• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

মাদকদ্রব্য প্রতিরোধে ইসলাম

  • প্রকাশিত ২৭ জানুয়ারি ২০২১

মো. হুসাইন আহমদ

 

 

 

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। পরিপূর্ণ জীবনবিধান। এতে কোনো খুঁত নেই, নেই কোনো অপূর্ণতা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য দীনকে পূর্ণ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য পরিপূর্ণ দীনরূপে মনোনীত করলাম।’ (সুরা মায়েদা, আয়াত-৩) বর্তমান আমাদের সমাজের সবচেয়ে ভয়াবহ জিনিস হলো মাদকদ্রব্য। সেই মাদকদ্রব্য প্রতিরোধে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও নির্দেশনা রয়েছে। মাদকদ্রব্য হলো মানব-সভ্যতার চরম শত্রু। এটা জীবন ও সম্ভাবনাকে নষ্ট করে শান্তির পরিবারে অশান্তির আগুন প্রজ্জ্বলিত করে এবং সমাজে অনাচার ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে। মাদকদ্রব্য সভ্যতার চাকা পেছনের দিকে ঘুরিয়ে দেয়। তাই কল্যাণের ধর্ম ইসলামে মাদকদ্রব্য সম্পূর্ণ হারাম। কোরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, পূজার বেদী ও ভাগ্যনির্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্তু ও শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন করো। যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। শয়তান তো এটাই চায় যে, মদ ও জুয়ার দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করবে এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে বিরত রাখবে। সুতরাং তোমরা কি নিবৃত্ত হচ্ছ?’ (সুরা মায়েদা, আয়াত- ৯০, ৯১) আয়াতে মাদক সম্পর্কে চূড়ান্ত বিধান দেওয়া হয়েছে এবং একে ঘৃণ্য ও বর্জনীয় ঘোষণা করা হয়েছে।

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, যখন মদ হারাম করা হলো, তখন আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণ একে অপরের কাছে গিয়ে বললেন, ‘শরাব (মদ) হারাম হয়েছে এবং একে শিরকের মতো (মারাত্মক গুনাহ) সাব্যস্ত করা হয়েছে। (আত-তারগীব ওয়াত-তারহীব ৩/১৮০) হাদিস শরিফের ঘোষণায় নেশা ও মাদক সম্পূর্ণরূপে হারাম। তা যে নামেরই হোক, আর যেভাবেই তা গ্রহণ করা হোক। হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, ‘সব নেশা সৃষ্টিকারী দ্রব্য হারাম’। মাদকদ্রব্যের বেচাকেনা এবং এর সাথে যে কোনো পর্যায়ের সংশ্লিষ্টতা নিষিদ্ধ। আর তা আল্লাহর লা’নত ও অভিশাপের কারণ। জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) বলেন, তিনি ফতহে মক্কার বছর যখন আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায় অবস্থান করছিলেন, তাঁকে বলতে শুনেছেন যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল শরাব (মদ) বিক্রয় নিষিদ্ধ করেছেন ...।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-২২৩৬) আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে এক দীর্ঘ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদ সম্পর্কে বলেছেন, ‘যিনি তা পান করা হারাম করেছেন তা বিক্রি করাও তিনি হারাম করেছেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-৪১২৮) এক হাদিসে আছে, ‘মাদকের উপর অভিশাপ; মাদক পানকারীর উপর অভিশাপ, পরিবেশনকারীর উপর অভিশাপ; বিক্রয়কারীর উপর অভিশাপ, ক্রয়কারীর উপর অভিশাপ; যে মাদক নিংড়ায় তার উপর অভিশাপ, যার আদেশে নিংড়ানো হয় তার উপর অভিশাপ; বহনকারীর উপর অভিশাপ, যার কাছে বহন করে নেওয়া হয় তার উপর অভিশাপ; আর যে মাদক বিক্রয়লব্ধ অর্থ ভোগ করে তার উপর অভিশাপ।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৩৬৭৬)

মাদক এমনই খবিস বস্তু, যা উৎপাদন, বিপণন, পরিবেশন ও গ্রহণের যে কোনো পর্যায়ে এর সাথে সংশ্লিষ্ট থাকা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অভিশাপের কারণ। আর এটা তো বলাইবাহুল্য যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অভিশাপ যার উপর তার জীবন কখনো শান্তির হতে পারে না। মাদকের সাথে সংশ্লিষ্টতা তো নিষিদ্ধই, যে মজলিসে মদপান করা হয় ওই মজলিসে উপস্থিত থাকাও নিষিদ্ধ। জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি ‘জাইশান’ থেকে এলেন, তিনি ‘মিয্র’ নামক একটি পানীয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন, যা তাদের অঞ্চলে পান করা হতো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা কি নেশা সৃষ্টি করে?’ লোকটি বললেন, ‘জী হ্যাঁ।’ নবীজি বললেন, ‘নেশা সৃষ্টিকারী সব কিছুই হারাম।’ মোটকথা, ইসলামে নেশা ও মাদক চরমভাবে ঘৃণিত ও বর্জনীয়। অথচ এ ঘৃণ্য ও বর্জনীয় বস্তুরই ব্যাপক বিস্তার ঘটছে সভ্যযুগের মুসলিম-সমাজে।  কোরআন বর্ণিত এর কুফলও এ সমাজকে ভুগতে হচ্ছে। শত্রুতা হানাহানি, আত্মবিস্মৃতি ও আল্লাহ বিস্মৃতি, সালাত-সিয়ামবিমুখতা, উচ্ছৃঙ্খলা ও উন্মত্ততা এখন এ সমাজের সাধারণ প্রবণতা। কোনো কোনো ঘটনা হয়তো আমাদের কিছুটা চঞ্চল করে, কিন্তু এ ধরনের ঘটনা তো ঘটেই চলেছে। এ অভিশাপ থেকে অনেকেই আমরা মুক্তি পেতে চাই। কিন্তু কী উপায় মুক্তির?

মুক্তির একমাত্র উপায় ইসলাম। যে সমাজে ইসলামের আলো প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল, সে সমাজে মাদক ছিল জীবন ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। আরবি সাহিত্যে নেশা ও মাদকের জন্য রয়েছে শতাধিক শব্দ। মাদক ও তার বিভিন্ন অনুষঙ্গের বিবরণ দিয়ে রচিত হয়েছে শত শত পংক্তি। মাদক ছাড়া আরব্য সংস্কৃতি ও আরবীয় অভিজাত্যের কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না। অথচ ওই সমাজ থেকে মাদক শুধু নির্মূলই হলো না, চরম ঘৃণিত ও অপবিত্র বস্তু হিসেবে চিহ্নিত হলো। আর মাদকাসক্ত ব্যক্তি সমাজের চোখে নেমে এল চরম লাঞ্ছিত, অপমানিত ও দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির স্থানে। মাদকের বিষয়ে মদিনা-সমাজের এই আমূল পরিবর্তন ইসলাম ও ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবদান। কিয়ামত পর্যন্ত সকল যুগ ও জাতির জন্য এ এক আলোকিত দৃষ্টান্ত।

কোরআনে চূড়ান্ত বিধান অবতীর্ণ হওয়ার সাথে সাথে সাহাবীগণ যে স্বতঃস্ফূর্ততার সাথে তা বর্জন করলেন এটা নিছক সুব্যস্থাপনার ফল নয়, এটা আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দীর্ঘ মেহনত। সাহাবীদের ঈমানি তরবিয়ত এবং খোদাভীতি ও আখিরাতমুখী চেতনা-বিশ্বাসের ফল। সাহাবীগণ তাদের প্রচণ্ড ঈমানি শক্তি এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি পরম আনুগত্যের কারণেই মাদক বর্জন ও মাদক নির্মূলে সক্ষম হয়েছিলেন। কোনো মানবগোষ্ঠী যদি ইসলামকে যথার্থ ও আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে এবং কোরআন-সুন্নাহর বিধানকে সমর্পিতচিত্তে শিরোধার্য করে নেয়; তাহলে তা তাদের রুচি ও স্বভাব এবং জীবন ও কর্মে কী বিপ্লব আনতে পারে, এ তারই নমুনা। আর হ্যাঁ, ঈমানী তরবিয়ত ও আখেরাতমুখী জীবনবোধের পাশাপাশি যে বিষয়টি এ বিপ্লব সাধন ও রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে তা হচ্ছে সমাজের সর্বস্তরে ‘আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার’ কার্যকর থাকা এবং অপরাধের শাস্তি-বিধান ও দণ্ড প্রয়োগে কোনোরূপ অবিচার কিংবা শিথিলতা না থাকা।

আমাদের চিন্তা করা উচিত, প্রচার ও প্রযুক্তির এই যুগে অর্থ ও ব্যবস্থাপনার সবকিছু থাকা সত্ত্বেও কেন আমরা অসহায়? কীসের অভাবে বর্তমান সভ্যতা অনাচার নির্মূলে চরম ব্যর্থ? আমারা যদি ধর্মবিমুখ বুদ্ধিজীবীগণের ‘প্রত্যাদেশে’ সম্পূর্ণ অভিভূত না হয়ে থাকি তাহলে এ সত্য অনুধাবনে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, অভাব আমাদের কোনো কিছুরই নেই। অভাব শুধু ‘ঈমান’ তথা ভেতরের শক্তির। আর ‘নাহি আনিল মুনকার’ তথা বাইরের শাসনের। এ দুয়ের কারণেই মদিনাসমাজ ছিল নেশা ও মাদকসহ সব অনাচার থেকে মুক্ত। আর এ দুয়ের অভাবেই প্রযুক্তি ও প্রচারের এই যুগেও আমরা চরম অসহায়, ব্যর্থ।

এখনো যারা ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইসলামের বিধি-বিধান মেনে চলেন তারা এ সভ্যতার বড় বড় ব্যাধি থেকে মুক্ত। কিন্তু এ সভ্যতার কেন্দ্রীয় ভূখণ্ডগুলোতে এবং ওদের প্রভাবে আমাদের মুসলিম-দেশগুলোতেও যে ব্যাপক অবক্ষয়, তার প্রধান কারণ উপরের দুই বিষয়ের অনুপস্থিতি। শুধু অনুপস্থিতিই নয়, এর বিপরীত প্রবণতার লালন ও বর্ধনই তো বর্তমান যুগে অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সর্বস্তরের জনগণ, বিশেষত তরুণ ও যুবশ্রেণির মাঝে ঈমানি চেতনার পরিবর্তে কুফরি মানসিকতা, আখিরাতমুখী জীবনবোধের পরিবর্তে ভোগসর্বস্ব ইহজাগতিকতা, কোরআন-সুন্নাহর প্রতি সমর্পণ ও আনুগত্যের পরিবর্তে বিদ্রোহ ও বিরুদ্ধতা তৈরির চেষ্টাই তো ব্যাপকভাবে কার্যকর। আমাদের একশ্রেণির প্রচারমাধ্যম ও সামাজিক পরিবেশের ক্ষেত্রে তো এ প্রয়াস আশংকাজনকভাবে লক্ষণীয়। এখন যদি এ সমাজের সন্তানেরা বিপথগামী হয়, নেশা ও মাদকে আসক্ত হয়, জিনা ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তবে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এটা ইসলামহীন এই সমাজের নীতি ও কর্মপন্থার স্বাভাবিক ফলাফল। শুধুমাত্র কিছু শপথবাক্য পাঠের অনুশীলন কীভাবে এই ভয়াবহ ব্যাধি থেকে মুক্তি  দেবে? এ কারণে ধর্মবিদ্বেষী চক্রকে ও অনৈসলামিক পন্থাকে শুধু ধর্মেরই শত্রু মনে করি না, বরং সমাজ ও সভ্যতারও শত্রু মনে করি।

সত্যি সত্যি যদি আমরা মাদক থেকে মুক্তি পেতে চাই তাহলে গোড়া থেকে সংস্কার শুরু করতে হবে। আবার আমাদের ইসলামের দিকে ফিরে আসতে হবে, ঈমানি পরিবেশে ঈমানি তরবিয়াত গ্রহণ করতে হবে। তাহলে শুধু মাদকই নয়, সব অনাচার থেকেই আমরা মুক্তি পাব। আর মুক্তি আমাদের পেতেই হবে। যেহেতু আখিরাত সত্য, জান্নাত ও জাহান্নাম সত্য তাই সব অনাচার পাপাচার আমাদের ছাড়তেই হবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন!

 

লেখক : শিক্ষার্থী, তাকমিল, দারুস-সুন্নাহ মাদরাসা, টাংগাইল

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads