• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
চিকিৎসাবিজ্ঞানে রমজানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

প্রতীকী ছবি

ধর্ম

চিকিৎসাবিজ্ঞানে রমজানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

  • প্রকাশিত ১৮ এপ্রিল ২০২১

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

সময়ের আবর্তে আরবি সনের এগারোটি মাস অতিক্রম করে আমাদের কাছে হাজির হয়েছে রহমাতের ঝরনাধারা রমজানুল মুবারক। বহুলপ্রতীক্ষিত বস্তু যখন সুন্দর উপস্থাপনায় কারো কাছে উপস্থিত হয় তখন আর আনন্দের কোনো সীমা থাকে না। তেমনি, চাতক পাখির ন্যায় দীর্ঘ এগারোটি মাস প্রতীক্ষার পর মুসলমানদের কাছে যখন মাহে রমজানুল মুবারক উপস্থিত হয় তখন প্রবাহিত হতে থাকে রহমাতের ঝরনাধারা। খুলে দেওয়া হয় ক্ষমার দুয়ার। খুলে দেওয়া হয় জান্নাত। আকাশের দরজা। বন্ধ করে দেওয়া হয় জাহান্নামের দরজা। কবর আজাব। শয়তানকে করা হয় শিকলবন্দি। পবিত্র করে তোলা হয় মানুষকে। পাপ থেকে করা হয় মুক্ত। ধনীরা আদায় করতে থাকে গরিবের হক। আদায় করতে থাকে জাকাত। আদায় করে ফিতরা। পাপীরা তাওবার মাধ্যমে ফিরে আসে সত্যের দুয়ারে। ধনী-গরিব, শত্রু-মিত্র দাঁড়িয়ে যায় একই কাতারে। শুরু হয় শান্তি, সৌহার্দ্যের অপরূপ লীলা ও রহমাতের ঝরনাধারা।

সাধনা, ত্যাগ, সংযম এবং  মহান বার্তা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয় হিজরি সালের নবম মাস মাহে রমজান। এ মাসকে মহান আল্লাহতায়ালা জাল্লা শানহু সিয়াম পালনের মাস হিসেবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এ মাসের প্রতিটি ক্ষণ-অনুক্ষণ মহান আল্লাহতায়ালা জাল্লা শানহুর খাস রহমতে পরিপূর্ণ। এ মাস এক অসাধারণ মাস। নিঃসন্দেহে এ মাস স্বতন্ত্র ও মাহাত্ম্যের দাবি রাখে।

মুসলিমজাহানে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস মাহে রমজানের কঠোর সিয়াম সাধনা শুরু হয়। দীর্ঘ এক মাসব্যাপী রমজানের কঠোর পরিশ্রম ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে মহান আল্লাহতায়ালা জাল্লা শানহুর তাকওয়া অর্জন ও এর সামগ্রিক সুফল সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারলে বিশ্বব্যাপী মানবতার শান্তি ও সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত হবে। রমজানের রোজা সাধনার মাধ্যমে মানুষের অন্তরের রিপুকে মহান আল্লাহতায়ালা জাল্লা শানহুর তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিশ্চিত করা হয়। অন্তরের পশুপ্রবৃত্তি তথা নফসে আম্মারাকে বশীভূত করে মানুষ নফসে লাওয়্যামা ও নফসে মুতমাইন্না (সর্বোচ্চ প্রশান্ত আত্মা)-এর পর্যায়ে উপনীত হয়। প্রকৃত রোজাদার তাই এ মাসে আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংশোধনের পর্যায় উপনীত হয়। আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংশোধনের মাধ্যমে মহান আল্লাহতায়ালা জাল্লা শানহুর নৈকট্য লাভ করে। আর সত্যিকার সিয়াম সাধনার মাধ্যমে সমাজ থেকে সব অন্যায়, অনাচার, ব্যভিচার ও সন্ত্রাস দূরীভূত হয়। গোটা ব্যক্তি জীবনে নিরাপদ  জীবনযাপনের নিশ্চয়তা লাভ করা যায়।

পবিত্র কোরআনুল কারীমে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়ছিল তোমাদের পূর্বপবর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পার।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-১৮৩) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘রমজান মাস, এ মাসেই নাজিল করা হয়েছে আল কোরআন যা মানুষের জন্য হিদায়েত ও উজ্জ্বল বিবরণদায়ক স্পষ্ট নিদর্শন এবং হক ও বাতিলের মীমাংসাকারী, অতএব, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস পাবে, তাকে অবশ্যই রোজা রাখতে হবে। তবে রোগাক্রান্ত হলে অথবা সফরে থাকলে এ সংখ্যা অন্য সময় পূরণ করবে। আল্লাহ চান তোমাদের জন্য যা সহজ, আর তিনি চান না তোমাদের জন্য যা কষ্টকর, যেন তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং আল্লাহর মহিমা ঘোষণা কর। তোমাদের সৎপথে পরিচালিত করার জন্য এবং যেন তোমরা শুকর করতে পার।’ (সুরা বাকারা, আয়াত- ১৮৫)

প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যখন রমজান মাস আসে তখন আকাশের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়, অপর এক বর্ণনায় আছে, জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয়, শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। অন্য বর্ণনায় আছে, রহমাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়।’ (বুখারি ও মুসলিম) হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছাওয়াবের আশায় রমজান মাসের রোজা রাখে তার পূর্বের সমুদয় গুনাহ (সগীরা) মাফ করে দেয়ওা হবে, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছাওয়াবের আশায় রমজান মাসে রাতে ইবাদতে কাটাবে তার পূর্বের গুনাহসমূহ মাফ করা হবে এবং যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছাওয়াবের আশায় কদরের রাত ইবাদতে কাটাবে তার পূর্বকৃত সমুদয় গুনাহ মাফ করা হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)

রোজা সম্পর্কে আধুনিক অভিজ্ঞ চিকিৎসকগণ বলেন, সর্বক্ষণ আহার সীমাতিরিক্ত ভোজন ও দূষিত খাদ্য খাওয়ায় শরীরে এক প্রকার বিষাক্ত উপকরণ ও উপাদানের সৃষ্টি হয় এবং জৈব বিষ জমা হয়। যার কারণে দেহের নির্বাহী ও কর্মসম্পাদন অঙ্গ প্রতঙ্গগুলো বিষাক্ত উপকরণ ও জৈব বিষ দমনে অক্ষম হয়। ফলে তখন জটিল ও কঠিন রোগের জন্ম হয়। দেহের মধ্যকার এমন বিষাক্ত ও দূষিত উপাদানগুলো অতিদ্রুত নির্মূলকরণের নিমিত্তে পাকস্থলিকে মাঝে মধ্যে খালি করা একান্ত প্রয়োজন। রোজাই এর একমাত্র সহায়ক। যার বিকল্প করা যায় না। ১৯৬০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডা. গোলাম মোয়াজ্জেম কর্তৃক মানব শরীরের ওপর রোজার প্রভাব শীর্ষক গবেষণামূলক নিবন্ধ অনুযায়ী জানা যায়, রোজা দ্বারা শরীরের ওজন সামান্য হ্রাস পায় বটে, তবে তা শরীরের কোনো ক্ষতি করে না; বরং শরীরের মেদ কমাতে রোজা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অপেক্ষা অধিক কার্যকর। তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার আলোকে আরো জানা যায়, যারা মনে করেন রোজা রাখলে শূল বেদনার প্রলোপ বৃদ্ধি পায়, তাদের এ ধারণা সঠিক নয়, বরং ভোজনে তা বৃদ্ধি পায়।

পাকিস্তানের প্রবীণ প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ হোসেনের নিবন্ধ থেকে জানা যায়, যারা নিয়মিত সিয়াম পালন করে সাধারণত তারা বাতরোগে, বহুমূত্র, অজীর্ণ, হূদরোগ ও রক্তচাপজনিত ব্যাধিতে আক্রান্ত কম হয়। এছাড়া ডা. ক্লাইভসহ অন্যান্য চিকিৎসাবিজ্ঞানী পর্যন্ত স্বীকার করেছেন, ইসলামের সিয়াম সাধনার বিধান স্বাস্থ্যসম্মত ও ফলপ্রসূ। আর তাই মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার রোগব্যাধি তুলনামূলকভাবে অন্য এলাকার চেয়ে কম দেখা যায়। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কম খাওয়ার জন্য বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। ক্ষুধা লাগলে খেতে বলেছেন এবং ক্ষুধা না লাগলে খাওয়া বন্ধ করার জন্য উপদেশ দিয়েছেন। যা চিকিৎসাবিজ্ঞানসম্মত। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে দীর্ঘজীবন লাভ করার জন্য খুব বেশি খাওয়ার প্রয়োজন নেই।

জার্মানির ডাক্তার ফেডারিক হানেমান (জন্ম ১৭৫৫ মৃত্যু ১৮৮৪) বলেছেন, ‘রোজার মাধ্যমে মৃগীরোগ, গ্যাস্টিক ও আলসারের চিকিৎসা করা যায়।’ ইটালির বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী মাইকেল এংলো ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। ৯০ বছর বয়স পার হওয়া সত্ত্বেও তিনি কর্মক্ষম ও কর্মঠ ছিলেন। তাকে এর রহস্য সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি বহু দিন আগ থেকেই মাঝে মাঝে রোজা রেখে আসছি। আমি প্রত্যেক বছর এক মাস, প্রত্যেক মাসে এক সপ্তাহ রোজা রাখি এবং দিনে তিন বেলার পরিবর্তে দুই বেলা খাবার খাই।’

ক্যাম্ব্রিজের ডাক্তার লেখার জিম। তিনি ছিলেন ফার্মাকোলজি বিশেষজ্ঞ। সব কিছু গভীরভাবে পর্যালোচনা করা হচ্ছে তার স্বভাব। তিনি রোজাদার ব্যক্তির খালি পেটের খাদ্যনালীর লালা স্টোমক সিক্রেশন সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরি পরীক্ষা করেন। এতে তিনি বুঝতে পারলেন, রোজার মাধ্যমে ফুডপাটি কোলস সেপটিক সম্পূর্ণ আরো দেহের সুস্থতার বাহন। বিশেষত্ব পাকস্থলীর রোগের আরোগ্য গ্যারান্টি।

সিগমন্ডনারায়েড মনস্তত্ত্ব বিজ্ঞানীর মন্তব্য। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট মনস্তত্ত্ব বিশারদ। তার আবিষ্কৃত থিওরি মনস্তত্ত্ব ক্ষেত্র পথনির্দেশকের ভূমিকা পালন করে। তিনিও রোজা এবং উপবাসের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। তিনি বলেন, রোজার মাধ্যমে মস্তিষ্কের এবং মনের যাবতীয় রোগ ভালো হয়। মানুষ শারীরিকভাবে বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। কিন্তু রোজাদার ব্যক্তির দেহ ক্রমাগত বায়ুচাপ সহ্য করার যোগ্যতা অর্জন করে। রোজাদার ব্যক্তি খিঁচুনি এবং মানসিক রোগ থেকে মুক্তি লাভ করে। এমনকি কঠিন রোগ থেকে মুক্তি লাভ করে এবং এর রোগের সম্মুখীন হওয়া থেকে বিরত থাকে।

আলেকজান্ডার গ্রেট এবং এরিস্টল। উল্লিখিত দুজনই ছিলেন অধিবাসী। নিজ নিজ ক্ষেত্রে তারা বিশ্বখ্যাত। তারা মাঝে মাঝে ক্ষুধার্ত বা উপবাস থাকাকে দেহের সুস্থতা ও সবলতার জন্য খুবই উপকার বলে মনে করেন। আলেকজান্ডার গ্রেট বলেন, আমার জীবনে অনেক ব্যতিক্রম ধর্মীয় অভিজ্ঞতা এবং ঘটনা দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি, সকাল-সন্ধ্যা যে আহার করে সে রোগমুক্ত। আমি ভারতে এরকম প্রচণ্ড উষ্ণ এলাকা দেখেছি। সেখানে সবুজ গাছপালা পুরে গেছে। কিন্তু সেই তীব্র গরমের মধ্যেও আমি সকালে এবং বিকালে খেয়েছি। সারাদিন কোনো প্রকার পানাহার করিনি। এর ফলে আমি অনুভব করেছি এক নতুন অফুরন্ত প্রাণশক্তি। (আলেকজান্ডার গ্রেট, মাহফুজুর রহমান আখর তারী)।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখপাত্র প্রফেসরস মোরপান্ড বলেছেন, আমি ইসলাম সম্পর্কে মোটামুটি জানার চেষ্টা করেছি। রোজা অধ্যায় অধ্যয়নের সময় আমি খুবই মুগ্ধ ও অভিভূত হয়েছি। চিন্তা করেছি ইসলাম তার অনুসারীদের জন্য এক মহাফর্মুলা দিয়েছে। ইসলাম যদি তার অনুসারীদের কোনো বিধান না দিয়ে শুধু রোজা দিত তবুও এর চেয়ে বড় নেয়ামত আর কিছু হতো না। বিষয়টি নিয়ে আমি একটু গভীর চিন্তায় মনোনিবেশ করলাম। তাই বাস্তব অভিজ্ঞতার জন্য আমি মুসলমানদের সাথে রোজা রাখতে শুরু করলাম। দেখলাম রোগ অনেকটাই কমে গেছে। আমি রোজা চালিয়ে গেলাম, এতে দেহ আরো উন্নতি পরিবর্তন উপভোগ করলাম। কিছুদিন পর লক্ষ করলাম আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছি। এক মাস পর আমি নিজের মাঝে এক অসাধারণ পরিবর্তন অনুভব করলাম। (রসালানঈ দুনিয়া)

পাকিস্তানের বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সার্ভে রিপোর্ট। রমজান মাসে নাক, কান, গলার অসুখ কম হয়। জার্মানি, ইংল্যান্ড এবং আমেরিকার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের একটি টিম এ সম্পর্কে গবেষণা করার জন্য এক রমজান মাসে পাকিস্তান আসে। তারা গবেষণাকর্মের জন্য পাকিস্তানের করাচি, লাহোর ও ফয়সালাবাদ শহরকে মনোনীত করেছেন। সার্ভে করার পর তারা যে রিপোর্ট দিলেন তার মূলকথা ছিল-‘মুসলমানরা নামাজের জন্য যে অজু করে সেই অজুর কারণে নাক, কান, গলার অসুখ কম হয়। খাদ্য কম খাওয়ার কারণে পাকস্থলী এবং লিভারের অসুখ কম হয়। রোজার কারণে তারা মস্তিষ্ক এবং হূদরোগের আক্রান্ত কম হয়।’ পরিবেশে মহান আল্লাহতায়ালা জাল্লা শানহু আমাদেরকে সঠিক আকিদা ও আমলের মাধ্যমে জীবন গঠনের তাওফিক এনায়েত করুন। আমিন, ছুম্মা আমিন।

লেখক : এম এ কামিল, হাদিস, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া

স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা, হিউম্যান রাইটস রিভিউ সোসাইটি কেন্দ্রীয় কমিটি

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads