• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

ধর্ম

কনস্টান্টিনোপল বিজয়ী মুহাম্মদ আল-ফাতিহ

  • প্রকাশিত ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মুজীব রাহমান

 

 

 

আট শতাব্দী যাবত কনস্টান্টিনোপল বিজয় ছিল মুসলিম সেনাপতিদের কাছে একটি স্বপ্ন। বিশিষ্ট সাহাবি মুয়াবিয়া ইবনে সুফিয়ানের যুগ থেকে অনেকেই কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের চেষ্টা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত কেউই সফল হতে পারেননি। প্রত্যেক মুসলিম সেনাপতিই আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কারণ কনস্টান্টিনোপল বিজয়ীর ব্যাপারে স্বয়ং আল্লাহর রাসুল প্রশংসা করে গেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা (মুসলিমরা) অবশ্যই কনস্টান্টিনোপল বিজয় করবে। কতোই না অপূর্ব হবে সেই বিজয়ী সেনাপতি, কতোই না অপূর্ব হবে তার সেনাবাহিনী।’ (আহমাদ আল-মুসনাদ ১৪ : ১৩১)। ওই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি কে? যার ব্যাপারে আল্লাহর রাসুল প্রশংসা করে গেছেন। তিনিই হচ্ছেন মুহাম্মদ আল-ফাতিহ, অটোমান সুলতান দ্বিতীয় মুরাদের সন্তান।

মুহাম্মদ আল-ফাতিহ ১৪৩২ সালের ৩১ মার্চ (২৭ রজব ৮৩৫ হিজরি) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তাঁর পিতা সপ্তম অটোমান সুলতান দ্বিতীয় মুরাদের কাছে লালিত-পালিত হয়েছেন। সুলতানের পদে অধিষ্ঠিত করার জন্য তাঁর পিতা শৈশব থেকেই তাঁকে প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুত করেছিলেন। তিনি পূর্ণ কোরআন মুখস্থ করেছিলেন। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কিত ট্যাক্স, ইসলামি আইনশাস্ত্র, অঙ্কশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা ও যুদ্ধবিষয়ক প্রয়োজনীয় সব দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। তিনি আরবি, ফারসি, লাতিন এবং গ্রিক ভাষাও শিখেছিলেন।

তাঁর পিতা তাঁকে একবার শাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন, যেন তিনি ওই সময়ের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন স্কলারের তত্ত্বাবধানে রাষ্ট্র পরিচালনা বিষয়ক কার্যকর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারেন। এ বিষয়টি তরুণ রাজপুত্রের চরিত্রকে প্রভাবিত করেছিল এবং তার ব্যক্তিত্বকে ইসলামী নৈতিকতা ও শিষ্টাচারের রঙে রঙিন করেছিল। তাঁর তত্ত্বাবধায়ক ও শিক্ষক শায়েখ আবদুস শামস আদ্দীন মুহাম্মদ আল-ফাতিহকে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ তোমাকে অচিরেই প্রশংসিত করবে।’ এসব কথা তাঁর মনোবল বাড়িয়ে দিত। শৈশব থেকেই তিনি জিহাদের প্রতি অনুরক্ত ও অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। ব্যাপকভাবে সংস্কৃতবান ছিলেন। যুদ্ধবিষয়ক জ্ঞানের সুপণ্ডিত ছিলেন তিনি।

১৪৫১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তাঁর পিতা সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ মৃত্যুর পর মুহাম্মদ আল-ফাতিহ সুলতান হোন। অটোমান সাম্রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি তখন বিশ বছরের শক্তিশালী যুবক। খুবই উদ্যমী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তিনি কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের বিষয়ে চিন্তিত ছিলেন, যা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের স্বপ্ন তাকে এতটাই অভিভূত করেছিল যে, তিনি কনস্টান্টিনোপল বিজয় ব্যতীত অন্য কোনো বিষয়ে কারো সাথে তেমন কথা বলতেন না। এমনকি তাঁর সাথে বসে থাকা কাউকে প্রত্যাশিত বিজয় ব্যতীত কথা বলার অনুমতি দিতেন না। শহরের উত্তর-পূর্বের বসফরাস, দক্ষিণের মারমারা সাগর ও অসংখ্য নগর প্রতিরক্ষা দেয়ালের কারণে এ শহর প্রাকৃতিকভাবেই খুব সুরক্ষিত ছিল। তাই তাঁর স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপ ছিল, শহরের উত্তর ও পূর্বে অবস্থিত বসফরাস প্রণালির অংশ নিজেদের  নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা। যাতে ইউরোপ থেকে কনস্টান্টিনোপলে আসা যে কোনো পৃষ্ঠপোষকতা প্রতিরোধ করতে পারেন। তিনি ইউরোপীয় সমুদ্র উপকূলে এক বিশাল দুর্গ তৈরি করেন। শীর্ষ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে তিনি ব্যক্তিগতভাবে এ বিশাল দুর্গ নির্মাণের কাজে অংশ নিয়েছিলেন। এই দুর্গটি নির্মাণে সময় লেগেছিল তিন মাস। এটা পরিচিতি লাভ করেছিল রোমান দুর্গ নামে। আনাতোলিয়া নামে অন্য আরো একটি দুর্গ নির্মাণ করা হয়েছিল। কোনো জাহাজের অটোমান বাহিনীর অনুমতি ছাড়া পারাপার করা সম্ভব ছিল না। এক প্রতিভাবান প্রকৌশলী সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহর জন্য প্রচুর কামান তৈরি করেন। একটি এমন ছিল যা আগে কখনো তৈরি হয়নি। এটি ছিল প্রায় ৭০০ টন। কামানের গোলার শব্দ অনেক দূর থেকে শোনা যেত। এটা স্থানান্তর করতে একশ ঘোড়ার প্রয়োজন হতো। এ কামানটিকে বলা হতো সুলতানিক কামান।

কনস্টান্টিনোপল বিজয় : ১৪৫৩ সালের ৬ এপ্রিল তিনি অভিযান শুরু করেন। এ অভিযানে তিনি ১২ হাজার জাননেসারি, ২০ হাজার অশ্বারোহী, এক লাখ পদাতিক সৈন্য ব্যবহার করেন। সেনাবাহিনী কনস্টান্টিনোপল ঘেরাও করে ফেলল। শহরের সংরক্ষিত দেয়ালগুলোতে দিনরাত কামানের গোলাবর্ষণ শুরু হলো। সময়ে সময়ে সুলতান নতুন নতুন  যুদ্ধকৌশল অবলম্বন করে শত্রুকে অবাক করে দিতেন, যতক্ষণ না নগর রক্ষকরা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং তাদের বাহিনী হাল ছেড়ে না দেয়। ৫৩ দিনের অক্লান্ত যুদ্ধের পর ২৯ মে অভিযান সম্পন্ন করেন। কনস্টান্টিনোপলের জনগণ যখন দেখল তাদের দেয়ালে দেয়ালে অটোমান সাম্রাজ্যের পতাকা দোল খাচ্ছে এবং সৈন্যরা শহরে প্রবেশ করছে, তখন তারা আশ্চর্য হয়ে গেল। অটোমান বাহিনী শহরটি জয় করার পর সুলতান মুহাম্মদ তাঁর ঘোড়ায় চড়ে বিশাল মিছিল নিয়ে শহরে পৌঁছলেন। যেখানে তাঁর মন্ত্রী এবং সেনাবাহিনীর কমান্ডাররাও ছিলেন। সেই সময় থেকেই তিনি ‘আল-ফাতিহ’ (বিজয়ী) হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি যখন শহরে পৌঁছলেন, তখন সৈন্যরা চিৎকার করে তাকে অভিবাদন দিচ্ছিল। ‘মাশাআল্লাহ! মাশাআল্লাহ! আমাদের সুলতান দীর্ঘজীবী হোক! আমাদের সুলতান দীর্ঘজীবী হোক!

জনগণ যখন জানল, সুলতান এসেছেন তখন তারা সবাই কান্নায় ভেঙে পড়ল। কারণ তারা জানে না তাদের ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে। সুলতান যখন সেখানে পৌঁছলেন, ঘোড়া থেকে নেমে প্রথমে দুই রাকাত নামাজ পড়েন। এরপর শহরের লোকদের উদ্দেশে সম্বোধন করে বললেন : ‘থামো তোমরা! আমি হলাম সুলতান মুহাম্মদ। আমি তোমাদের কথা দিচ্ছি, তোমাদের সবার জীবন ও স্বাধীনতা সুরক্ষিত রয়েছে।’ সুলতান নগরবাসীর প্রতি অত্যন্ত সহিষ্ণু ও দয়ালু ছিলেন। তিনি তার সৈন্যদের  যুদ্ধবন্দিদের সাথে ভালো আচরণ করার আদেশ দিয়েছিলেন। সুলতান নিজেই নিজের অর্থ থেকে বিপুলসংখ্যক যুদ্ধবন্দিকে মুক্তিপণ প্রদান করেছিলেন। অবরোধের সময় যারা শহর ছেড়েছিল, তাদেরকে তিনি শহরে ফেরার  অনুমতিও দিয়েছিলেন।

কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের ফলাফল : তিনি এ বিজয় অর্জন করেন, যখন তার বয়স মাত্র ২৩ বছর। এটি তার প্রাথমিক সামরিক প্রতিভা নির্দেশ করে। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে সুসংবাদপ্রাপ্তও ছিলেন। নবীজি (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, একজন ভালো সেনাপতি এই নগরটি জয় করবে। পরে মুহাম্মদ আল-ফাতিহ বলকান শহর জয় করার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিলেন। তিনি সার্বিয়া, গ্রিস, রোমানিয়া, আলবেনিয়া, বসনিয়ান ও হার্জেগোভিনা জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি রোমও জয় করার অপেক্ষায় ছিলেন যাতে তাঁর কনস্টান্টিনোপল বিজয় ছাড়াও গর্বের আরো একটি উৎস থাকে। এই আশা পূরণের জন্য আগে তাকে জয় করতে হবে ইতালি। তাই  এই মিশনের জন্য একটি দুর্দান্ত বহর প্রস্তুত করেছিলেন তিনি। তিনি ইতালীয় শহর ওটারান্টের কাছে তার বাহিনী এবং বিপুলসংখ্যক কামান পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এরপর ১৪৮০ সালের জুলাই মাসে এ দুর্গটি দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি তার উত্তর সামরিক অভিযানের ভিত্তি হিসেবে ওটারান্টকে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যতক্ষণ না তিনি রোম পৌঁছতে সক্ষম হবেন। ইউরোপীয় বিশ্ব তখন খুব আতঙ্কিত হয়েছিল এবং তারা তাদের ঐতিহাসিক শহরটি পতনের আশঙ্কা করছিল। মুহাম্মদ আল-ফাতিহ যখন তাঁর এই স্বপ্ন পূরণের  প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন তিনি হঠাৎ ১৪৮১ সালের ৩ মে  মৃত্যুবরণ করেন।

রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি যেমন ছিলেন : মুহাম্মদ আল-ফাতিহর শাসনামলে তার বিজ্ঞতাপূর্ণ নেতৃত্ব এবং তার সুপরিকল্পিত নীতির কারণে অটোমান সাম্রাজ্য এমন সীমানায় পৌঁছেছিল, যেখানে আগে কখনো পৌঁছেনি। এসব বিজয় শুধু মুহাম্মদ আল-ফাতিহরই অর্জন ছিল না। তাঁর কয়েকজন বিশ্বস্ত সহযোগীর সহায়তায় আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর নবীর সুন্নাহভিত্তিক একটি সংবিধান প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অটোমান সাম্রাজ্য প্রায় চার শতাব্দীকাল এই সংবিধানের ফল পেয়েছিল। তিনি তার শত রাষ্ট্রীয় ব্যস্ততার মাঝেও তিনশটিরও বেশি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যার মধ্যে ১৯২টি মসজিদ ইস্তাম্বুলেই ছিল। তিনি ৫৭টি বিদ্যালয়ও নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর সর্বাধিক বিখ্যাত স্থাপত্য নিদর্শনগুলোর মধ্যে সুলতান মুহাম্মদের মসজিদ ও আবু আইয়ুব আল-আনসারীর মসজিদ অন্যতম।

মুহাম্মদ আল-ফাতিহর সাহিত্যের প্রতিও প্রবল ঝোঁক ছিল। তিনি একজন ভালো কবি এবং নিয়মিত পাঠক ছিলেন। তিনি বিজ্ঞ আলেম ও কবিদের সংগঠনগুলোকে খুব পছন্দ করতেন। তাঁদের থেকে কয়েকজনকে তিনি মন্ত্রীও করেছিলেন। তিনি যেখানেই কোনো বিজ্ঞজনের কথা শুনতেন, তাকে তিনি সহযোগিতা ও সাপোর্ট করতেন। ইস্তাম্বুল আসার আমন্ত্রণ জানাতেন যাতে তাঁর জ্ঞানের মাধ্যমে তিনি উপকৃত হতে পারেন।

তার স্বভাব-চরিত্র যেমন ছিল : মুহাম্মদ আল-ফাতিহ ছিলেন একজন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ মুসলমান, যিনি ইসলামী শরিয়তের বিধানকে যথাযথভাবে মেনে চলতেন। মুহাম্মদ আল-ফাতিহ তাঁর ধারাবাহিক পরিশ্রম ও সুগঠিত পরিকল্পনার মাধ্যমে তাঁর স্বপ্নগুলো পূরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কনস্টান্টিনোপল বিজয়কে কেন্দ্র করে তিনি কামান ও তার বহর প্রস্তুত করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, যুদ্ধে জয়ী হওয়ার সম্ভাব্য সবকিছুই তিনি নিপুণভাবে পরিচালনা করেছিলেন। তিনি তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা, দৃঢ় মনোবল ও লক্ষ অর্জনের প্রচেষ্টার মাধ্যমে তাঁর স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। রাসুলের ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কিত হাদিসের মর্যাদা লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সারা বিশ্বে এখন তিনি মহান মুসলিম বীর এবং বিজয়ী হিসেবে সুখ্যাতি লাভ করেছেন।

 

লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads