এটা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট যে, তিনি প্রথম সারির সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত। তিনি প্রথম মুহাজিরদের সাথে মদিনা মুনাওয়ারা হিজরত করেন। হিজরতের দ্বিতীয় বছর মক্কার কুরাইশদের একটি কাফেলা সিরিয়া থেকে যুদ্ধাস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জাম নিয়ে ফিরছিলেন, যা পরবর্তীকালে বদর যুদ্ধের মূল পটভূমি ছিল। উক্ত কাফেলা সম্পর্কে সবিস্তারে জানার জন্য রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত সাঈদ বিন জায়েদ (রা.) ও হজরত তালহা (রা.)-কে বিশেষ গোয়েন্দা হিসেবে প্রেরণ করেন। তারা উভয়ে সিরিয়ার সীমানায় পৌঁছে কাফেলা সম্পর্কে জানে এমন এক ব্যক্তির কাছে মেহমান হন। যখন কুরাইশদের কাফেলা সিরিয়া থেকে রওনা দিয়ে দেয়, তখন তারা দুজনে কাফেলা সম্পর্কে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করে কাফেলার নজর ফাঁকি দিয়ে বিদ্যুৎগতিতে মদিনা মুনাওয়ারার পথে রওনা দেন। কুরাইশদের কাফেলাটি গোপনসূত্রে এ বিষয়ে অবগত হওয়ার কারণে তারা ভিন্ন পথ দিয়ে রওনা হয়। অন্য দিকে হজরত সাঈদ বিন জায়েদ (রা.) ও হজরত তালহা (রা.) মদিনায় পৌঁছার আগেই রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওহির মাধ্যমে ঘটনা সম্পর্কে অবগত হন। আর রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বদর যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে দেন। এটা সেই যুদ্ধ, যা ইসলামকে সর্বকালের জন্য মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখিয়েছে।

হজরত সাঈদ বিন জায়েদ (রা.) যখন মদিনা মুনাওয়ারা পৌঁছেন, তখন মুসলিম মুজাহিদগণ বিজয়বেশে মদিনা মুনাওয়ারায় প্রবেশ করছিলেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করায় হজরত সাঈদ বিন জায়েদ (রা.)-এর সম্মান ও মর্যাদা অনেকগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বদর যুদ্ধের গনিমতের সম্পদ থেকেও অংশ প্রদান করেন। কেননা, তিনি এ যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন। রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে সুসংবাদ দেন যে, তিনি বদর যুদ্ধের অংশগ্রহণের সওয়াব পাবেন এবং তিনি জান্নাতি হওয়ার বিষয়ে নবীজি (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেন। হজরত সাঈদ বিন জায়েদ (রা.) আশারায়ে মুবাশশারা তথা জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবির একজন। হজরত সাঈদ বিন জায়েদ (রা.) বদর যুদ্ধে সশরীরে অংশগ্রহণ ছাড়া সমস্ত যুদ্ধে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে অংশগ্রণ করেছেন।

হজরত সাঈদ বিন জায়েদ (রা.) জীবনের বাকি সময়টা নীরবে-নিভৃতে কাটিয়েছেন। মদিনার কাছেই আকীক নামক স্থানই ছিল তার স্থায়ী আবাসস্থল। সেখানে তিনি সত্তর বছর বয়সে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। চলে যান না ফেরার দেশে জান্নাতের পাখি হয়ে। হজরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা.) তার জানাজার নামাজ পড়ান। আর মদিনার জান্নাতুল বাকিতে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।

 

লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads