• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস ও ইসলাম

প্রতীকী ছবি

ধর্ম

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস ও ইসলাম

  • প্রকাশিত ০৭ এপ্রিল ২০২১

ডা. মুহাম্মদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

ভয়াবহ  করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে গোটা বিশ্ব হিমশিম খাচ্ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত ও মারা যাচ্ছে। এমনই এক বৈশ্বিক দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে (৭ এপ্রিল) ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস-২০২১’ পালিত হবে। স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। শারীরিক সুস্থতার নামই স্বাস্থ্য। অসুস্থ শরীর যার, তারপক্ষে সুখলাভ অসম্ভব। স্বাস্থ্য এক অমূল্য সম্পদ। ভালো স্বাস্থ্যই সুস্থ ও সতেজ জীবনের চাবিকাঠি। এ কথা আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সাধারণ মানুষের ভালো স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান বাধা দরিদ্রতা। তেমনই আরো একটি প্রধান বাধা সচেতনতার অভাব। স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সচেতনতা এমন একটি বিষয়, যার ওপর একটি দেশের মানবসম্পদ অনেকাংশে নির্ভরশীল। নাগরিকের সুস্বাস্থ্যের অভাব দেশের উৎপাদনশীলতা কমে, কমে যায় উন্নয়নের গতি। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের গুরুত্ব এখানেই।

স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যা ও উদ্বেগগুলোর প্রতি সাধারণ জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ৭ এপ্রিল বুধবার বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস একটি বার্ষিক ইভেন্ট হিসেবে পালিত হচ্ছে। একটি নির্দিষ্ট থিম নির্বাচিত করা হয় সারা বছরব্যাপী স্বাস্থ্য কার্যক্রম চালানো জন্য। এ দিনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতি বছর সংস্থাটি এমন একটি স্বাস্থ্য ইস্যু বেছে নেয়, যা বিশেষ করে সারা পৃথিবীর জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। সে দিন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হয় এ দিবসটি। ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রসংঘ অর্থনীতি ও সমাজ পরিষদ আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের সম্মেলন ডাকার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৪৬ সালের জুন ও জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাংগঠনিক আইন গৃহীত হয়। ১৯৪৮ সালের ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রথম সম্মেলনটি হয়েছিল প্রতিষ্ঠার দুই মাসের মাথায় ১৯৪৮ সালের ২৪ জুন। নির্ধারিত দিনে জেনেভায় সংস্থাটির প্রথম সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ৪৬টি দেশ। এই সংগঠরেন আইন আনুষ্ঠানিকভাবে  যেদিন কার্যকর হয়, সেইদিনই ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস’ বলে নির্ধারিত হয়। ১৯৫০ সাল থেকে নিয়মিতভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে পৃথিবীর নানা প্রান্তে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালিত হয়ে আসছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সংস্থার সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে প্রতি বছর যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে দিবসটি পালিত হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্যপদ পাওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দিবসটি পালন করে আসছে। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জোরালোভাবে প্রস্তাব করেছে, পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্র অবশ্যই সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নীতি  চালু করবে। যাতে করে বিশ্বের একজন মানুষও স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকিতে না থাকে। প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পেতে গিয়ে বছরে বিভিন্ন দেশে কমপক্ষে এক কোটি মানুষ ১.৯ ডলারের কম উপার্জনক্ষম মানুষের বলয়ে ঢোকে। অর্থাৎ চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করতে বাধ্য হয়। গড়ে ৮ কোটি মানুষ তার প্রাত্যহিক মোট খরচের ১২ শতাংশের বেশি স্বাস্থ্যসেবার জন্য খরচ করে। এটি একটি ব্যাপক অর্থনৈতিক ঝুঁকি তৈরি করে। উন্নত দেশগুলোর নাগরিকরা ব্যক্তিগতভাবে অথবা রাষ্ট্রীয় পলিসির কারণে এ স্বাস্থ্যসেবাটুকু নিতে সমর্থ হয়। কিন্তু এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা-এসব মহাদেশের রাষ্ট্রগুলো বা এদের জনগণ এ সুবিধা দিতে বা পেতে ব্যর্থ হচ্ছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বলতে সব মানুষের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বোঝায়। যাতে করে তাকে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে না হয়। একই সঙ্গে এটি সব মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসাপ্রাপ্তির বিষয়টি বোঝায় না। এটি আসলে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যসেবা নীতিকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে উৎসাহ দেয়, যাতে যে কোনো রাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যেই জনগণের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করে সব মানুষের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে। এখানে স্বাস্থ্যসেবা বলতে শুধু ওষুধ প্রদানকে বোঝায় না। স্বাস্থ্যসেবা বলতে আরো বোঝায় : ক. সব রোগীর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা, খ. সম্ভাব্য সব অসংক্রামক রোগের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাপনা, গ. মৌসুমভিত্তিক সংক্রামক রোগের সময়োচিত প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা, ঘ. জীবনব্যাপী সব মানুষের আদর্শ সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সব প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক কাঠামো তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা ও উদ্বেগগুলোর প্রতি সাধারণ জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এটি একটি বার্ষিক ইভেন্ট হিসেবে পালিত হয়। একটি নির্দিষ্ট থিম নির্বাচিত করা হয় বছরব্যাপী স্বাস্থ্য কার্যক্রম চালানোর জন্য।

ইসলামমের দৃষ্টিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস : আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের স্লোগান হচ্ছে- চিকিৎসার চেয়ে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনাই উত্তম। তাই সুস্থ থাকতে সর্বপ্রথম প্রয়োজন সতর্কতা। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তিকে পাঁচটি জিনিসের আগে পাঁচটি জিনিসকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করার উপদেশ দিয়েছেন। তন্মধ্যে রোগব্যাধি আসার আগে সুস্থ অবস্থাকে (আল্লাহর নিয়ামত) মনে করার তাগিদ দিয়েছেন। কেননা সুস্বাস্থ্য ও সুস্থতাকে মানুষের জন্য গনীমত। রোগের উৎপত্তি সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘হে মুহাজির সমপ্রদায়! এমন পাঁচটি অভ্যাস রয়েছে, সেগুলো যেন তোমাদের মধ্যে পাওয়া না যায়। সে জন্য আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। এগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে অশ্লীলতা। যখন কোনো জাতির মধ্যে অশ্লীলতা প্রকাশ পায়, তখন তাদের মাঝে প্লেগ ও বিভিন্ন ধরনের দুরারোগ্য ব্যাধি মহামারী আকারে বিস্তার লাভ করবে। যা তাদের পূর্বপুরুষ কখনো শোনেনি।’

পরিবেশগত কারণেও মানুষের রোগ হয় : পরিবেশ যখন ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে, তখনই মানুষ নানামুখী সমস্যায় পড়ে। অর্থাৎ রোগে আক্রান্ত হয়। পরিবেশের ক্ষতি ইসলাম পছন্দ করে না বরং তাকে গোনাহের কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের কারণে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে। আল্লাহতায়ালা তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা (অন্যায়-অনাচার-জুলুম থেকে) ফিরে আসে। (সুরা রুম) কোরআন-হাদিস ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের ধারাও তাই প্রমাণ করে যে, মানুষ যেমন পাপাচার-অশ্লীলতার কারণে রোগাক্রান্ত হয়, তেমনি পরিবেশগত কারণেও হয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে তোমরা সুস্বাস্থ্য প্রার্থনা করো। কারণ, ইমানের পর সুস্বাস্থ্যের চেয়ে অধিক মঙ্গলজনক কোনো কিছু কাউকে দান করা হয়নি।’ (ইবনে মাজাহ)

সুস্থ থাকার প্রয়োজনীয়তা : মানবজীবনের সুস্বাস্থ্য ও সুস্থতা অত্যন্ত জরুরি বিষয়। ইসলামের বিধি-বিধানগুলো সুন্দরভাবে পালন করার জন্যও সুস্বাস্থ্য ও সুস্থতা প্রয়োজন। শারীরিক ও মানসিক শক্তি ছাড়া ইবাদতেও মন বসে না। হাদিসে এসেছে, ‘দুর্বল মুমিনের তুলনায় শক্তিশালী মুমিন অধিক কল্যাণকর ও আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়। তবে উভয়ের মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে।’ (মুসলিম) অন্য হাদিসে এসেছে-অধিকাংশ মানুষেই দুটি নিয়ামতের বিষয়ে অসতর্ক ও প্রতারিত। ১. সুস্থতা এবং ২. অবসরতা। (বুখারি) অন্যত্র প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, কিয়ামতের দিন বান্দাকে নিয়ামত সম্পর্কে সর্বপ্রথম যে প্রশ্নটি করা হবে তা হলো তার সুস্থতা সম্পর্কে। তাকে বলা হবে আমি কি তোমাকে শারীরিক সুস্থতা দিইনি? (তিরমিজি)

চিকিৎসা গ্রহণের তাগিদ : রোগাক্রান্ত হলে চিকিৎসা গ্রহণ জরুরি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে অসুস্থ হলে চিকিৎসা গ্রহণ করতেন। লোকদের চিকিৎসা নিতে উৎসাহিত করতেন। তিনি বলতেন, ‘হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ করো। কেননা মহান আল্লাহতায়ালা এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি, যার প্রতিষেধক তিনি সৃষ্টি করেননি। তবে একটি রোগ আছে যার কোনো প্রতিষেধক নেই, তা হলো বার্ধক্য।’ (আবু দাউদ) হজরত সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি একবার ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ি। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে দেখতে এসে তার হাত মোবারক আমার বুকের ওপর রাখেন। আমি অন্তরে এর শীতলতা অনুভব করি। অতঃপর তিনি বলেন, তুমি হূদরোগে আক্রান্ত হয়েছ। তুমি ছাকীফ গোত্রের হারেস ইবনে কালদার কাছে যাও। সে (এই রোগের) চিকিৎসা করে।’ (আবু দাউদ) বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা রোগ দিয়েছেন, রোগের প্রতিষেধকও নাজিল করেছেন। প্রত্যেক রোগের চিকিৎসা রয়েছে। সুতরাং তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ করো। তবে হারাম বস্তু দ্বারা চিকিৎসা গ্রহণ করবে না।’ সুতরাং হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে, ইসলামের দৃষ্টিতে চিকিৎসা গ্রহণ করা শুধু বৈধই নয় বরং তা গ্রহণ করাই কাম্য।

শেষ কথা হলো বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেই এই হাদিসের আমল অত্যন্ত জরুরি। তিনি বলেছেন, ‘পেটের এক তৃতীয়াংশ খাদ্য দ্বারা, এক তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য এবং এক তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য খালি রাখবে।’ (ইবনে মাজাহ) পরিমিত খাবার গ্রহণে অভ্যস্ত হলে সকল প্রকার রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকা যায়। কারণ মাত্রাতিরিক্ত ভোজন ডায়াবেটিসের অন্যতম কারণ। এ রোগের ফলেই মানুষের হার্ট, কিডনী, চোখ, দাঁত, নার্ভ সিস্টেমসহ সকল গরুত্বপূর্ণ অংগগুলো সম্পূর্ণ বা আংশিক ধ্বংস হতে থাকে। সুতরাং রোগ থেকে মুক্ত থাকতে হলে বিশ্বনবীর ফর্মূলাই আরোগ্য থাকার অন্যতম উপায়। আল্লাহতায়ালা বিশ্ববাসীকে ইসলামি অনুশাসন মেনে সুস্বাস্থ্য ও সুস্থ থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক স্বাস্থ্য তথ্য

কো-চেয়ারম্যান, হোমিওবিজ্ঞান গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র

drmazed96@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads