• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

ধর্ম

ক্রোধ : ক্ষতি ও নিয়ন্ত্রণের উপায়

  • প্রকাশিত ০১ মার্চ ২০২১

রাশেদ নাইব

 

 

 

সেই বিত্তবান ব্যক্তি তার শখের ব্রান্ড নিউ গাড়িটি নিজ হাতেই পরিষ্কার করছিলেন। তখন তার ছয় বছরের সুন্দরী সুশ্রী মেয়েটা পাথর হাতে গাড়িটির কাছে আসে এবং গাড়ির একপাশে পাথর দিয়ে আঁচড়িয়ে কিছু লেখে। লোকটি যখন দেখতে পায় তার মেয়ে গাড়ির গায়ে আঁচড় কাটছে তখন সে রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে এবং মেয়েটির হাতে আঘাত করে। মুহূর্তের মাঝেই হাত থেকে অঝোর ধারায় রক্ত প্রবাহিত হতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি জানতে পারেন যে তার মেয়ের হাতে একাধিক ফ্র্যাকচার হয়েছে। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মেয়েটি যখন প্রচণ্ড ব্যথায় তার বাবাকে জিজ্ঞেস করে, ‘বাবা, আমার হাত কবে ঠিক হবে?’ তখন লোকটি নির্বাক হয়ে পড়ে! বাবা ভাবতে থাকে কী করলাম, এমনটা না করলেও পারতাম। নিজের মাঝে একটা অনুশোচনা কাজ করছে। সে তার শখের গাড়িটির কাছে ফিরে যায় এবং রাগে গাড়িটিকে অসংখ্যবার লাথি মারে। সে তার মেয়েকে কতটা নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করেছে তা ভেবে সে অত্যন্ত কষ্ট পায়। গাড়ির যেখানে তার মেয়ে পাথর দিয়ে আঁচড় কেটেছিল সেখানে চোখ যায় বাবার। সে দেখতে পায়, সেখানে লেখা ছিল, ‘বাবা, আমি তোমাকে ভালবাসি’।

 

বর্তমান পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষের সিংহভাগই অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করে থাকে। জাতিসংঘ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং বিভিন্ন দেশের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অনেক দেশেই দারিদ্র্যের হার কমছে এবং মানুষের সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল বাড়ছে। মানবজাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, উন্নত বিশ্বে বসবাসকারী মানুষের অধিকাংশই অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি নিরাপদ এবং সমৃদ্ধ জীবনযাপন করছে। যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের আশপাশের এতো মানুষকে কেন সব সময় ক্রুদ্ধ, হিংস্র কিংবা রাগান্বিত মনে হয়? রাস্তায় চলাচল করার সময়, সামাজিক মাধ্যমে বা কোনো রাজনীতিবিদের সমালোচনা করার সময়ে মানুষের ক্ষোভ যেভাবে প্রকাশিত হয়; তা দেখে কেউ যদি ধারণা পোষণ করে যে, পৃথিবীর মানুষ আসলে চিরস্থায়ী ক্রোধের মধ্যে ডুবে আছে-তাহলে তাকে খুব একটা দোষ দেওয়া যাবে না। ব্রিটিশ সাংবাদিক এবং লেখক অলিভার বার্কম্যানের লেখালেখির বিষয়বস্তু হলো কীভাবে সুখের সন্ধান পাওয়া যায়। এই বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়েই তিনি ‘ক্রোধ’ বিষয়টিকে আরো ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করেছেন। তিনি খুঁজে বের করতে চেয়েছেন যে আমরা কেন রেগে যাই? কোন বিষয়গুলো রাগ চড়িয়ে দেয়? অথবা, রাগ করা কি আসলে খারাপ?

যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইয়োর হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক অ্যারন সেল বলেন, ক্রোধ খুবই জটিল একটি বিষয়। নাটকীয়ভাবে বর্ণনা করলে বলা যায়, এটি মানুষের মন নিয়ন্ত্রিত একটি যন্ত্র। আরেকজন ব্যক্তির মাথার ভেতরে ঢুকে নিজেকে ওই ব্যক্তির কাছে আরো গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার একটি পদ্ধতি। তাদের মন পরিবর্তন করে তাদের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে জয়ী হওয়ার একটি প্রক্রিয়া। প্রফেসর সেল বলেন এই ‘মন নিয়ন্ত্রণের’ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা রাখে মানুষের রাগান্বিত চেহারা। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন যে, ক্রুদ্ধ হলে মানুষের ভ্রু বিস্তৃত হয়ে যাওয়া, নাসারন্ধ্র প্রসারিত হওয়া এবং চোয়ালের পুরুত্ব বেড়ে যাওয়ার মতো পরিবর্তনগুলো মানুষ উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে-বলেন প্রফেসর সেল। রাগ হলে মানুষের মুখের অভিব্যক্তিতে যেসব পরিবর্তন হয়, তার প্রত্যেকটির ফলেই মানুষকে শারীরিকভাবে শক্তিশালী দেখায়। প্রফেসর সেল বলেন, এই বিষয়গুলো মানুষ শেখে না; বরং জন্মসূত্রে অর্জন করে কারণ ‘অন্ধ শিশুরাও একই ধরনের ক্রুদ্ধ অভিব্যক্তি প্রকাশ করে।’

আপনি এমনটা ধারণা করতেই পারেন যে, আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে যারা ক্রুদ্ধ হতো না এবং সংঘর্ষে জড়াতো না, তারা দ্রুত রেগে যাওয়া ব্যক্তিদের চেয়ে বেশিদিন বাঁচত। তবে বিষয়টি আসলে সেরকম নয়। প্রফেসর সেল বলেন, একটি বিশেষ ধাঁচের রাগ যেসব মানুষের মধ্যে ছিল, তারা অন্যদের চেয়ে বেশি হারে বংশবৃদ্ধি করেছে। স্বার্থের সংঘাতে বিজয়ী হয়ে এবং আরো ভালো জীবনযাপনের লক্ষ্যে ক্রমাগত দর-কষাকষির মাধ্যমে তারা সেটি সম্ভব করেছে।

 ক্রোধকে বোঝার জন্য আমাদের ভাবতে হবে যে এটি আমাদের মধ্যে কী ধরনের শারীরিক পরিবর্তন ঘটায়, এর ফলে আমাদের আচরণে কী পরিবর্তন আসে, ক্রোধের বশবর্তী হয়ে আমরা কী চিন্তা করি এবং কী চিন্তা করতে পারি না। যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান প্রফেসর রায়ান মার্টিন, যিনি ক্রোধ বিষয়ে গবেষণা করেন। তিনি বলেন, রাগ হলো মানুষের সহানুভূতিশীল স্নায়ুবিক কার্যক্রম শুরু হয়। রাগ হলে আপনার হূৎস্পন্দন বেড়ে যায়, শ্বাস-প্রশ্বাস ঘন হয়ে যায়, আপনি ঘামতে শুরু করবেন এবং পরিপাক ক্রিয়া ধীরগতিতে চলতে শুরু করে। মানুষ যখন মনে করে যে তার সাথে অবিচার করা হচ্ছে, তখন শরীরের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে এধরনের উপসর্গ প্রকাশ পায়। একই সাথে মস্তিষ্কও ভিন্ন আচরণ করা শুরু করে। মানুষ যখন তীব্রভাবে কিছু অনুভব করে, তখন চিন্তা ভাবনার অধিকাংশই ওই একটি বিষয় কেন্দ্রিক হয়ে থাকে। তখন তারা ‘টিকে থাকা’ বা ‘প্রতিশোধ নেওয়ার’ বিষয়টিকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। কোনো বিশেষ একটি অবিচার বা অন্যায়ের বিষয়ে চিন্তা করা বা তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করার সময় অন্য কোনো বিষয় নিয়ে মানুষের মস্তিষ্ক চিন্তা করতে চায় না।

রাগ নিয়ন্ত্রণে ইসলামের নির্দেশনা : রাগ বা ক্রোধ যেটাই বলি; ইসলাম তা হারাম কাজ হিসেবে সাব্যস্ত করেছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাগের ব্যাপারে নিষেধ করেছেন। ‘রাগ করো না তোমরা, রাগ করো না, রাগ করো না।’ এভাবে বারবার নিষেধ করেছেন। যদি কারো রাগ এসে যায়, তাহলে ইসলাম এই রাগকে যেভাবেই হোক প্রশমন করার জন্য, রাগ থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য, প্রথমে যে বিধান দেওয়া আছে সেটা হচ্ছে, শয়তানের কারণেই মূলত এই রাগের উদ্ভব ঘটে। শয়তান যদি কোনোভাবেও তৈরি করে থাকে অথবা কোনো বিষয়ে তাকে প্রলুব্ধ করে, তখন সেখান থেকে মূলত রাগের উদ্ভব হয়। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেটি পছন্দ করেছেন, সেটি হচ্ছে, আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করা। আল্লাহ-র কাছে ইশতেহাদা করা। এটা হচ্ছে রাগের প্রথম ধাপ। ‘আউযুবিল্লাহিমিনাশ শায়তনির রাজিম’ পড়ার পর যদি দেখা যায় যে, রাগ কমে গেছে তাহলে ভালো। তাহলে তিনি রাগ কিছুটা প্রশমন করতে পারলেন। রাগ থেকে মুক্ত হতে পারলেন।

আর যদি তাতেও না হয়ে থাকে, তাহলে এটা বলা হয়েছে যে, তিনি অজু করতে পারেন। অজু করতে পারলেও রাগ কিছুটা প্রশমিত হতে পারে। রাগ কমতে পারে। যদি দেখেন তাতেও রাগ কমছে না, তাহলে সে সময় যে অবস্থায় থাকবেন তা থেকে অন্য অবস্থায় চলে যাওয়া। যেমন : দাঁড়িয়ে থাকলে বসে পড়া। এই অবস্থার পরিবর্তন হলে মানুষের মনের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে রাগ আসলে যে অবস্থা তৈরি হয়ে থাকে, সেখান থেকে কিছুটা হালকা হতে পারে। এটা মূলত নির্ভর করছে ব্যক্তির অবস্থার ওপর। অনেকের বিবেক-বিবেচনাও হারিয়ে যায়। যদি এটা প্রকট হয় তাহলে তিনি সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করবেন যে কারণে রাগ হচ্ছে, সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া। তাহলে রাগটা ঠাণ্ডা হতে পারে। এটা হলো রাগ থেকে বাঁচতে ইসলামের বিধান।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাগ থেকে আল্লাহর বান্দাকে বিরত থাকতে বলেছেন। কারণ, রাগ এমন একটা অবস্থা যে, এর মাধ্যমে তাঁর যত হাসানাত বা ভালো কাজ আছে, সবগুলোকে নষ্ট করে দিতে পারে, ভস্মীভূত করে দিতে পারে। কারণ রাগের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি নিজের বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারে। তাই রাগ থেকে বিরত রাখার জন্য যত ধরনের চেষ্টা রয়েছে, সবগুলো করতে বলা হয়েছে যাতে করে রাগ থেকে আমরা নিজেরা বিরত থাকতে পারি। রাগ মূলত মানুষের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। কারণ যখন কারো রাগ এসে যায়, তখন তাঁর কর্মকাণ্ড এমন হয় যে, পরবর্তী সময়ে নিজেকে লজ্জিত হওয়া ছাড়া তাঁর আর কোনো উপায় থাকে না। তখন সে ভাবে, আমার মতো লোক এই কাজ করেছি! নিজেও উপলব্ধি করতে পারে না আমি এ কাজটি করেছি। তাই এ কাজ থেকে আমাদের দূরে সরে আসতে হবে।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads