• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

পাখিদের নিশ্চিন্ত ও নিরন্তর ওড়ার কৌশল

  • তপু রায়হান
  • প্রকাশিত ০৯ এপ্রিল ২০১৮

কখনো বাঁচার জন্য অনুকূল পরিবেশের খোঁজে, কখনো প্রজননের জন্য বা কখনো খাবারের জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে পারে কেবল পরিযায়ী পাখিরাই। সুদূর সাইবেরিয়া থেকে হাজার হাজার মাইল পথ উড়ে দীর্ঘ পথ পরিভ্রমণের জন্য পরিযায়ী পাখিদের জুড়ি মেলা ভার।

বাংলার আকাশে সেই পরিযায়ী পাখিদের দেখেই হয়তো জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‎

‘বুনো হাঁস পাখা মেলে- শাঁই-শাঁই শব্দ শুনি তার;

এক-দুই-তিন-চার-অজস্র-অপার-

রাত্রির কিনার দিয়ে তাহাদের ক্ষিপ্র ডানা ঝাড়া

এঞ্জিনের মতো শব্দ; ছুটিতেছে- ছুটিতেছে তারা!’

পরিযায়ী পাখিদের ওড়াউড়ির এই ক্ষমতা জীবনানন্দকে প্রভাবিত করেছিল। পাখিদের ডানার শব্দ তাকে মোহিত করেছিল। ঠিক কী উপায়ে পাখিরা এত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে পারে? কোন কৌশলে সুশৃঙ্খল থাকে পাখিদের বিশাল ঝাঁক?- এসব প্রশ্নের জবাব কবির জানা ছিল না।

তবে কবির অজানা হলেও বিজ্ঞানীরা ঠিকই জেনেছেন পরিযায়ী পাখিদের দীর্ঘ পথ ভ্রমণের রহস্য। আসুন জেনে নিই বিজ্ঞানীরা কী বলছেন-

সুদীর্ঘ পথ পাড়ি

প্রজনন মৌসুম শেষে সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পাখি আপন নিবাসে ফিরে যায় চৌম্বক অনুভূতি (magnetoreception) নামক এক বিশেষ অনুভূতির কারণে। এই অনুভূতির কারণে প্রাণী পৃথিবীর চুম্বকক্ষেত্র শনাক্ত করতে পারে। পাখি, বাদুড়, মৌমাছি এরা সকলেই এই বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। ডলফিন, হাঙ্গরের মতো বড় প্রাণীদেরও এই বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

আগে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে ভেবে এসেছেন চৌম্বক অনুভূতি পাখির ঠোঁটে লোহা সমৃদ্ধ কোষের মাধ্যমে প্রযুক্ত হয়, তবে সাম্প্রতিক গবেষণা চৌম্বক অনুভূতির কারণ হিসেবে পাখির চোখের একটি প্রোটিনের কথা বলা হয়েছে। এটি একটি আলোক সংবেদী ক্রিপ্টোক্রোম প্রোটিন যার নাম Cry4।

গবেষণায় গবেষকগণ কম্পিউটার মাইক্রোস্কোপির মাধ্যমে রবিন পাখির চোখের চার ধরনের ক্রিপ্টোক্রোম প্রোটিনের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করেন। প্রথম তিন ধরনের প্রোটিনের সঙ্গে চৌম্বক অনুভূতির কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া না গেলেও চতুর্থ প্রোটিন Cry4-এর ক্ষেত্রে পাখির ভ্রমণচক্রের সঙ্গে সঙ্গে ক্রম পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করা যায়। এর ফলে ধারণা করা যায় এই প্রোটিনটি পরিযায়ী পাখির ভ্রমণ সক্ষমতার সঙ্গে জড়িত। প্রজনন ঋতুতে পাখির চোখে এই প্রোটিনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, আর অন্য সময়ে এর পরিমাণ কম থাকে।

আরেকটি গবেষণায় ৩৯টি পাখির মস্তিষ্ক, পেশি এবং রেটিনার Cry1, Cry2 এবং Cry4 প্রোটিনের মাত্রা পর্যবেক্ষণে রাখা হয় এবং সারা দিনের একটি ঘুমচক্রে এদের পরিবর্তন মাপা হয়। দেখা যায়, ঘুমচক্রের সঙ্গে Cry4 প্রোটিনের মাত্রা অপরিবর্তিত থাকে, অন্যদিকে Cry1 এবং Cry2 প্রোটিনের পরিমাণ প্রতিদিনই সময়ের সঙ্গে ওঠা-নামা করে। গবেষকরা বলেন চৌম্বক অনুভূতির জন্য Cry4 প্রোটিনের পরিমাণ নির্দিষ্ট থাকা জরুরি। এটি শুধু পরিব্রজনের সময়েই নয় বরং পাখির দৈনন্দিন জীবন-যাপনের চলাফেরা সংশ্লিষ্ট স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের জন্যও প্রয়োজন।

গবেষকদের দাবি, Cry4 প্রোটিনের কোয়ান্টাম ক্রিয়া পাখিকে চৌম্বকক্ষেত্র শনাক্ত করতে সহায়তা করে। গবেষকগণ যদিও Cry4-কেই চৌম্বকক্ষেত্র শনাক্তকরণের কারণ হিসেবে আলামত পেয়েছেন তবে এখনই এই বিষয়টিকে তারা নিশ্চিত করছেন না।

এ বিষয়ে পাখির পরিভ্রমণ বিশেষজ্ঞ হেনরিক মৌরিৎসেন বলেন, ‘যদিও Cry4 প্রোটিনের জড়িত থাকার ব্যাপারে আমাদের কাছে প্রচুর আলামত আছে তবে এখনো এটি প্রমাণিত নয়।

ওড়ার সময় কেন V আকৃতির বিন্যাস তৈরি করে?

সরলরেখায় উড়ে যাওয়া পরিযায়ী পাখিগুলো V আকৃতির বিন্যাস তৈরি করে ওড়ে। এ ধরনের বিন্যাসে সর্বাগ্রে একটি পাখি অবস্থান করে এবং তার পেছনে ক্রমান্বয়ে বাকি পাখিগুলো অবস্থান করে উড়তে থাকে। কিন্তু এর কারণ কী?

দলবদ্ধ পরিযায়ী পাখির ওড়ার এই ধরনের বিন্যাসের দুটি তত্ত্ব প্রচলিত আছে। একটি হচ্ছে বাতাসের ফ্লুইড ডায়নামিক্স মেনে চলে শক্তি বাঁচানো। সম্মুখের পাখিটির উড্ডয়নের ফলে বাতাসে যেই ভোর্টেক্স তৈরি হয় তা পেছনের পাখিগুলো কাজে লাগায়, ফলে তাদের ওড়ার জন্য শক্তি অপেক্ষাকৃত কম খরচ হয়। অন্য তত্ত্বটি হচ্ছে, এ ধরনের বিন্যাসের ফলে পাখিগুলো পরস্পরের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে।

তবে এই তত্ত্বগুলোর উভয়টিই একই সঙ্গে প্রযোজ্য হতে পারে। দুই তত্ত্বের কোনটি বেশি তাৎপর্যপূর্ণ তা নির্ভর করে বিভিন্ন সূচকের ওপর। যেমন- কোন ঋতুতে পাখিগুলো উড়ছে, কিংবা ঝাঁকের মধ্যে কী পরিমাণ পাখি আছে বা কী উদ্দেশ্যে তারা উড়ছে ইত্যাদি। উদাহরণস্বরূপ, স্থানীয়ভাবে খাবার সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে উড্ডয়নের সময় শক্তি সংরক্ষণের ভূমিকা গৌণ, বরং এই সময় পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা বা একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়ানোই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়।

অপরদিকে, দীর্ঘ দূরত্বে ভ্রমণের ক্ষেত্রে যোগাযোগ অপ্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়। বরং এই সময় দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে প্রয়োজনীয় শক্তি যতটা সম্ভব ধরে রাখাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

ফ্লুইড ডায়নামিক্স এবং শক্তি তরঙ্গ বিন্যাসের সঙ্গে সম্পর্কিত গণনা করে দেখা হয়েছে পাখিগুলো ওড়ার সময় ঠিক কোন অবস্থানে থাকলে উড়তে গিয়ে তাদের শক্তি সবচেয়ে কম খরচ হবে। পাখির প্রকৃত ঝাঁকে অবস্থানের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই এদের অপেক্ষাকৃত শক্তি বাঁচিয়ে চলা অবস্থাতেই পাওয়া যায়, তবে সবক্ষেত্রে সর্বনিম্ন শক্তির বিন্যাসে এরা থাকে না। গবেষণায় পাখিগুলোর অবস্থানকে কতকগুলো ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। কিছু পাখির অবস্থান শক্তির সর্বনিম্ন বিন্যাসের জন্য যে অবস্থান প্রযোজ্য তাতে। কিছু পাখি ঠিক এই সর্বনিম্ন শক্তি অবস্থানে থাকে না, বরং এরা দৃষ্টির মাধ্যমে অন্যদের দিকে লক্ষ রাখার জন্য যে অবস্থান ভালো অপেক্ষাকৃত সেই অবস্থানে থাকে। অন্য কিছু পাখি যারা এই দুই অবস্থানের কোনোটিতেই পুরোপুরি দক্ষ নয়, তারা একটি মাঝামাঝি অবস্থান মেনে চলে যেন উভয় ধরনের সুবিধাই গ্রহণ করতে পারে।

শীর্ষস্থানে নেতৃত্বদানকারী পাখির অবস্থান সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হয়, তবে কত দ্রুত তা হয় এবং এর মূল উদ্দেশ্য কী, সেসব নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা হয়নি। মাটি থেকে এদের ঝাঁকের দিকে দীর্ঘ সময়ে ও দূরত্বে পর্যবেক্ষণ করা খুবই দুঃসাধ্য। অনুমাননির্ভর তথ্য অনুযায়ী নেতৃত্বদানকারী পাখি নির্ভর করে বয়স, অভিজ্ঞতা, লিঙ্গ, পরিস্থিতি এবং সামাজিক মর্যাদার ওপর, কিন্তু গবেষকরা এখনো বুঝে উঠতে পারেননি, তারা কীভাবে এসব পরীক্ষা করে নিশ্চিত হবেন। কিছু বিজ্ঞানী ক্ষুদে বিমানের পাশাপাশি এসব পাখিকে উড়তে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, যাতে বিমানগুলোকে এদের পাশাপাশি চালিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা যায়; হয়তোবা এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে আরো বিস্তারিত জানা যাবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads