• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯

ধর্ম

ইবাদতের প্রতি নারীদের আগ্রহ

  • প্রকাশিত ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মুফতি আমিরুল ইসলাম লুকমান

 

 

 

আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্যই। আল্লাহর ইবাদত ব্যতীত এই পৃথিবীতে মানুষের আর কোনো উদ্দেশ্য নেই, থাকতে পারে না। ইসলামের প্রতিটি বিধান পালন করার মাধ্যমে মানবসন্তান আল্লাহর ইবাদতের সীমার ভেতরে থাকবে। বান্দা হওয়ার সার্থকতা প্রমাণ করবে। আল্লাহতায়ালা মানবজাতি থেকে এমনই কামনা করেন। বান্দা ও বান্দীরা সর্বদা তাঁর তাসবিহ, জিকির ও ইবাদতে লিপ্ত রয়েছে, এমন দৃশ্য আল্লাহতায়ালার নিকট অতিপ্রিয়। ইতিহাস সাক্ষী, ইসলামের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ইবাদতের আদেশের উপর পুরুষরা যেভাবে আমল করেছেন, নারীরা কোনো অংশে তাদের থেকে পিছিয়ে থাকেননি। মহান আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভে পুরুষরা যেভাবে নিজেদের রাতকে ইবাদতের দ্বারা সজ্জিত করছেন, তেমনি নারীরাও মহান প্রভুর প্রিয় হতে রাতকে বন্দেগীতে অলংকরণ করেছেন। নিজেদের রবের একান্ত রহমত ও মাগফিরাত পেতে রাত্রী জাগরণকে অভ্যাসে পরিণত করেছিলেন।

একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতিদিন বারো রাকাত নফল নামাজ আদায় করবে, তার জন্য জান্নাতে বাড়ি নির্মাণ করা হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই কথা হজরত উম্মে হাবিবা (রা.) সরাসরি শুনলেন। এরপর সারা জীবন প্রতিদিন তিনি এই বারো রাকাত নামাজ আদায় করেছেন। কখনোই পরিত্যাগ করেননি।’ (মুসনাদে আহমদ: ৯০৭৯১) নবী কন্যা ফাতেমা (রা.) প্রচুর রোজা রাখতেন। তাহাজ্জুদ নামাজ সাধারণত ছুটত না। আল্লাহর ভয়ে সারাক্ষণ পেরেশান থাকতেন। সর্বদা মুখে আল্লাহর জিকির চালু থাকত। তাঁর স্বামী বিখ্যাত সাহাবি আলী (রা.) বলেন, আমি ফাতেমাকে খাবার প্রস্তুত করা অবস্থায় তাসবিহ পাঠ করতে দেখতাম। সালমান ফারসি (রা.) বলেন, ফাতেমা (রা.) ঘরের বিভিন্ন কাজ করতে করতে কোরআন তেলোয়াত করতেন। চাক্কিতে আটা পেষণের সময় জিকির-তেলোয়াত করতেন। আলী (রা.) বলেন, ফাতেমা ইবাদতের প্রতি সীমাহীন গুরুত্ব দিতেন। কিন্তু ঘরের কাজে কোনো অসুবিধা দেখা দিত না। পুত্র হাসান (রা.) বলেন, আমি আম্মাজানকে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিজের ইবাদতঘরে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে আল্লাহতায়ালার প্রশংসা ও তাসবিহ আদায় করতে দেখতাম। কান্নাকাটি করে দোয়া করতে দেখতাম। তিনি নিজের জন্য দোয়া না করে মুসলমান নারী-পুরুষের জন্য অনেক দোয়া করতেন। ইবাদতের সময় তার পবিত্র চেহারা লাল হয়ে যেত। শরীরে কম্পন সৃষ্টি হতো। প্রচুর ক্রন্দন করার কারণে চোখের পানিতে জায়নামাজ ভিজে যেত। হাসান বসরি (রহ.) বলেন, ফাতেমা (রা.) সারা রাত নফল নামাজ পড়তেন। অসুস্থ ও দুর্বল অবস্থায়ও তার একই নিয়ম ছিল, ইবাদত বাদ দিতেন না। ইবাদত, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নবী (সা.) এর সুন্নাত পালন তাঁর রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছিল। (সিরাতে ফাতেমাতুজ জাহরা)

সিদ্দীক কন্যা আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) সব সময় ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকতেন। আল্লাহর ইবাদতেই তিনি সুখ-শান্তি খুঁজে পেতেন। একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূর্যগ্রহণের নামাজ পড়ছিলেন। অনেক নারী সাহাবির সাথে আসমা (রা.)ও অংশগ্রহণ করেছিলেন। নবী কারীম (সা.) নামাজ কয়েক ঘণ্টা দীর্ঘ করলেন। আসমা (রা.) প্রচণ্ড অসুস্থ ছিলেন। ভীষণ কষ্ট হওয়ার পরও ইবাদতের প্রতি প্রবল আগ্রহের কারণে তিনি নামাজ ভাঙ্গেননি। নামাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। চেহারায় পানি ছিটানোর পর তার জ্ঞান ফিরে আসে। (বুখারি, হদিস সং- ৩৫০১)

হজরত খাওলা (রা.) সর্বদা ইবাদত-বন্দেগীতে ব্যস্ত থাকতেন। সারা রাত নফল নামাজে নিমগ্ন থাকতেন। একবার নবী কারীম (সা.) এবং আয়েশা (রা.) একসাথে বসে ছিলেন। খাওলা (রা.) পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আয়েশা (রা.) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এই যে খাওলা। সারা রাত নফল নামাজ আদায় করে। রাতে একটুও ঘুমোয় না। নবী (সা.) আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, রাতে একটুও ঘুমোয় না? বললেন, মানুষের ওই পরিমাণ কাজ করা উচিত, যতটুকু সে সর্বদা করতে সক্ষম।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং- ২৩৬৫২)

সফওয়ান বিন মুআত্তাল (রা.) এর স্ত্রী একবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে অভিযোগ করলেন, আমার স্বামী আমাকে নামাজ-রোজা পালন করতে বাধা প্রদান করে। নবী (সা.) সফওয়ান বিন মুআত্তাল (রা.)কে ডেকে কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। সাহাবি উত্তর দিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমার স্ত্রী লম্বা লম্বা সুরা পাঠ করে নামাজ আদায় করে, আমি সে ক্ষেত্রে তাঁকে বাধা প্রদান করি। আর রোজার ক্ষেত্রে বাধা প্রদানের বাস্তবতা হলো, সে বিরতিহীন রোজা আদায় করে। আমার কষ্ট হয়ে যায়। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং- ১০৮০১১)

স্বপ্নবিজ্ঞানের বিখ্যাত মনীষী মুহাম্মাদ ইবনে সিরিনের কন্যা হাফসা বিনতে সিরিন (রহ.) নিজ সময়ের প্রখ্যাত বুজুর্গ নারী ছিলেন। দিন-রাত ইবাদতে মশগুল থাকতেন। ইবাদতের জন্য বাড়িতে একটি বিশেষ কক্ষ নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর খোদাপ্রেমের খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। মাহদি বিন মাইমুন (রহ.) বলেন, হাফসা বিনতে সিরিন (রহ.) ত্রিশ বৎসর যাবত কথার উত্তর ও প্রাকৃতিক প্রয়োজন ব্যতীত নিজ জায়নামাজ থেকে উঠেননি! (সিয়ারু আলামিন নুবালা-৪/৫০৭)

মুআজাতা বিনতে আবদুল্লাহ (রহ.) বিশিষ্ট মহিলা তাবিয়ি ছিলেন। আলী ও আয়েশা (রা.) এর ছাত্রী ছিলেন। নিজ সময়ের বিখ্যাত আল্লাহওয়ালা মুত্তাকি নারী ছিলেন। রাতে খুব কম ঘুমোতেন। ইবাদত ও মুনাজাতে কাটিয়ে দিতেন। সকালে কোরআন তেলোয়াতের  প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল। প্রতিটি সময় যেন আল্লাহর ইবাদতে কাটে এ ব্যাপারে সীমাহীন চিন্তিত ও ব্যস্ত থাকতেন। বাসর রাতটিও ইবাদতে কাটিয়ে দিয়েছিলেন। প্রতিদিন তিনশত রাকাত নফল নামাজ আদায় করতেন। প্রতি রাতে কোরআন তেলোয়াত করতেন। শীতের মৌসুমে পাতলা কাপড় পরিধান করতেন যেন শীতের কারণে রাতে ঘুম না আসে। (নিসাউম মিন আসরিত তাবিয়িন)

 

লেখক : খতিব, আল মক্কা জামে মসজিদ, শ্রীনগর, মুন্সীগঞ্জ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads